×

অর্থনীতি

পুঁজিবাজারে আলোর রেখা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৫২ এএম

পুঁজিবাজারে আলোর রেখা
আলোর রেখা দেখা দিয়েছে পুঁজিবাজারে। দীর্ঘদিন হতাশায় থাকা বিনিয়োগকারীরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৬ নির্দেশনার পর গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার থেকে পতনের ধারা বেরিয়ে উত্থানের দেখা মেলে। গতকাল রবিবারও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে সূচকে বড় ধরনের উত্থান হয়। ছাড়িয়ে যায় ৭ বছরের রেকর্ড। এদিকে রবিবার পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা এবং তারল্য সংকট কাটাতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা চলতি সপ্তাহেই বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাবনা পাঠানোর কথাও বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ২৩২ পয়েন্ট বেড়ে ৭ বছরে সর্বোচ্চ উত্থান দেখা যায়। এর আগে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি দেশের প্রধান পুঁজিবাজারে নতুন এই সূচক চালু হওয়ার পর এত বড় উত্থান দেখা যায়নি। ডিএসইর পুরনো সূচক ডিজিইন থাকার সময় ২০১২ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি সূচক বেড়েছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এদিন সূচকের সঙ্গে লেনদেনও বেড়েছে দুই পুঁজিবাজারে। তবে বড় পতনের রেশ কাটিয়ে উঠতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের সংস্কার জরুরি। তাহলেই সামনের দিনগুলোতেও পুঁজিবাজারে ইতিবাচক ধারা বজায় থাকবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, ব্যাংকগুলোর সরব উপস্থিতি, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে যোগ দেয়ায় শেয়ার মার্কেট চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। আগামীতে শেয়ার মার্কেট ভালোর দিকে যাবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেয়ার মার্কেট নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার দেয়া নির্দেশায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনা ছিল, সরকারি লাভজনক কোম্পানি এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে লিস্টিংএ আনতে হবে। এ বিষয়টা যেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, কার্যক্রম কতখানি বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিয়মিত তদারকি করতে হবে। যদি তাই হয়; তাহলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হবে, শেয়ার মার্কেটেও সুদিন ফিরে আসবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি নেয়া উদ্যোগগুলো বাজারের পতন ঠেকাতে কিছুটা ভ‚মিকা রাখলেও বাজার সত্যিকার স্বাভাবিক করতে ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। নতুন বছরের শেয়ারবাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেয়া স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের ফলে বাজার কিছু সময়ের জন্য ইতিবাচক ধারায় ফিরবে। কারণ সরকারি ব্যাংক ও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু টাকা দিয়ে মার্কেটকে উঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এটি একটি সাময়িক উত্থান বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। যতদিন টাকাটা চলতে থাকবে, ততদিন মার্কেট ভালো থাকবে। এর মাঝে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না নিলে মার্কেট আবার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, বিএসইসিকে পুনর্গঠন না করলে স্থায়ী কোনো সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না। শেয়ার মার্কেটের উন্নয়ন তো আস্থার বিষয়, টাকার বিষয় নয়। ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দর অনেক কমে গিয়েছিল। এই অবস্থায় দুটি সুখবর এসেছে। একটি হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং আরেকটি হচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনবে। ফলে আস্থাটা ফিরে এসেছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যে বিক্রি করে দিচ্ছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। এ জন্য সূচক বাড়তে শুরু করেছে। মার্কেটের স্থায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, মার্কেট নিয়মিত বাড়তেই থাকবে এমনটা নয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাড়বে-কমবে। এটা মার্কেটের সৌন্দর্য (বিউটি)। এটাকে মেনে নিতে হবে। দেখার বিষয়, আতঙ্কিত হয়ে একত্রে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে কিনা। সেটা হলে মার্কেটের ক্ষতি হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা : বিদায়ী ২০১৯ সালের প্রায় পুরো সময়টাতেই পতনে ছিল দেশের শেয়ারবাজার। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এ খাতটি ইতিবাচক ধারায় ফেরাতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। বাজার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। যার ইতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়তে শুরু করেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠক থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশ নেয়া বাড়ানো, সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাসহ ৬টি নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও ব্যাংকবহিভর্‚ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশ নেয়া বাড়ানো; মার্চেন্ট ব্যাংকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা; আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানো; বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও দেশীয় বাজারে আস্থা সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এবং বাজারে মানসম্পন্ন আইপিও বাড়ানোর লক্ষ্যে বহুজাতিক ও সরকারি মালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তকরণের উদ্যোগ নেয়া। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। সরকারি ব্যাংকের অর্থায়ন : এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট নিরসনে সরকারি ৪ ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান। ওই নির্দেশনার পর সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের শীর্ষ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টেলিযোগাযোগ খাতের গ্রামীণফোনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইয়াসির আজমানকে নিয়োগ দিয়েছে টেলিনর কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংক-বিএমবিএ বৈঠক : সর্বশেষ গতকাল রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবনার বিষয়ে মন্ত্রণালয় যেসব তথ্য জানতে চেয়েছে তার ইতিবাচক তথ্য দেয়া হবে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম এবং বিএমবিএ এর সভাপতি ছায়েদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ মতিনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর, প্রাতিষ্ঠানিক ব্রোকারদের (ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান) পক্ষ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিলের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। প্রস্তাবনা অনুসারে, আলোচিত তহবিলের আকার হতে পারে ১০ হাজার কোটি টাকা। তহবিলের মেয়াদ হবে ৬ বছর। প্রস্তাবিত সুদের হার ৩ শতাংশ। প্রথম ২ বছর হবে গ্রেস পিরিয়ড। এ সময়ে তহবিল থেকে পাওয়া অর্থ ফেরত দিতে হবে না। পরবর্তী ৪ বছরে তা সুদ-আসলে ফেরত দেয়া হবে। প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়, শুধু সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগের জন্য এই তহবিল থেকে ঋণ সুবিধা দেয়া হবে। আর এই সুবিধা ব্রোকারহাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ সব মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App