পুঁজিবাজারের ধস পরবর্তী দশ বছর
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:৪০ পিএম
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারের ভ‚মিকা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বাংলাদেশের অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনাকে বাস্তবরূপ দিতে আমাদের পুঁজিবাজারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। স্টক এক্সচেঞ্জ সঞ্চয়কারীদের পুঞ্জীভ‚ত সঞ্চয় ও উদ্যোক্তাদের মূলধন জোগানের মাঝে একটি সঞ্চালন লাইন হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনের জন্য প্রধানত পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান শিল্পের উন্নয়নে পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি মূলধন জোগানের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যা বিগত দুই দশকে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের শিল্পায়নের অর্থায়নে এখনো পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের একক আধিপত্য রয়েছে। উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ দেশের আর্থিক খাতের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর প্রভাব ইতোমধ্যে আমাদের আর্থিক খাতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যাংক পরিচালকদের অসাধু মানসিকতা ও আন্তঃব্যাংকিং প্রতিযোগিতার ফলে ব্যাংকিং খাত তথা আর্থিক খাত আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে, তবে এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে, দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৮) মুদ্রানীতিতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে প্রচলিত ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেটের মাধ্যমে অর্থায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এখন একটি টেকসই ও উন্নত পুঁজিবাজার গড়ার স্বার্থে, ব্যাংকের ওপর চাপ কমাতে স্বচ্ছ মানসিকতা নিয়ে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) হলো দেশের মূলধন বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। এক সময় জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ রেজিস্ট্রারের (আরজেএসসি) অধীনস্থ কন্ট্রোলার অব ক্যাপিটাল ইস্যুর অধীনে চলত দেশের পুঁজিবাজার। দিন দিন বাজারের কলেবর বড় হতে থাকায় দেশের পুঁজিবাজারকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা রেগুলেটরি বডির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আর সে লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের ৮ জুন সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৯৯৩-এর ক্ষমতাবলে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর পরই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কিছু আইনকানুন প্রণয়ন শুরু করে এসইসি। ওইসব আইনকানুন দিয়েই দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ চলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধস হলেও কালের বিবর্তনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তা কাটিয়ে ওঠে। পরবর্তী সময় বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে ২০১০ সালের শেষ দিকে দেশের পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। এরপর সময়ের দাবি বিবেচনায় ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর এক আইনের মাধ্যমে এসইসির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নামকরণ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারের রেগুলেটর হিসেবে বিএসইসি তখন থেকে নতুনভাবে কাজ শুরু করে। বিগত ১০ বছর কম-বেশি ৮০টির মতো আইনকানুন প্রণয়ন ও সংস্কার করেছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি।
বিভিন্ন আইনকানুন ছাড়াও বিগত কয়েক বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধি-প্রবিধান প্রণয়ন/সংশোধন সম্পন্ন করেছে বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে দেশের পুঁজিবাজার অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে অনেক আইনিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিস্তু বাস্তবে পুঁজিবাজারে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? গত বছরের শুরুতে নতুন সরকার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনে আশার সঞ্চয় হয়, ফলে ২৪ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান সূচক পৌঁছায় ৫৯৫০ পয়েন্ট। সেই আশা নিরাশায় পর্যবসিত হয়ে, বছরজুড়ে টানা পতনে এ বছর ৭ জানুয়ারি সূচক নেমে এসেছে ৪২৮১ পয়েন্ট। আমরা যদি এই সূচকটির আদ্যোপান্ত একটু ঘেঁটে দেখি তাহলে বের হয়ে আসবে বাজারের বর্তমান অবস্থা। ফ্রি ফ্লোট এবং এস এন্ড পি পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে আনুষ্ঠনিকভাবে ডিএসইএক্স সূচক চালু করে এবং দিন শেষে সূচক ছিল ৪০৯০ পয়েন্ট। ডিএসইক্স হলো একটি প্রশস্ত সূচক যেখানে বাজারের সার্বিক (৯৭ শতাংশ কোম্পানির) পারফরমেন্স প্রতিফলিত হয়। এই সূচকটির ভিত্তি বছর ১৭ জানুয়ারি ২০০৮ এবং বেইজ প্রাইস ইন্ডেক্স ২৯৩১.