×

মুক্তচিন্তা

সমাজ ও রাজনীতিতে আদর্শের শুদ্ধিতা বড়ই জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩১ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কীভাবে কতটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যাবে সেই প্রস্তুতিও কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আসলে সামনে কতটা নির্ভরভাবে এগোতে পারব তা নিয়ে সন্দেহ থাকলে বলার কিছু থাকবে কী? তবে এখনই যদি নিজেদের অবস্থানকে স্বচ্ছভাবে দেখার চেষ্টা করা যায়, সমাজ ও রাজনীতিতে শুদ্ধিতার উদ্যোগগুলো নেয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে বলে মনে করি না। প্রয়োজন সেই উদ্যোগটি শুরু করা।
দেশে শুদ্ধি অভিযান গত বছরের শেষদিকে বেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। নতুন বছরে এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না। শুদ্ধি অভিযান থেমে গেল, নাকি যাত্রাবিরতি দিল তা বুঝা গেল না। তবে বাংলাদেশের মতো সমাজ ও রাজনীতিতে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা গেলেও ধরে রাখা মোটেও সহজ কাজ নয় এটি সবারই কমবেশি জানা। কারণ আপাদমস্তক সমাজটা নানা ধরনের দুর্নীতি ও দ্বিচারিতায় বেড়ে উঠেছে। যে সমাজে মানুষ দুর্নীতির দায় প্রধানত অন্যের দিকে দিতে চায়, কৃতিত্বের সবটুকুই নিজে পেতে চায় সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ইত্যাদি খুব বেশি গভীরে স্থান করে নিতে পারেনি। আমাদের সমাজটি গত ৪৮ বছরে নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তাতে আদর্শের জায়গাটি ছেড়ে দুর্নীতির ওপর বেশি ভর করেছে। ফলে এখানে সমাজের ওপর শ্রেণি, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তও খুব বেশি দৃঢ়ভাবে আদর্শের আর্থ ও সামাজিক কাঠামোতে দাঁড়াতে পারেনি, সেটির ওপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে। মানহীন শিক্ষাব্যবস্থা যা মানুষকে কর্মদক্ষতায় যেমন গড়ে তুলছে না, যুক্তি, সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শে মোটেও তৈরি করে না। মোটামুটি শিক্ষার সনদ প্রাপ্তির কৃতিত্ব নিয়েই বেশি সন্তুষ্টির দাবিদার থাকছে। ফলে ৪৮ বছরে সমাজটা যতটা গড়ে উঠেছে তার ভেতরে আদর্শের ভিত্তিটা নানা কারণেই দুর্বল থেকে গেছে। এ কারণে এখানে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে আমরা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তাতে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও সৃজনশীলতার চর্চা খুব বেশি ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়নি। যে কোনো পেশার দিকে তাকালেই যেটি অনায়াসে চোখে পড়ে তা হচ্ছে মুষ্টিমেয় দুই চারজন ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ পেশাজীবী বিত্তের সন্ধানে দৌড়াচ্ছে, বিত্ত দেশে-বিদেশে লুকিয়ে রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশবিমুখ করছে। এটি কোনো পেশাতে নেই? যারাই বিত্তশালী হচ্ছেন তারাই সন্তানদের সপরিবারে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দেশে যারা অবশিষ্ট থাকছেন তাড়াও প্রচুর অর্থের বিনিময়ে যে ইংরেজি শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করছেন তাদেরও গন্তব্য বিদেশ-বিভুঁই। দোষটা শুধু রাজনীতিবিদদের দিকে দিলেই হবে না। দেশটাকে যারা নানাভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন, পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছেন, সেবাধর্মী নানা পেশায় যুক্ত রয়েছেন তাদের প্রায় সবার মধ্যেই বিত্তের বৈধ-অবৈধ প্রাপ্তির তাড়না বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে কিছু কিছু বালিশকাণ্ডের মতো কাণ্ডকীর্তির কথা আমরা শুনি। গণমাধ্যমেরই বা কী অবস্থা? দেশে হাজার হাজার পত্রপত্রিকা কীভাবে চলছে তা নিয়ে অনুসন্ধান করা হলে খুব বেশি সন্তুষ্টির জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিক্ষকতার পেশা