×

মুক্তচিন্তা

পেছাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন, ইতিবাচক সিদ্ধান্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ১০:২১ পিএম

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আদালতে নানা রকমের মামলা-মোকদ্দমা রুজু হলেও সাধারণ মানুষের অনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মতো ঘটনা বিরল। অবশেষে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসছে, এটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে ‘অতি উৎসাহী’ আমলারা বিরত থাকবেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও স্বপ্ন অভিযাত্রার পথকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে নিজেদের সংযত রাখবেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনার অনন্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ কোথা থেকে কোথায় এসে উন্নীত হয়েছে তা অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করেন। সাধারণ মানুষও প্রাত্যহিক জীবনযাপন ও দৈনন্দিনের চলাফেরায় তাদের জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো হরহামেশাই টের পান। টের পান অভাব-অনটনের বাংলাদেশ, দারিদ্র্যের শতচ্ছিন্ন বাংলাদেশ, পরনির্ভরশীলতার হীন মানসিকতার বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ ভিন্ন এক উচ্চতায় উঠে এসেছে। এ দেশের মানুষ ভিন্ন এক অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব জননেত্রী শেখ হাসিনার হলেও, উন্নয়নের মহাসড়কে পরিচালিত করার সব দিকনির্দেশনা শেখ হাসিনার হলেও, বাংলাদেশকে এরূপ একটি ‘ভিন্ন’ বাংলাদেশে উন্নীত করতে এ দেশের সব মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। সব মানুষের উন্নয়নের স্বপ্নকে জননেত্রী শেখ হাসিনা একত্রিত করে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার সাহস জুগিয়েছেন। সব পেশার মানুষের সম্মিলিত এবং সাহসী প্রয়াসে বাংলাদেশ আজ পার্শ্ববর্তী অনেক রাষ্ট্রকে পশ্চাতে ফেলে উন্নয়ন সূচকেই কেবল নয় স্পষ্টত এবং দৃশ্যযোগ্যভাবেই এগিয়েছে উন্নতির লক্ষ্যে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের এই অভিযাত্রায় অগ্রসরমান করছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের মানুষ। সুতরাং সব কাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মহান সংবিধানও সব নাগরিকের সমান অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সব কার্যক্রম এমনভাবে নিষ্পন্ন হওয়া উচিত, যাতে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ তার সুবিধা-অসুবিধা সমানভাবেই ভোগ-উপভোগ করতে পারে। কিন্তু অনেক সময় আমাদের দেশের কোনো কোনো প্রশাসন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে না। অনেক সময় আবার অবহেলা ও তাচ্ছিল্যজ্ঞানও করে থাকে। কিংবা কখনো কখনো আবার ‘অতি’ উৎসাহে অঘটনও ঘটিয়ে ফেলে। এতে করে বাংলাদেশে বিদ্যমান অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে তাদের এক প্রকার আমলাতান্ত্রিক গোয়ার্তুমিকেই আশ্রয় করে বসে থাকেন যুক্তি প্রস্তুত করতে থাকেন হাজার হাজার! সাম্প্রতিককালের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে এমনই এক বিতর্কিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সরস্বতী পূজার দিন দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করায় এবং বিভিন্ন বলয় থেকে দাবির পর নির্বাচনের তারিখ পেছানো হয়েছে। পরিবর্তিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের আগের তারিখ নিয়ে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে সর্বত্রই বিরূপ আলোচনা হয়েছে। আমাদের জানামতে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের ক্যালেন্ডার থাকে। সেসব ক্যালেন্ডারে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিনক্ষণেরও বিবরণ থাকে। কিন্তু তা সত্তে¡ও কেন নির্বাচন কমিশন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি আনন্দ উৎসবের দিনে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করল তা বোধগম্য নয়। তারা সংখ্যালঘু বলে তাদের প্রতি এই অবহেলা? তাহলে মানুষ হিসেবে সব ধর্মের, সব বর্ণের সাম্যতা কীভাবে বজায় থাকে, আমরা তা বুঝি না। বুঝি না বাংলাদেশে সংবিধান কি কেবল লিখিত শাস্ত্রগ্রন্থ আর কাজের বেলায় আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে সব ‘ম্যানেজ’ করা আমলাদের দায়িত্ব? আমলাদের এসব অহেতুক গোয়ার্তুমির ফলে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাফল্য অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়। কেননা শেষ পর্যন্ত সব কাজের ভার নানা অলিগলি পার হয়ে সরকারের ওপর তথা জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপরই বর্তায়! বাংলাদেশে