×

মুক্তচিন্তা

সিটি নির্বাচনের তারিখ নিয়ে নতুন করে ভাবা যায় না?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:৫৫ পিএম

সরকার এবং নির্বাচন কমিশন চাইলে ৩০ জানুয়ারি অবশ্যই নির্বাচন করতে পারবে। কোনো বিরোধিতাই আমলে না নেয়ার শক্তি-সামর্থ্য সরকারের আছে। তবে এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে এতে বঞ্চনাবোধ বাড়বে। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয়। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা কিছু না কিছু বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে। তবে দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। কারণ ওইদিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা। এই পূজা মূলত শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার আয়োজন হয়ে থাকে। তবে অনেক বাসাবাড়িতেও সরস্বতী পূজা হয়। বাড়ির মেয়েরা পূজা আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন। ঢাকা শহরে হিন্দু ভোটার সংখ্যা কত তা আমার জানা নেই। কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূজা হবে এবং এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভোটকেন্দ্র হবে কিনা, সে তথ্যও আমার কাছে নেই। তারপরও আমি মনে করি, সরস্বতী পূজার দিন ভোটের তারিখ নির্ধারণ করাটা ঠিক হয়নি। ভুলবশত যদি এটা করা হয়ে থাকে, তাহলে ভুল যখন নজরে আনা হলো, তখনই নির্বাচন কমিশনের ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের অনড় অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, তারা জেনেশুনেই এই তারিখ ঘোষণা করেছেন। তারা বিতর্ক পছন্দ করেন। বিতর্ক জিইয়ে রাখতে চান। এটা অন্যায় এবং অমার্জনীয় অপরাধ। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে গোয়ার্তুমি প্রত্যাশিত নয়। দেশে সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মুরোদ যাদের নেই, তারা নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এত গোঁ ধরে থাকেন কেন, সেটা বুঝতে কষ্ট হয়।

সরস্বতী পূজা নির্দিষ্ট দিনেই করতে হবে। কারো কাছে আর্জি জানিয়ে পূজার দিন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সিটি নির্বাচন কেন ৩০ জানুয়ারিতেই করতে হবে? ওইদিন নির্বাচন করার জন্য কমিশনকে মাথার দিব্যি দিয়েছে কে? নাকি ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচন না হলে আকাশ ভেঙে পড়ার কোনো আশঙ্কা আছে? ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি পরীক্ষার জন্য ভোট করার অসুবিধা আছে। তাহলে জানুয়ারির ২৮ তারিখ ভোট করলে কি অসুবিধা ছিল? বৃহস্পতিবারেই ভোট করতে হবে- এমন কোনো আইনি বিধিনিষেধ কি নির্বাচন কমিশনের ওপর আছে? যদি থাকে তাহলে ২৩ জানুয়ারি ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা যেত। ৩০ জানুয়ারি ভোট করার জেদ নির্বাচন কমিশনকে কেন পেয়ে বসল সেটা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এখন এ নিয়ে দেশে একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ছাত্র বিক্ষোভও চলছে। শাহবাগে পথ অবরোধ করে জনদুর্ভোগও হয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী ৩০ জানুয়ারির নির্বাচন পেছানোর দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছেন। এই আন্দোলনে ছাত্রলীগেরও সমর্থন আছে। নির্বাচনে দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীরাও সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধী। প্রশ্ন হলো, এতসব কিছু সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কেন এই বিষয়টি নিয়ে এত শক্ত অবস্থানে?

সরকার এবং নির্বাচন কমিশন চাইলে ৩০ জানুয়ারি অবশ্যই নির্বাচন করতে পারবে। কোনো বিরোধিতাই আমলে না নেয়ার শক্তি-সামর্থ্য সরকারের আছে। আর নির্বাচন কমিশন তো মহাক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। তারা পিঠে কুলো আর কানে তুলো দিয়ে কাজ করে। তবে এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে এতে বঞ্চনাবোধ বাড়বে। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয়। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা কিছু না কিছু বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে। তবে দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানে সংখ্যালঘুরাও সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতা আছে।

প্রশ্ন হলো, সরস্বতী পূজার দিন ভোটের তারিখ ঠিক করে কি হিন্দুদের ধর্মীয় আচার পালনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হলো না? বলা হবে, সরস্বতী পূজা সারাদেশে উদযাপিত হবে আর ভোট হবে শুধু ঢাকা মহানগরে। যারা ভোটার এবং পূজা করবেন তারা পূজা শেষেই ভোট দিতে যাবেন। আর ভোট যদি না-ও দেন তাতেই বা কী? সব ভোটার কি ভোটকেন্দ্রে যান? এই যে চট্টগ্রামে একটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন হলো, সেদিন তো কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল না, তারপরও তো ভোট পড়েছে ২৪ শতাংশের নিচে। কয়জন হিন্দু ভোট দিতে না পারলে ভোটের পবিত্রতা নষ্ট হবে না।

