×

অর্থনীতি

কঠিন সংকটে ব্যাংক খাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ১০:০৭ এএম

কঠিন সংকটে ব্যাংক খাত
নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে দেশের ব্যাংকিং খাত। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ব্যাংক খাতের নিয়ম-শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা কঠোর বার্তা ও পদক্ষেপের কথা শুনিয়েছেন। খেলাপি কমাতে ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে খেলাপি কমার পরিবর্তে আরো বেড়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনের বেশি ব্যাংক থাকা সত্তে¡ও আরো তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় এ খাতে সংকট উত্তরণ কঠিন হবে বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোটা দাগে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, ঋণ ও আমানতের সুদহার নিয়ে অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অতি নমনীয়তা দেখানো, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারিক কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবই ব্যাংকিং খাতের সংকটের অন্যতম কারণ। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আদায় সরকারের জন্য চলতি বছরের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বছরজুড়েই ঋণখেলাপিদের নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে। তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ নিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা মহলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপরও খেলাপি না কমে উল্টো পথে চলেছে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। এই জন্য এ খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। আর এর পেছনের কারণ হচ্ছে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব, সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারিক কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা প্রভৃতি। এ বিষয়গুলোর সমাধান করতে না পারলে ব্যাংকিং খাতের উন্নতি হবে না। আর এ খাতটির উন্নয়ন না হলে শেয়ার মার্কেটের অবস্থা আরো খারাপ হবে, দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও স্থবির হয়ে থাকবে। সুদহার এক অঙ্কে আনার বিষয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, জোর করে নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকের সুদহার ৬-৯ বাস্তবায়ন করা কঠিন। দেশের মূল্যস্ফীতিই তো ৬ শতাংশ। সুতরাং আমানতকারীকে ৬ শতাংশ সুদ দেয়া হলে ব্যাংকে কেউ টাকা রাখবে না। দীর্ঘদিন ধরেই আমানতের প্রবৃদ্ধি কমছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় আমানতের ওপর ভিত্তি করে। আমানত কমে গেলে সে তো ঋণ দিতে পারবে না। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অনেক দিন ধরেই কমছে। আমানত কম হলে ব্যাংকগুলো আরো তারল্য সংকটে পড়বে। সুতরাং এসব বিষয়ে সঠিক একটি দিকনির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে মির্জ্জা আজিজ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব বিশ্লেষণ থাকা দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা দিলে সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত সুস্পষ্টভাবে জানানো দরকার। দেখা গেছে, গত বছরের শুরু থেকেই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল ঋণ আমানতের ‘নয়-ছয়’ ফর্মুলা। ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে বা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বেশ কয়েকবার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ৯ বার নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যানদের ডেকে এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। সুদের হার কমানোর শর্তে ব্যাংকগুলোকে ৫ ধরনের বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এসব সুবিধা নিয়েও তারা সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামাননি। বর্তমানে ব্যাংকভেদে উৎপাদন খাতে সুদহার ১১-১৪ শতাংশ। সর্বশেষ ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কৌশল ঠিক করতে গত ১ ডিসেম্বর ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশের আলোকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। গভর্নর ফজলে কবির সভায় সভাপতিত্ব করেন। এদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ অঙ্ক কার্যকর করতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে ব্যাংকগুলো। বিভিন্ন মেয়াদে যাদের কাছ থেকে আমানত নেয়া হয়েছিল তাদের সুদহার কমানো যাবে না। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী দিন শেষে তাদের সুদাসলে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু নতুন-পুরনো মিলে ১ এপ্রিল থেকেই উৎপাদনমুখী সব শিল্পঋণের সুদহার ১ অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। এতে আমানতের সুদহার না কমাতে পারলেও ঋণের সুদহার কমে যাওয়ায় যে লোকসানের মুখে পড়বে ব্যাংকগুলো, তা সমন্বয় করা কঠিন হয়ে যাবে। জানতে চাইলে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকিং খাতের সক্ষমতা অর্জন তো দূরের কথা, ব্যাংকিং খাতের টিকে থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। খারাপ ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, সরকার মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট শুরু করেছে। ৯-৬ শতাংশ বেঁধে দিচ্ছে। মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট কোনো দিন ভালো ফল আনে না। একটা ব্যবসাকে তার নিজের মতো চলতে দিতে হবে। বাধা-ধরা নিয়মের মধ্যে ১৯৭০ সালে ছিলাম আমরা, এখন আবার সেখানেই ফিরে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ২০২০ সাল ব্যাংকিং খাতের জন্য কি নিয়ে এসেছে তা নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত। আমরা চাই দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি ভালো চলুক। কিন্তু ভালো চলার জন্য যে ভালো পলিসিগুলো দরকার সেগুলো পাচ্ছে না। এনবিএফআইয়ে ব্যাংকের সব টাকা আটকে আছে। সরকার বলছে, যেখানে যেখানে টাকা আছে তুলতে পারবে না। তাহলে এ টাকাগুলো তো আটকে গেল। শেয়ার মার্কেটে ব্যাংকের টাকা আছে, কিন্তু শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। তাহলে ব্যাংক কীভাবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে। ব্যাংকিং খাত উন্নয়নে যেভাবে অন্যান্য দেশের ব্যাংকিং খাত চলে সেভাবে চলতে দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App