×

মুক্তচিন্তা

চেতনার ভেতর-বাহির

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৩৫ পিএম

বিদ্যমান ব্যবস্থা বদল ব্যতীত যে কিছুই বদলানো সম্ভব হবে না, এটা অতীব সত্য কথা। আমরা আমাদের তাৎপর্যপূর্ণ দিবসের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হতে পারব তখনই যখন ওই দিনগুলোর সুফল ও প্রাপ্তির অংশীদার হতে পারব। প্রকৃত বিজয়ী বেশে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে নিজ মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারব। আমাদের সামষ্টিক জীবনাচারে সম্পৃক্ত হতে পারবে প্রতিটি জাতীয় অর্জনসমূহ।
জাতীয়ভাবে চারটি দিবসকে কেন্দ্র করে চারটি মাসকে যথাক্রমে বিজয়ের মাস, ভাষার মাস, স্বাধীনতার মাস এবং শোকের হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং নানা কর্মসূচিও পালিত হয়ে থাকে। ওই চার মাসের প্রতি মাস এলেই মাসব্যাপী নানা আয়োজন-আনুষ্ঠাকিতা পালিত হয়, জাতীয়ভাবে এবং সামাজিকভাবেও। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও সম্প্রচারে নেমে পড়ে ওই মাসকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠান আয়োজনে। দিবসগুলোর বিষয়ভিত্তিক রচনা-নিবন্ধ, বিবরণ প্রকাশ করে সংবাদপত্র। এসব আয়োজন আনুষ্ঠানিকতায় কোনো খামতি থাকে না। সামাজিক জীবনেও এর প্রভাব বহুমাত্রিক। কিন্তু দিবসগুলোর প্রাপ্তিযোগ সামষ্টিক নয়। কতিপয়ের। এটাও অসত্য নয়। ভাষার মাস আসন্ন। ভাষার মাস এলে দেশজুড়ে মাতৃভাষাকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। সাংস্কৃতিক কর্মসূচি, বইমেলা, আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রবন্ধ, নিবন্ধ পাঠ ও প্রকাশ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকরা এই মাসকেই বেছে নেয়। মাতৃভাষার প্রতি অমন উচ্ছ্বাস বিশ্বের অপরাপর জাতির ক্ষেত্রে তেমন একটা দেখা যায় না। মাতৃভাষার প্রতি এই সীমাহীন আবেগ-ভালোবাসা প্রকাশ বিশ্বের তাবৎ জাতির ক্ষেত্রে বিরলই বলা যায়। মাসজুড়ে মাতৃভাষা নিয়ে উৎসব-আনুষ্ঠাকিতা প্রকাশ পেলেও মাতৃভাষার সর্বত্র ব্যবহার আজো নিশ্চিত হয়নি। এখনো ঔপনিবেশিক ভাষার-চর্চা রাষ্ট্রীয় অনেক ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে। মাতৃভাষা সেখানে প্রবেশের সুযোগ আজো পায়নি। তাই মাতৃভাষা নিয়ে বাগাড়ম্বর যতটা দৃশ্যমান তার সর্বজনীন ব্যবহার কিন্তু ততটা মোটেও নয়। বিশেষ করে উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তিন ধারার শিক্ষাক্রম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মাতৃভাষা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিত্তবান, মধ্যবিত্তরা ছুটেছে ইংরেজি মাধ্যমের অভিমুখে। অপরদিকে দরিদ্র শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে অজস্র আরবি ভাষাভিত্তিক মাদ্রাসা। ওদিকে মাধ্যমিক স্তরের মান ও মর্যাদা ক্রমাগত নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার শিক্ষাক্রম যেমন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তেমনি বিশ্বায়নের প্রভাবে চরম প্রতিক‚লতার মুখেও পড়েছে। তাই ভাষার মাসের সঙ্গে বাস্তবতার ভিন্নতা যেমন প্রকট তেমনি বিপরীত। বিশ্বায়ন, ক্যাবল টিভির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আমাদের ভাষা সংস্কৃতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। পশ্চিম বাংলায় হিন্দি ভাষার দাপটে তো বাংলা ভাষা সেখানে আঞ্চলিক ক্ষুদ্র-স্তরের ভাষায় পরিণত হয়ে পড়েছে। ওখানকার বাঙালিরা নিজেদের বাঙালি জাতি হিসেবে পর্যন্ত