×

মুক্তচিন্তা

জগৎজ্যোতি দাস : হাওরের বীরশ্রেষ্ঠ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০৭:১৪ পিএম

বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। টেকের ঘাট হাওরের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হয়। অন্যদিকে আমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম তারা নেত্রকোনার মহেশখোলায় জমায়েত হই। জগৎজ্যোতিকে নিয়ে লেখাটির পরের অংশ শুরু হয়েছে এভাবে- নিষ্ঠুরের মতো ইলিয়াসের ঘোর ভাঙেন হাসান মুর্শেদ। প্রশ্ন করেন, তারপর কী হলো ইলিয়াস ভাই? ইলিয়াস বলেন, সেই অসম্ভব যন্ত্রণার গল্প।

\ দুই \ বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতির আত্মাহুতির প্রেক্ষিত জানতে হলে যে এলাকায় তিনি যুদ্ধ করেছেন সেই এলাকাটি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পেতে হবে। হাওর এলাকাটি হিন্দু প্রধান। প্রধানত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বসবাস ওই এলাকায়। ঐতিহ্যগতভাবে এলাকাটি বাম রাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত। ১৯৭০ সালে আমার নির্বাচনী এলাকায় ন্যাপের কুঁড়েঘর প্রতীকের প্রার্থী ছিল। যদিও তিনি জিততে পারেননি তবুও পাশের থানা শাল্লা-দিরাইতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নৌকা মার্কা ছাড়াই জিতে এসেছিলেন। জগৎজ্যোতির যুদ্ধের এলাকা ছিল সুরঞ্জিত বাবুর সেই এলাকা। এটি একাত্তর সালে যেমনি সুবিধার বিষয় ছিল তেমনি অসুবিধারও ছিল। সুবিধাটি হলো আমরা শতভাগ মানুষের সমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। অসুবিধা ছিল ওই এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীই পাকিস্তানিদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একদিকে সমগ্র জনগোষ্ঠীর আদরে থাকতাম অন্যদিকে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা- তাদের সম্পদ রক্ষা করা। আমরা প্রায় পুরো হাওর এলাকাটিকে রক্ষা করতে পারলেও শাল্লা থানাটিকে রক্ষা করতে পারিনি। এর প্রধানতম কারণ ছিল শাল্লা-দিরাইয়ের সরাফত-খালেক চেয়ারম্যানের রাজাকার বাহিনীর অবর্ণনীয় অত্যাচার, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। হাওর এলাকার আর কোনো থানায় এত বড় ক্ষতি হয়নি। এত মানুষের ঘর-সম্পদ আর কোথাও পোড়ানো হয়নি। তবে প্রাণহানির বড় ঘটনা ঘটেনি এজন্য যে, হিন্দু গ্রামবাসীরা তাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। হাসান মুর্শেদ নামক একজন জগৎজ্যোতির ওপর একটি বই লিখেছেন। বইটি আমি পাইনি। তবে এর অংশ বিশেষ একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হাসান মুর্শেদের কাছ থেকে জগৎজ্যোতির যুদ্ধের ইতিহাসটি নিচ্ছি। আসুন একটু যুদ্ধের শুরুর বিবরণটি পাঠ করি। ‘সেদিন জগৎজ্যোতির দলটা ছিল ৪২ জনের। খালিয়াজুড়ির কল্যাণপুর (আমার পাশের গ্রাম) থেকে কয়েকটা নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটার মূল অপারেশন ছিল আজমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উড়িয়ে দেয়া। যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধা সুবল দাসের দলকে সাহায্য করার জন্য ঘুঙ্গিয়ারগাঁও, শাল্লায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে গুলিবিনিময় করেছে জ্যোতির দল। সেখান থেকে ভোরে রওনা হয়ে সকাল ৯টায় ইউনিয়ন অফিসের সামনে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের নৌকা, তেলাপোকাগুলো নিরীহ জেলেদের নৌকা আটকে লুটপাট করছে। এক জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে আকুল স্বরে অনুনয় করল ও দাসবাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান।’ তৎক্ষণাৎ আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার মারা যায় সেখানেই। বাকিরা দুই নৌকায় ইঁদুরের বাচ্চার মতো পালিয়ে আসতে থাকে। জ্যোতি বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে বারোজন সঙ্গে নিয়ে তাড়া করেন সেই পলায়নপর তেলাপোকাগুলোকে। অন্যরা তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, জগৎজ্যোতি ধমক দিয়ে বলেছেন, কয়টা রাজাকার ধরতে সবার আসার কী দরকার? নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে শুকনো বিল পেরিয়ে তেলাপোকাগুলো পালিয়ে যায় জলসুখার দিকে। জলসুখা জ্যোতির গ্রাম। নাড়িপোতা ঠিকানা। কিন্তু জ্যোতি তখন অপারেশনে, তাই কাছে এসেও ফিরে যান। যাওয়ার সময় মর্টারের রেঞ্জে কাছাকাছি এক রাজাকারের বাড়িতে মর্টার শেলিং করে ওরা। ফেরার সময় হঠাৎই পাল্টে যায় সবকিছু। হঠাৎ চায়নিজ রাইফেলের গুলির আওয়াজ ভেসে আসে অনতিদূর থেকে। চায়নিজ রাইফেল পাকিস্তানিদের অস্ত্র, রাজাকারদের কাছে চায়নিজ রাইফেল থাকার কথা নয়। ওদের দৌড় বন্দুক পর্যন্তই। বিলের কাছে আসার পর ওরা দেখে, একদিকে আজমিরীগঞ্জ, অন্যদিকে শাল্লা ও মার্কুলির দিক থেকে গানবোটে করে পাকিস্তানি আর্মিরা এসে নদীর পাড়ে পজিশন নিচ্ছে। ঠিক উল্টোদিকের বদলপুরেও গুলির আওয়াজ। রাজাকারগুলো ছিল আসলে ঘুঁটি, ওদের টোপ হিসেবে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে পাকিস্তানিদের ত্রাস দাস পার্টিকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তান আর্মি। সুপ্রশিক্ষিত হিংস্র পাকি হায়েনাগুলো এতদিন রোম ওঠা নেড়িকুকুরের মতো সকাল-বিকেল মার খেয়েছে দাস পার্টির দুর্ধর্ষ গেরিলাদের হাতে, আজ তারা আটঘাট বেঁধেই এসেছে। দুদিক থেকেই পাকিস্তান আর্মি পজিশন নেয় নদীর পাড়জুড়ে আর জ্যোতির দলের ১২ জন পজিশন নেয় নদী আর শুকনো বিলের মাঝে। দূরত্বটা এতই কাছে যে, পাকি জওয়ানদের পজিশন নেয়ার জন্য অফিসারদের দেয়া উর্দু কমান্ডও শুনতে পাচ্ছিলেন জগৎজ্যোতিরা। জ্যোতি আর তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ইলিয়াস সামনের কলামে, দুজনের হাতেই মেশিনগান আর দুই ইঞ্চি মর্টার- এরপরের সারিতে মতিউর, রশিদ, আইয়ুব আলী, বিনোদ বিহারী বৈষ্ণব, ধন মিয়া, কাজল, সুনীল, নীলু, কাইয়ুম ও আতাউর। বিপরীতে অগুনতি পাকিস্তানি সেনা। যুদ্ধ শুরু হলো সামনাসামনি। মাত্র ১২ জন যোদ্ধা নিয়ে নিতান্তই এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত জগৎজ্যোতির কণ্ঠ চিরে হঠাৎ বেরোয় এক অদ্ভুত উৎসাহের কথা, ‘চল, আজ শালাদের জ্যান্ত ধরবো, একেবারে হাতেনাতে’। মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে অকুতোভয় দুঃসাহসে যুদ্ধ করে যাওয়া ছোট্ট দলটায় তবুও ছোবল দিতে আপ্রাণ চেষ্টায় মাতে। আইয়ুব আলীর মাথায় গুলি লাগে, তাকে দুজনের জিম্মায় দিয়ে পিছিয়ে বদলপুরের দিকে পাঠিয়ে দেন জ্যোতি। ভয়ঙ্কর একপেশে সে যুদ্ধে একটু পর আহত হন আরেক মুক্তিযোদ্ধা। মাথার ওপর চক্কর দিতে থাকে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফগার, শিকারি হাউন্ডের মতো। ওদিকে বদলপুরে থাকা মূল দলের বাকি ৩০ জনকে আটকে রাখে পাকিস্তানিদের আরেকটি দল। কোনো সাহায্য পৌঁছায় না জ্যোতির দলের কাছে, দলের মাথাটা বাগে পেয়েছে আজ পাকিস্তানিরা, কেটে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় তারা। ক্রমশ কঠিন হয়ে যাওয়া যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন, ‘দাদা, কী করব?’ নির্মোহ গলায় জ্যোতি শান্ত জবাব, ‘তোর যা খুশি কর।’ কমান্ডার যেন বুঝতে পেরেছিলেন এটাই তার শেষ যুদ্ধ। শেষ যুদ্ধ পরিচালনার ভার তাই প্রিয় সহযোদ্ধার কাঁধে দিয়ে জ্যোতি মন দেন নিখুঁত নিশানার দিকে। ফুরিয়ে আসতে থাকে গুলি। ইলিয়াস বিনোদ বিহারীসহ আরো দু-তিনজনকে পাঠান বদলপুর থেকে যেভাবেই হোক গুলিসহ রসদ আনার জন্য। বেলা সাড়ে তিনটায় হুট করে গুলি লাগে ইলিয়াসের বুকের বাম পাশে। হাত দিয়ে দেখেন, কী আশ্চর্য, হৃদপিণ্ড ভেদ না করেই গুলি বেরিয়ে গেছে যেন কীভাবে। মাথার গামছা খুলে বুকের ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে দিতে জ্যোতি জিজ্ঞেস করেন, ‘বাঁচবি?’ বুকে বুলেটের ক্ষত নিয়ে আহত ইলিয়াস জবাব দেন, ‘মনে হয় বাঁচতে পারি।’ কমান্ডার নির্দেশ দেন, ‘তবে যুদ্ধ কর।’ ১২ জন থেকে যোদ্ধার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় পাঁচজনে। একটু পরে স্রেফ ইলিয়াস আর জ্যোতি ছাড়া আর কারোর অস্ত্র থেকে গুলির শব্দ শোনা যায় না। এমনকি জ্যোতির এলএমজির গুলি সরবরাহকারীও নেই আর। মধ্য নভেম্বরের দীর্ঘ বিকেলের সেই ক্লান্ত সময়ে এক অসম্ভব যুদ্ধে লিপ্ত হন দুই যোদ্ধা। ইলিয়াস গুলি লোড করতে থাকেন আর জ্যোতি ১০০ গজ দূরে সারিবদ্ধ পাকিস্তানিদের গুলি করতে থাকেন অকুতোভয় তীব্রতায়। নিখুঁত নিশানায়, একটার পর একটা। মাথার ওপর দিয়ে তীব্র গর্জন করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানিদের একটার পর একটা গুলি। তাতে বাধা দিতে মাঝে মাঝেই মর্টার থেকে শেলিং করছেন তারা। মনে ক্ষীণ আশা, সন্ধ্যা হয়ে গেলে হয়তো পাকিস্তানিদের ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। হায়, সময় ওটুকু সময়ও দেয়নি সেদিন, সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আছে জ্যোতির মাথা ভেদ করে যায় এক আচমকা পাকিস্তানি বুলেট। গলা কাটা মহিষের মতো ছটফট করে জ্যোতির শরীর, ইলিয়াস জড়ায়ে ধরেন তারে, ডাকেন, ‘দাদা, ও দাদা’, জ্যোতি একবার মাথা তোলেন, মাথা পড়ে যায়। যাওয়ার আগে মাতৃভাষায় ¯্রফে দুটো ক্লান্ত শব্দ উচ্চারিত হয় পাকিস্তানিদের সীমাহীন আতঙ্ক আর ভয়ের কারিগরের কণ্ঠ থেকে, ‘আমি যাইগ্যা’ সেদিন কাঁদতে পারেননি, যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের কাঁদার নিয়ম নেই যে। ইলিয়াস কাঁদেন ৪৩ বছর পর, ২০১৫ সালের ২০ জুন, স্বাধীন মাটিতে সেদিনের সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, দাদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদেন দাদার জন্য, তার কমান্ডারের জন্য এ কান্না বড় শোকার্ত, তীব্র আর্তনাদের। এ কান্না হƒদয়ের গহীন ভেতরের, বড় যন্ত্রণার। যুদ্ধের পরের কথাগুলো আরো পরে পাঠ করতে পারা যায়। জগৎজ্যোতির শহীদ হওয়ার ছোট ইতিহাসটুকুর পরও আরো বলার আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। টেকের ঘাট হাওরের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হয়। অন্যদিকে আমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম তারা নেত্রকোনার মহেশখোলায় জমায়েত হই। জগৎজ্যোতিকে নিয়ে লেখাটির পরের অংশ শুরু হয়েছে এভাবে- নিষ্ঠুরের মতো ইলিয়াসের ঘোর ভাঙেন হাসান মুর্শেদ। প্রশ্ন করেন, তারপর কী হলো ইলিয়াস ভাই? ইলিয়াস বলেন, সেই অসম্ভব যন্ত্রণার গল্প। প্রিয় কমান্ডারের নিথর শরীর বিলের কাদা পানির ভেতর যতটা সম্ভব পুঁতে ফেলতে হয় তাকে, যেন শত্রুর হাতে এই বীরের কোনো অবমাননা না হয়। নিজের এসএমজিটার সঙ্গে তুলে নেন দলনেতার এলএমজিটাও। বুকে বাঁধা গামছা থেকে চুইয়ে পড়তে থাকা রক্ত উপেক্ষা করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পেছনে ফিরতে থাকেন ইলিয়াস। ইলিয়াসের চেষ্টাটুকু সফল হয় না। পরদিন সকালে লাশ কাদা পানির ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে। রাজাকার তেলাপোকাগুলো বেরিয়ে আসে তখন, টেনে-হিঁচড়ে লাশটা নিয়ে আসে তাদের ঘাঁটিতে। তারপর জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে লাশের সামনে টেনে আনলো ওরা। পাথরের মতো পাষাণ হয়ে মা বললেন, এই লাশ তার জ্যোতির না, জ্যোতির বাম হাতে একটা আঙ্গুল বেশি। কেন জ্যোতির মা সন্তানের লাশকে অগ্রাহ্য করেছিলেন? মা হয়ে কীভাবে এ সাহস করলেন তিনি? তিনি কি তখন তার স্বামী আর বেঁচে থাকা অপর সন্তানের জীবন বাঁচানোর কথা ভাবছিলেন? জানা যাবে না আর কখনই। মারা গেছেন তিনি ক’বছর আগে।

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App