নামে আছে, কাজে নেই। ডাক্তারি পেশা এখন কী হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৌশলীরা কী করছেন তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে কি? আমলারা দেশটাকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন তাও তলিয়ে দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। অথচ ১৬ কোটি মানুষকে এখনো অন্নের সংস্থান করছেন কৃষক সমাজ, রেমিট্যান্স দিয়ে উন্নয়ন সহযোগিতা করে যাচ্ছেন এক কোটি প্রবাসী। এর বাইরে গার্মেন্টস, কিছু শিল্প, কলকারখানার শ্রমজীবী মানুষ নিরন্তর শ্রম দিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে চলছেন। সে কারণে দেশটা এখনো অর্থনৈতিকভাবে চলছে। কিন্তু ব্যাংক, শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে সর্বত্র লুটেরা, দুর্নীতিবাজরা কীভাবে দেশের অন্যতম অর্থ খাতকে ফোকলা করে দিচ্ছে তাতো সবার কাছেই জানা। এই মানুষগুলো কারা। এরা এই দেশের তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সনদ লাভকারী। শিক্ষিত মানুষ বলে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু যাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন দেশের অর্থ লুটপাটকারী হিসেবে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে গড়ে ওঠা ‘শিক্ষিত সমাজ’ আদর্শিকভাবে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে মোটেও সঠিক শিক্ষাটি পায়নি বা নেয়নি। ফলে সমাজের আলো ছড়ানোর জন্য যে জনগোষ্ঠীটি তৈরি হচ্ছে তারা আসলে সমাজটাকে আলোকিত না করে অন্ধকারে নিমজ্জিত করতেই যেন ভ‚মিকা রাখছেন। এরাই দেশের রাজনীতিতে এদল-ওদল করে বেড়াচ্ছে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতিতে দলবদল করছে। কারণ তাদের কাছে আদর্শের চাইতে ব্যক্তিস্বার্থেই দলীয় রাজনীতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলে এসে অনেকেই ভিড় করেন যারা মনেপ্রাণে সেই দলের আদর্শ কতটা বুঝেন, ধারণ করেন সেটি মস্তবড় প্রশ্ন হয়ে আছে। দেশে দ্বিধারার রাজনীতি গড়ে ওঠার পেছনে একটাই সুবিধা এদল না হয় ওদল এর বাইরে তৃতীয় কোনো দল ক্ষমতায় আসার অবস্থানে নেই। তবে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো জোটবেঁধে ওত পেতে থাকে নির্বাচনে কোন দল তাদের প্রার্থী হতে কাছে ভেড়াবে। যে দলই ডাকে সে দলের দিকেই জোট নিয়ে কিংবা খণ্ড-বিখণ্ডভাবে ছুট দেয়। আবার এককালের আদর্শিক বামরা বাম দলজোট ছেড়েছুড়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আদর্শের রাজনীতি ও দলে ঠাঁই নিয়েছে, অনেকে আবার মধ্যপন্থায় অবস্থায় নিয়ে ডান-বামের সুবিধার হিসাব করছেন। রাজনীতিতে অনেক অনেক বড় বড় ব্যক্তি রয়েছেন। তারা শেষ পর্যন্ত দক্ষিণা বাতাস পেতেই হুঙ্কার ছেড়েছেন। এককালের সমাজতন্ত্রের বিপ্লবীরা এখন স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘাড়ে ভর করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন আর সম্মুখে এসে কিছুই বলছে না। কারণ তাদের বলা কথা অতীতের বিপ্লবী বামরা গলায় হেঁকে বলে দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। আবার স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগে স্বাধীনতাবিরোধী খোলস ছেড়ে দিয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের স্লোগা দিয়ে প্রবেশ করেছেন। রাজনীতির এমন হতশ্রী অবস্থান দেখে বুঝাই যাচ্ছে দেশের রাজনীতিতে আদর্শের জায়গাটা এখন অনেক বেশি তলানিতে এসে ঠেকেছে। গ্রামেগঞ্জে, সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে বিএনপি বা স্বাধীনতাবিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খুব বেশি পার্থক্য করার মতো অবশিষ্ট কিছু নেই। সাম্প্রদায়িকতার ছড়াছড়ি সর্বত্র। একই পরিবারে ‘তৃদলীয় ঐক্যের’ নতুন রূপ সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। সবই ভেজাল। আদর্শের জায়গা খুব বেশি নেই। মুক্তিযুদ্ধের নাম একজন