বিবেচনা করে না, ভারতীয় জাতি বিবেচনায় বাংলা ভাষাকে ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। সেখানে বর্তমানের বাংলা গান, চলচ্চিত্র, নাটক, সাহিত্যের দুর্দশাই সেটা প্রমাণ করে। ওই হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির আধিপত্য ক্যাবল টিভির মাধ্যমে আমাদের ঘরে ঘরেও ঢুকে পড়েছে। আমরাও যে ওই সংকটের ভেতরে ঢুকে পড়েছি, সেটাও অসত্য নয়। ভাষার মাসে আমাদের মাত্রাতিরিক্ত আবেগ-উচ্ছ্বাসের বিষয়টি পুরোপুরি বাহ্যিক, অন্তর্গত নয়। নয় চেতনাগতও। তাই বাহ্যিক প্রকাশ আর চেতনাগত দিকটি কেবল ভিন্নই নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত। ডিসেম্বর মাসকে আমরা বিজয়ের মাস হিসেবে অভিহিত করি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণের মধ্য দিয়ে আমাদের ভূখণ্ডের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটেছে। ওই দিনটি বিজয় দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। বিজয়ের মাসজুড়েও একই চিত্র আমরা দেখে থাকি। গণমাধ্যম, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি থেকে সামাজিকভাবেও আড়ম্বরতায় পালিত হয় মাসটি। অথচ ওই বিজয়ে সমগ্র জাতির আশা-আকাক্সক্ষার বিজয় ঘটেছে সেটা কিন্তু বলা যাবে না। বিজয় নিশ্চয় কারো কারো ক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু সমষ্টিগতদের ক্ষেত্রে যে হয়নি এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছেই আত্মসমপর্ণে রাজি হয়েছিল। বাংলাদেশের কাছে নয়। তাদের সেই দাবি অনুসারেই জেনারেল অরোরার কাছে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছিল। সান্ত¡নাস্বরূপ যৌথবাহিনীর কথা উল্লেখ থাকলেও আমাদের সর্বাধিনায়ক আত্মসমর্পণ স্থলে ছিলেন অনুপস্থিত। বিজয়ের ওই ক্ষণেই পরাজয় ঘটেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর। কিন্তু বিজয়ের ওই স্মারকে আমাদের বিজয় আমরা পুরোপুরি দাবি করতে পারি কিনা সে প্রশ্নেরও কিন্তু ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে। অতি দ্রুত সময়ে মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে আমাদের বিজয় লাভ সম্ভব হয়েছিল। তবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-আত্মত্যাগ, অসীম সাহসী গৌরব গাথা ম্লান হওয়ার নয়। পাকিস্তানের ভারত আক্রমণই ভারতীয় বাহিনীকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর আগে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত নানা কায়দায় আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের তটস্থ করে তুলেছিল। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদারদের নাকাল করে তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের ঘোষণায় উল্লেখ ছিল স্বাধীন দেশের শাসনতান্ত্রিক তিন প্রধান স্তম্ভের কথা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীনতার পর ওই তিন স্তম্ভের বিনাশের কথা আমরা সবাই জানি। একে একে পরিত্যক্ত হয়েছে প্রতিটিই। কার্যকর থাকেনি কোনোটি। বিজয় দিবস পালন আর বিজয়ীবেশে থাকা যে এক নয় এই সত্যটি বাংলাদেশের আপামর জনগণ প্রতিনিয়তই অনুধাবন করছে; ভোগ করছে বিজয়ী জাতির পরাজিত জীবন। মার্চ মাসব্যাপী স্বাধীনতার মাসের অজস্র অনুষ্ঠানাদির আধিক্য দেশজুড়ে লক্ষ করা যায়। আমাদের স্বাধীনতা যেসব মানুষকে স্বাধীন করেছে সেটা বলা যাবে না। আমাদের মোট জনসমষ্টির ক্ষুদ্র অংশ অর্থাৎ আমাদের শাসকশ্রেণির অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত হলেও সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত হতে পারেনি। তাই স্বাধীনতার মাস ঘিরে নানা আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতার উৎসব সমষ্টিগতদের চেতনায় ও হৃদয়ে স্পর্শ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক স্তরেও আড়ম্বর অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতার সুফল সামষ্টিক মানুষদের থেকে যোজন যোজন দূরত্বে। বিপরীতে বিজাতি-শাসকদের স্থলে স্বজাতির-শাসকদের শোষণ-নিপীড়ন, লুণ্ঠন অব্যাহত গতিতে চলছে, অতীতের ধারাবাহিকতায়। এই স্বাধীনতা কেবলই স্বাধীন ভূখণ্ড আর কতিপয়ের স্বাধীনতায় সীমিত, এটাই বাস্তবতা। স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে পালিত হয় হরেক আয়োজন-অনুষ্ঠান। গণমাধ্যমও দিবসটিকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন করে থাকে। সামগ্রিকভাবে উৎসব প্রিয় আমরা অতিউৎসাহী হয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। স্বাধীনতার স্বাদ-সুফল না পেলেও নিরানন্দ জীবনের ক্লান্তি ঘোচাতে উৎসবে জড়িয়ে যাই। পরাধীনতার দীর্ঘমেয়াদে স্বাধীনতার প্রকৃত অধিকারের বিষয়টিও অনুধাবনে ব্যর্থ হই। সব মানুষের সমঅধিকার ও সুযোগের সাম্যই যে স্বাধীনতা, এই সত্যটি আমাদের কাছে অধরা থেকেছে যুগ-যুগান্তরব্যাপী। অথচ স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই সব মানুষের সুফল-প্রাপ্তি ও অধিকার নিশ্চিত করবে। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি। ১৫ আগস্ট আমাদের শোকের দিন। আগস্ট মাসকে আমরা শোকের মাস হিসেবেই অভিহিত করি। ঘৃণিত সেই নৃশংস ঘটনাকে আমরা অবশ্যই ধিক্কার জানাই। আগস্টজুড়ে গণমাধ্যমে নানা আয়োজন থাকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন শোক দিবস এবং শোকের মাস পালিত হলেও অপর কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে শোক দিবসটি বাতিলও হয়ে যায়। ওই ঘৃণিত ঘটনায় অভিযুক্ত ক’জনের শাস্তি হলেও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। দিনটিকে কেন্দ্র করে বাস্তবে আমরা কি দেখে থাকি! শোকের দিসবটি শোক জ্ঞাপনের বিপরীতে খাদ্য-উৎসবে পরিণত হয়, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ নিয়ে নানা গুঞ্জন থাকলেও দিবসটিকে গভীরভাবে আত্মান্বেষণ করা এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান-গবেষণা করে ঘটনার নেপথ্য কারণসমূহ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় না। ঘটনাটি কতিপয় ঘটিয়েছিল বলা হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্যরা তবে কী করেছিল? তাদের বিতর্কিত ভ‚মিকা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথে না গিয়ে খাদ্য-বিতরণের উদ্বোধনে নেতা-মন্ত্রীদের সরব অংশগ্রহণ এবং সীমাহীন তৎপরতা দেখা যায়। বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করলেও শোকের দিনটিকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড আমরা দেখি না। বিদ্যমান ব্যবস্থা বদল ব্যতীত যে কিছুই বদলানো সম্ভব হবে না, এটা অতীব সত্য কথা। আমরা আমাদের তাৎপর্যপূর্ণ দিবসের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হতে পারব তখনই যখন ওই দিনগুলোর সুফল ও প্রাপ্তির অংশীদার হতে পারব। প্রকৃত বিজয়ী বেশে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে নিজ মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারব। আমাদের সামষ্টিক জীবনাচারে সম্পৃক্ত হতে পারবে প্রতিটি জাতীয় অর্জনসমূহ। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App