×

মুক্তচিন্তা

গরম ট্রাম্প হঠাৎ নরম হলেন কেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০৭:০৬ পিএম

মার্কিনিরা ১৯৭৯ সালের ৫২ জন পণবন্দির কথা ভুলেনি। আজ হোক বা কাল হোক যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিশোধ নেবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরানের দখলে থাকা হরমুজ প্রণালির ৩০ মাইল জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ। ইউরোপের তেল ও গ্যাস লাইনের নিরাপত্তাও দরকার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এলে সেই সম্ভাবনা বাড়বে এবং তিনিই নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। ইরানের মোল্লাতন্ত্র এবার পিছুটান দিয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে।

ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হয়েছে স্বীকার করার পর হাজার হাজার ইরানি তেহরানের রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এতকাল তারা স্লোগান দিয়েছে, ‘ডেথ উইথ আমেরিকা’, এখন স্লোগান দিচ্ছে, ‘মোল্লাতন্ত্র নিপাত যাক’। জনতা ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনির পদত্যাগ দাবি করছে। তারা বলছে, শত্রু বাইরে কোথায়, শত্রু তো ঘরের ভেতরে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানিয়েছেন এবং তাদের ওপর পুলিশি অত্যাচার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়াচিং’। ইরানি পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছুড়ছে, এ ভিডিও ইতোমধ্যে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রাম্প আরো বলেছেন, ইরান আলোচনা করতে চাইলে তিনি বিবেচনা করবেন, কিন্তু ‘নো নিউক্লিয়ার ওয়েপন’ এবং ‘বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা চলবে না। মার্কিন প্রশাসন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সরকার পরিবর্তনের কথা ভাবছে না।

মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে বিশ্ব পরিস্থিতি এখন অনেক ঠাণ্ডা। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো গেছে। তবে দ্ব›দ্ব-সংঘাত শেষ হয়ে যায়নি। জেনারেল কাসেম সোলেমানি হত্যার পর ইরান বেশ ‘ফাও’ হুমকি-ধমকি দিয়েছে। এরপর যা ঘটেছে, তা অনেকের মতে ‘পাতানো খেলা’। ইরান ২২টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার এক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিল বলে জল্পনা রয়েছে; বলা হচ্ছে, তাই কেউ মরেনি, ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইরান বলেছে, সৈন্য মারা তাদের লক্ষ্য ছিল না। যদিও জনগণকে ধোঁকা দিতে ৮০ জন মার্কিন সৈন্য নিহত ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ভুয়া খবর প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ইরানের প্রপাগান্ডা ছাপিয়েছে। বিশ্বের কোনো মিডিয়া কোনো মৃত্যুর খবর দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর আরো ব্যাপক অবরোধ আরোপ করেছে। ইরানের ওপর ট্রাম্প যাতে পুনরায় আক্রমণ করতে না পারেন সেই লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেস একটি ‘নন-বাইন্ডিং’ বা ঐচ্ছিক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বলা হচ্ছে, জেনারেল সোলেমানি হত্যার পেছনে ভেতরের কারো হাত ছিল তাই সব মিসাইল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। তাই গরম ট্রাম্প হঠাৎ নরম হয়ে গেছেন। খবরের পেছনের খবরে ট্রাম্প খুশি হয়েছেন। তবে ট্রাম্পের নরম হওয়ার পেছনে মার্কিন ‘কংগ্রেস’ ও ‘সিনেট’ কার্যকরী ভ‚মিকা ছিল। ট্রাম্প গত ৮ জানুয়ারি সকালে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জবাবে অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। ট্রাম্প বলেছেন, ইরানি হামলায় মার্কিন বা ইরাকি কোনো সেনা হতাহত হয়নি। দৃশ্যত, ইরান পিছুটান দিয়েছে। এটা সবার জন্য ভালো। ট্রাম্প ওবামাকে একহাত নিয়ে বলেছেন, ওবামা ইরানকে যে অর্থ দিয়েছে, তা দিয়ে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বক্তব্যে সাবেক ছয়জন প্রেসিডেন্টকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলেছেন, ১৯৭৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা ইরানের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সহ্য করেছেন, আর নয়? ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, আমরা ইরানকে সামান্য অর্থ দিয়েছি। চোপের কাছে হার মেনে ইরান শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে যে, এর সৈন্যরা ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ ইউক্রেনের ১৭৬ যাত্রীবাহী বিমানটি ভ‚পাতিত করেছে। ইরান এটিকে ‘হিউম্যান এরর’ বলে অভিহিত করেছে। বিমানে ১৩০ জন ইরানি নাগরিক ছিলেন। ‘গাধা জল খায়, তবে ঘোলা করে’, ইরানের বেলায় তা-ই সত্য হলো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ১১ জানুয়ারি বলেছেন, ইরানকে যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংসের দায় বহন করতে হবে। টরেন্টোয় বাংলাদেশি সাংবাদিক সওগত আলী সাগর সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন, মার্কিন মিসাইল ভেবে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমানে ইরানিরা একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে, এরপর এটি ‘হিউম্যান এরর’ হয় কি করে? পূর্বাহ্নে জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, ইরান থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনের বিমান বিধ্বস্ত হয়। বিমানে ৬৩ জন কানাডীয় যাত্রী ছিল। ট্রাম্প বলেছেন, কেউ হয়তো ভুল করে থাকবেন। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কারণে বিমানটি ধ্বংস হয়েছে। ইরান এসব দাবি অস্বীকার করে এবং ব্ল্যাক বক্স ফেরত দেয় না?

 গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস নামের একটি নিউজ পোর্টাল বলেছে, ভুলক্রমে ১৭৬ জন হত্যা, ভাগ্য ভালো যে ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র নেই? ট্রাম্প তাই বলেছেন, ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হতে দেব না। ক্লারিয়ান প্রজেক্ট নিউজ পোর্টাল বলেছে, ইরানের প্রতিশোধ নাটক কি সাজানো ব্যর্থতা? মুখরক্ষার এই রাস্তা নিল ইরান? এটি আরো বলেছে, ট্রাম্পের কৌশল কাজ করেছে, ইরান পিছুটান দিয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতা নিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলে হামলা হলে ইরানের ওপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালাব। ভারত পারস্য উপক‚লে যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করেছে; বলেছে, সামুদ্রিক বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো রক্ষায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দিল্লিতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভারত যদি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতা করে ইরান তাতে সম্মত আছে। টাইম ম্যাগাজিন বলেছে, ট্রাম্পের বক্তব্য হচ্ছে, ইরান পিছুটান দিয়েছে। ইতিহাস বলে, বিষয়টি ততটা সহজ নয়! ইরাক তার ভূখণ্ড ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। ইরাক ভয় পাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতে ইসলামিক স্টেট (আইএস) না আবার ফিরে আসে? যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এক টুইটে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ লিখেছেন, ‘আমাদের জনগণ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর যে ঘাঁটি থেকে কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে আত্মরক্ষায় ইরান সেখানে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে এর সমাপ্তি টেনেছে। আমরা যুদ্ধ বা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। ইরান বলেছে তারা আর আক্রমণ করবে না!

রাজনৈতিক মহল বলছেন, নিহত জেনারেল সোলেমানি গত ৪০ বছর ইরানি নেতাদের ভুল বুঝিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রæ বানিয়ে রেখেছিল, তার মৃত্যুর পর দিন পাল্টাবে। মার্কিনিরা ১৯৭৯ সালের ৫২ জন পণবন্দির কথা ভুলেনি। আজ হোক বা কাল হোক যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিশোধ নেবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরানের দখলে থাকা হরমুজ প্রণালীর ৩০ মাইল জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ। ইউরোপের তেল ও গ্যাস লাইনের নিরাপত্তাও দরকার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এলে সেই সম্ভাবনা বাড়বে এবং তিনি নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। ইরানের মোল্লাতন্ত্র এবার পিছুটান দিয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে।

শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App