নির্বাচন একটি আনন্দময় ঘটনা। নির্বাচনের সময় মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনার সীমা থাকে না। আর এরূপ একটি আনন্দজনক ঘটনাকে ধর্মীয় কারণে বর্জনের ঘোষণা কতটা মর্মান্তিক, যারা এই ঘোষণাটি দিয়েছেন তারা বুঝেন। এখনো এই দেশটিতে মুসলান হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের পারস্পরিক সহমর্মী অবস্থান বিদ্যমান আছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক যে বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয়েছে তার মূলোৎপাটনে সরকারের ভেতরকার কিছু নির্বাহী ব্যক্তি কাজ করে যাচ্ছে বলে আমাদের সন্দেহ ঘনীভ‚ত হয়। আমরা মনে করি তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষের বলয় থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের আহ্বান করেছেন। অপরদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিও তারিখ পরিবর্তনের পক্ষে। নতুন করে নির্বাচনের দিনক্ষণ পরিবর্তনের ফলে মহাভারত অশুদ্ধির মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না। এ ছাড়া ধর্মীয় উৎসবের কারণে ইতোপূর্বেও নির্বাচনের দিনক্ষণ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত ছিল। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাই এসব তথ্য দিয়েছেন। জানা যায়, জাতীয় সংসদের পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ১৯৯১ সালের ২ মার্চ ঘোষিত হলেও সে বছরের সেই দিনটি শবেবরাত থাকায় ভোটগ্রহণের দিনক্ষণ এগিয়ে এনে ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছিল। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তফসিল পরিবর্তনের ইতিহাস আছে যা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় উৎসবের কারণে। কিন্তু এবারকার নির্বাচন কমিশন তারিখ পরিবর্তন না করার জন্য কেন এত ‘আদাজল’ খেয়ে লেগেছেন তা বুঝা মুশকিল। তারা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর যুক্তি দেখিয়ে তাদের সিদ্ধান্তে অটল অবস্থায় ছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে আসছে। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, সব ধরনের সরকারি অফিসে সাধারণ ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি নানা রকমের দিনপঞ্জিকাও থাকে বলে আমরা জানি। তাহলে নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের আগে তারা পঞ্জিকার পাতাগুলো উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখলেন না কেন সেও এক বিরাট প্রশ্ন। যদি তারা দিনপঞ্জিকা এবং এসএসসি পরীক্ষার সূচি সামনে রেখে ভোটগ্রহণের তারিখ ঘোষণা করতেন তাহলে অহেতুক নানা বিতর্কের হাত থেকে সহজেই পরিত্রাণ লাভ করতে পারতেন। নির্বাচন কমিশন সচিব এই বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, একই দিনে স্কুল-কলেজে ভোটকেন্দ্রের একটি কক্ষে ভোটগ্রহণ চলবে এবং অন্য কক্ষে পূজার অনুষ্ঠানও চলবে। নির্বাচন কমিশন সচিব তথা বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নিয়ে গর্ব করা ব্যক্তিরা অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে, ধর্মীয় উৎসব পালন সম্পর্কে এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিতেই পারেন! কারণ তারাই সুকৌশলে বাংলাদেশ ভ‚খণ্ড থেকে ক্রমে ক্রমে ‘অসাম্প্রদায়িক’ চেতনার গায়ে কুঠারঘাত করেছেন। নির্বাচন কমিশন সচিবের এ জাতীয় ঘোষণা বা বক্তব্য ভিন্ন ধর্মকে অবহেলার শামিল। কারণ এ বক্তব্যে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে অত্যন্ত খাটো করে দেখার প্রয়াস প্রকাশিত হয়েছে। যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার চরম পরিপন্থি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চার মৌলনীতির বিরোধী। তার এ ধরনের বক্তব্য ধর্মীয় অবমাননার মধ্যে পড়ে এবং ধর্মীয় অবমাননার দায়ে সাধারণ নাগরিকের মতো তারও আইনের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো একটি আনন্দঘন নির্বাচনকে তিনি এমন বিতর্কিত করে তুলেছেন। তার এই ঘোষণার ফলে একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্রছাত্রীরা অনশনের মতো কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আদালতে নানা রকমের মামলা-মোকদ্দমা রুজু হলেও সাধারণ মানুষের অনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মতো ঘটনা বিরল। যাক, অবশেষে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসছে, এটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে ‘অতি উৎসাহী’ আমলারা বিরত থাকবেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও স্বপ্ন অভিযাত্রার পথকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে নিজেদের সংযত রাখবেন। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App