আসলে এটি একটি নীতির প্রশ্ন। দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচন করার কথা কেউ মাথায়ও আনবে না। কিন্তু সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে হিন্দুদের পূজা-পার্বণের বিষয়টিও যে বিবেচনায় রাখা দরকার সেটা আর মাথায় থাকে না। ধর্মীয় অনুভ‚তিটাও যে সব ধর্মাবলম্বীই আছে, সেটাও ভুলে যাওয়া হয়। এবার সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচন না করার দাবিতে আন্দোলনে নামাটাও কারো কারো কাছে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে মনে হচ্ছে। দুয়েকজন এটা নিয়ে অহেতুক ইস্যু তৈরি করাটাও পছন্দ করছেন। অবস্থা এমন যে, হিন্দুরা বা সংখ্যালঘুরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিটাও তুলে ধরতে পারবেন না। পূজা হলো ধর্মাচার। ভোট হলো গণতান্ত্রিক অধিকার। কোনোটা থেকেই নাগরিকদের বঞ্চিত করার সুযোগ রাষ্ট্র, সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নেই, থাকতে পারে না। সংখ্যালঘুদের দাবিয়ে রেখে, দমিয়ে রেখে সম্প্রীতির বয়ান দেয়াটা বেমানান।

দুই. ঢাকা দুই সিটির নির্বাচনী প্রচারণা জমে উঠেছে। ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণে মেয়র প্রার্থী বেশ কয়েকজন হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত নৌকা এবং ধানের শীষের মধ্যে। দক্ষিণে নৌকার প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। ধানের শীষের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। শেখ তাপস সংসদ সদস্য ছিলেন। পদত্যাগ করে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। তার নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়। তার বাবা শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির একটি আলোচিত নাম। আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। গত শতকের ষাটের দশকের অগ্রণী ছাত্র নেতা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যা করা হয়।

ব্যারিস্টার শেখ তাপসের সঙ্গে বিএনপি থেকে লড়ছেন ইশরাক হোসেন। তার বাবা সাদেক হোসেন খোকাও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন ঢাকার মেয়র। বিএনপির মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী নেতা। রাজনীতিতে নবাগত ইশরাক বাবার ইমেজ এবং বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি কাজে লাগিয়ে ভোট লড়াইয়ে জিততে চান।

ঢাকা উত্তরে নৌকা নিয়ে লড়ছেন ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম। তিনি এর আগে উপনির্বাচনে জিতে নয় মাস মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারও আগে তিনি ব্যবসায়ীদের সংগঠনেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার এক ভাই তাফাজ্জল ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আরেক ভাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম বিজিপির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। আতিকুল ইসলামের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের তাবিথ আউয়াল। তার বাবা দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু এক সময় আওয়ামী লীগ করতেন। ঢাকার মেয়র হওয়ার জন্য তিনি বিএনপিতে যোগ দেন বলে শোনা যায়। নিজের ইচ্ছা পূরণ না হলেও তার ছেলে তাবিথ আউয়াল ঢাকার অর্ধাংশের মেয়র হওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে লড়ছেন। তিনি আগের নির্বাচনে আনিসুল হকের সঙ্গে লড়ে মাঝপথে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন।

দুই সিটিতে মেয়র পদে এই চার প্রার্থীর মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। জয়-পরাজয় নির্ভর করবে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যদিও জয়ের ব্যাপারে চার প্রার্থীই আশাবাদী, তবে নানা হিসাব-নিকাশ, সমীকরণ-মেরুকরণ শেষ পর্যন্ত কার গলায় জয়ের মালা পরায় সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা কঠিন। যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, ভোটার উপস্থিতি স্বাভাবিক হয় তাহলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেই জয় ছিনিয়ে আনতে হবে।

তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান যে সম্ভব নয়- এটা প্রমাণ করার জন্যই তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেয়া হলেও তাতে আস্থা রাখতে পারছেন না অনেকেই। কারণ নির্বাচন কমিশনের অতীত রেকর্ড ভালো নয়। এবার ভোট হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে। বিএনপি মনে করছে, কারচুপি করার জন্যই এই যন্ত্রের সাহায্যে ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইভিএমে ভোট কারচুপি সম্ভব, কি সম্ভব নয়- তা নিয়ে বিতর্ক আছে। নির্বাচনের পর এই বিতর্ক বাড়বে, না কমবে দেখার বিষয় সেটা।

আমাদের দেশে এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে যে, যারা ভোটে হারে তারাই নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগ তোলে। সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে বিএনপি সেই ফল মানবে না এবং বলবে তাদের জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ কি হেরে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রমাণ দেবে? মনে হয় না। কেউ কেউ মনে করছেন, গত কয়েকটি নির্বাচনের চেয়ে ঢাকা সিটি নির্বাচন ভালো হবে। মুজিববর্ষে বিতর্কিত নির্বাচন করা থেকে সরকার বিরত থাকবে। আবার এমন মতও আছে যে, মুজিববর্ষ উদযাপন নিশ্চয়ই পরাজয় দিয়ে শুরু করতে চাইবে না আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগের টার্গেট যে কোনো মূল্যে ঢাকার দুই মেয়র পদ ধরে রাখা। যেমন নির্বাচন আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত করবে, তেমন নির্বাচনই হবে। প্রক্রিয়াটি কী বা কেমন হবে সেটা এখনই বলা মুশকিল। ভোটার উপস্থিতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তবে যাই হোক না কেন, ঢাকা সিটি নির্বাচন যে বিতর্ক মুক্ত হবে না, নির্বাচন কমিশন যে মানুষের মনে আস্থা তৈরি করতে পারবে না, ভোটের ব্যাপারে যে মানুষের আগ্রহ খুব একটা বাড়ার মতো অবস্থা তৈরি হবে না, সেটা এখনই বলা যায়।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App