উচ্চারণ করলেও আরেকজন এর তাৎপর্য বুঝেন তার মতো করে। এমনটি এখন আর শুধু গ্রামেগঞ্জে নয় খোদ শহর তথা রাজধানীতেও। বলা যেতে পারে, না শিক্ষায়, না রাজনীতির প্রচারণায়, আধুনিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাষ্ট্রচিন্তা খুব বেশি স্থান করে নিতে পারেনি। মুখে অবশ্য এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা, কিংবা বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার কথা অনেকেই বলে বেড়ান। মূলত এটি করা হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, নিজের স্বার্থকে কীভাবে আদায় করে নিচ্ছেন তা বুঝা গেলেও বলা খুব কষ্টকর। চারদিকে আদর্শের অবনমন, সুবিধাবাদের উত্থান এতটাই ব্যাপক যে পশম বাঁচলে কম্বলের অস্তিত্বই বিপন্ন হওয়ার অবস্থা। এসব কথা বোধহয় কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু যারা প্রকৃতই আদর্শকে ধারণ করে এ সমাজ ও রাজনীতিতে এখনো টিকে আছেন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা ও অবস্থানে নেই, আছেন কৈইষ্ণু সংখ্যালঘুর বিপর্যস্ত অবস্থানে। কারণ স্রোত একেবারেই প্রতিক‚লে চলছে। অনেকের প্রতিক‚লে চলতে চলতে হারিয়ে গেছেন, অনেকে এখন আর পারছেন না, বসে পড়েছেন। তাদের সম্মুখেই দুর্নীতিবাজরা টাকার কুমির বনে যাচ্ছে, সমাজ ও রাজনীতিতে ‘কদর’ নিয়ে বুক ফুলিয়ে চলছে। গেল বছর ক্যাসিনো কাণ্ড নিয়ে একটা অভিযানে যাদের চেহারা দেখা গেল তাদের কাহিনী আলাদিনের চেরাগের গল্পকাহিনীর চাইতেও কম নয়। অথচ এরা আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদপদবি নিয়ে এমন অর্থবিত্তের মালিক হলেন। আওয়ামী লীগের অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে অন্যদের অবস্থা কি হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। সমাজের ভেতরটা কতটা নষ্ট হয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে রাজনীতি আমাদের সমাজ বিনির্মাণে শক্তি হিসেবে কাজ করার কথা সেই রাজনীতি অনেক আগেই আদর্শহীন, নেতৃত্বহীন চরিত্রের অধিকারীদের হাতে পড়ে দেশটাকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যেখান থেকে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কিংবা গণতন্ত্রের আদর্শের ধারায় পরিচালিত করা মোটের ওপর কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি তখন সমাজ ও রাজনীতির ভেতরের জটিলতম অনগ্রসরতা, পশ্চাৎপদতা, দুর্বলতা, স্ববিরোধিতা এবং দ্বিচারিতা কীভাবে দূর করা সম্ভব হবে, কীভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ও রাজনীতিতে নিষ্ঠাবান, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক মানুষরূপে গড়ে তোলা হবে সেই ধারণাই খুব একটা পরিষ্কার নয়। একইভাবে ২০২১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে তখন এই সমাজ ও রাষ্ট্র রাজনীতির ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কীভাবে কতটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যাবে সেই প্রস্তুতিও কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা যতই উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে শুনছি, কিন্তু উন্নত দেশ ও সমাজ গঠনের জন্য যে ধরনের আদর্শিক সমাজ ও রাজনীতি গড়ে তোলা দরকার, মানুষ হয়ে ওঠা দরকার তার কতটা আমরা হতে পারব কিংবা হওয়ার চেষ্টা করছি তা নিয়ে আমাদের মধ্যে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে বলে মনে হয় না। প্রস্তুতিরও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা আসলে সামনে কতটা নির্ভরভাবে এগোতে পারব তা নিয়ে সন্দেহ থাকলে বলার কিছু থাকবে কী? তবে এখনই যদি নিজেদের অবস্থানকে স্বচ্ছভাবে দেখার চেষ্টা করা যায়, সমাজ ও রাজনীতিতে শুদ্ধিতার উদ্যোগগুলো নেয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে বলে মনে করি না। প্রয়োজন সেই উদ্যোগটি শুরু করা। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App