৯১। সূচকটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২০১৭ সালে ২৬ নভেম্বরে ৬৩৩৬ পয়েন্ট উঠেছিল এবং সর্বনি¤œ ২০১৩ সালে ৩০ এপ্রিল ৩৪৩৮ পয়েন্টে নেমেছিল। সূচকটি চালুর দিন থেকে এই প্রায় সাত বছরে সূচক বেড়েছে ১৯১ পয়েন্ট বা ৪.৬৬ শতাংশ। এবার দেখা যাক সূচকটির ভিত্তি বছর ২০০৮ সাল থেকে কী অগ্রগতি হয়েছে? বেড়েছে মাত্র ৪৬ শতাংশ। ২০০৮ সালে বাজার মূলধন টু জিডিপি রেশিও ছিল ১৭.০৫ শতাংশ কিন্তু বর্তমানে ১১.৪৩ শতাংশ এবং এটি ২০১০ ও ২০১১ সালে যথাক্রমে ৩২ ও ৩৬ শতাংশ ছিল। ডিএসইএক্স সূচকটি বর্তমানে ২০১৩ সালের সূচনালগ্নের কাছাকাছি ফিরে গেলেও এটিই বাজারের করুণার চিত্র ফুটিয়ে তোলার একমাত্র নির্ণায়ক না। কারণ এই দশ বছরে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে প্রায় ১০০টি কোম্পানি এবং পূর্বের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো প্রচুর রাইট ও বোনাস
শেয়ার দেয়ায় বাজার মূলধন বেড়েছে, যা সূচকের সঙ্গে যোগ হয়েও আজকে সূচকের এই অবস্থা। এই খাতের বেশির ভাগ কোম্পানি এ ক্যাটাগরির এবং গড় পিই ৭। আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মূলধনি খাত ফার্মাসিউটিক্যাল যেখানে লিস্টেড কোম্পানির সংখ্যা ৩২টি, যা ২০১৩ সালে ছিল ২২টি। এখানেও ১০ টাকার নিচে শেয়ার পাওয়া যায় ৫টি কোম্পানির। যদিও খাতটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী খাত, যার গড় পিই ১৮। আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম মূলধনি খাত ফুয়েল এন্ড পাওয়ার। সেখানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২০টি, যা ২০১৩ সালে ছিল ১৫টি। যার ৮০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০১৩ সালের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি। এই খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের মৌল ভিত্তি খুবই শক্ত, এরপরও এই খাতের গড় পিই মাত্র ১২। এভাবে আমাদের পুঁজিবাজারের ১৯টি খাত সূ²ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত হয়ে এই দশ বছরে ১৯৯৬ বা ২০১০ সালের ধসকেও হার মানিয়েছে, এটি এখন মহাধসে পরিণত হয়েছে বললে বেশি হবে না।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরেছে ২৮ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা কিন্তু এই জিডিপির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় দেশের পুঁজিবাজার। সরকার ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরেছিল ১১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সাত বছরে জিডিপির আকার বেড়েছে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা বা প্রায় আড়াইগুণ। অথচ দেশের পুঁজিবাজার সূচকের হিসাবে ফিরে গেছে ঠিক সাত বছর আগের জায়গায়। পুঁজিবাজারকে পাশ কাটিয়ে একটি দেশের উন্নয়ন কখনই টেকসই হতে পারে না। অর্থনীতির মৌলিক এলাকা হচ্ছে পুঁজিবাজার।
পুঁঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া সামনে এগোনো যাবে না। মানুষের প্রয়োজনে আইনকানুন তৈরি হয়। আর সেই আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাজ, জাতি, প্রতিষ্ঠান, দেশ সুশৃঙ্খল হয়। সেই আইন প্রয়োগেই আমাদের যত দুর্বলতা বা অনীহা। তা না হলে এত সংস্কার করেও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না কেন? বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নামে যে সংস্থাটি আছে সেটির ওপরই বিনিয়োগকারীদের আস্থার চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। কারণ বর্তমান কমিশন ১০ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালনের পরও বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বরং একের পর এক বিতর্কিত ও মানহীন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতা কতটা প্রবল থাকলে বাজার যে দাঁড়াতে পারে না, গত দশকটিই ছিল তারই প্রমাণ। এর ফলে বিদায়ী বছরে প্রায় ২ লাখ দেশি ও ১৮ হাজার ১৪২ জন বিদেশি বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। এখন বিনিয়োগকারীদের মনে বর্তমান বাজার বিবেচনায় একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সরকারি আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরো কত বছর সময় পেলে পরিপক্বতা অর্জন করবে? না তাদের সদিচ্ছার অভাব। তাই সেই কমিশনকে বহাল রেখে যে উদ্যোগই নেয়া হোক, তার সুফল মিলবে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজারের জন্য যেসব আইনকানুন হয়েছে, সেগুলো এই বাজারকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এখন পুঁজিবাজারের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার ব্র্যান্ডিং। পুঁজিবাজারকে যদি বড় করা না যায়, বাজারের প্রতি যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রতিষ্ঠা না হয়, তাহলে আইনকানুনের কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। সবকিছুর আগে একটি গতিশীল ও টেকসই বাজার সৃষ্টি করার জন্য, সচেতন বিনিয়োগকারী সৃষ্টিতে বিনিয়োগ শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক। [email protected]