×

সাময়িকী

যে রাতে আমার স্ত্রী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:১৮ পিএম

যে রাতে আমার স্ত্রী

আমি দেখতেই পাচ্ছি সময়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। প্রিন্সিপাল বলেন, সময় দিতে না পারলে ছেড়ে দাও। আমরা রুদাবা শাহরিয়ারকে তোমার জায়গায় নিয়ে নিই। এটাই শুনতে চাচ্ছিস শবনম। সেদিনই চা-ঘরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে পদত্যাগপত্র নিয়ে প্রিন্সিপালের হাতে দিয়ে দিল। শবনম আমাকে বলল, ছেড়ে দিলাম। আমি বললাম, আরো আগে ছাড়লে একটা ফেয়ারয়েল পেতে।

আমাদের নিজেদের কথা একটু বলি। পাঁচ থেকে ছয় হতেই অবন্তী আলাদা রুম চেয়ে বসল। তার মানে সে একা থাকতে চায়। একা থাকার প্রেরণা হয়তো শবনমই। শবনম চলে যায় আমার বাবার বড় ঘরে। তারপরও অবন্তীর জন্য তার মনোযোগের এতোটুকু ঘাটতিও আমি দেখিনি। আমার সাথে শবনমের শারীরিক সম্পর্ক অন্তত দুটো ভ্রুণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তিন-চার মাসের মাথায় গর্ভপাত ঘটে গেছে। আমরা আরো চেষ্টা করেছি। শবনমকে বলেছি, চলো মাদ্রাজে কোনো ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে আসি। আমি ওদিকে কখনো যাইওনি। শবনম বলল, আর বাচ্চার কি দরকার? অবন্তী আছে না? তাছাড়া প্রেগনেন্সির পেছনে পড়ে থাকলে পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার এগোবে না, এটা তো সত্যি। অবন্তী এইটে উঠতেই শবনম তাকে নিয়ে ভারত সফরে বের হলো। অবন্তী মুগ্ধ হলো দার্জিলিং-এর লরেটো কমভেন্ট বোর্ডিং স্কুল দেখে। ভর্তির সবকিছু চূড়ান্ত করে কিছু টাকাও আগাম দিয়ে এলো। দেড়মাস পর আবার গিয়ে বোর্ডিং-এ রেখে আসবে। আমি বললাম, কাজটা কি ভালো হচ্ছে? শবনম বলল, লরেটো কমভেন্টে চান্স পাওয়াই তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমার কিংবা অবন্তীর চেহারা দেখে তো তারা নেয়নি, তাকে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে পাস করতে হয়েছে। দুই ঘণ্টার ইন্টারভিউ। আমি বললাম, তুমি ব্যস্ত পলিটিক্স নিয়ে, আমি যদি অবন্তীকেও মিস করি.... বাক্যটি শেষ করতে পারিনি। শবনম বলল, নিজের স্বার্থটা এতো বড় করে দেখো কেন? মেয়েটার ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে পারলে না। অবন্তী সত্যিই চলে যায়। শবনম দিয়ে আসে। অবন্তী আমাকে বলে, সামার ভ্যাকেশনের সময় এসো।

(এগার) গত নির্বাচনে শবনম নমিনেশন পায়নি তবে হাই কমান্ড থেকে এ ক্ষতি পুষিয়ে দেবার প্রতিশ্রæতি পেয়েছে। সে জন্যই মন্ত্রী হবার গুজবটা উঠেছিল। তারও আগে শবনম খোলাখলিই বলল, তুমি আমার সাথে যে রকম শীতল আচরণ করছ স্পষ্ট করে বলে দিলেই পারো, এ বাড়িতে আমার জায়গা নেই। কিন্তু আমি তা কেন বলতে যাব, কিন্তু তোমার স্বাধীনতা যেন আমার জন্য যন্ত্রণার কারণ না হয়। আমি রাজনৈতিক কর্মীদের পছন্দ করি না; মিথ্যে, অসম্ভব ও অবাস্তব অঙ্গীকার আমি পছন্দ করি না; কাচ্চি বিরিয়ানি ও বোরহানি খেয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কথা বলা আমি পছন্দ করি না; নিজের বাচ্চাকে শহরের সেরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়ে বাংলা ভাষার বিশ্বজয় নিয়ে বক্তৃতা করা আমি পছন্দ করি না। মোট কথা একমাত্র অবন্তীকে ভালোবাসা ছাড়া শবনমের কোনো কিছুই আমি পছন্দ করি না। শবনম বলল, তুমি জেলাস, আমার বড় হওয়াটা তুমি সহ্য করতে পারছ না। আমি বললাম, বেশতো, তোমার বড় হওয়াটা আমার চেয়ে বেশি যে সহ্য করতে পারে তার কাছেই বলে যাও। শবনম বুঝতে পারে আমি তার দলের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সৈয়দ নাজিম হিকমতের কথা বলছি। এই পলিটিক্যাল সেক্রেটারি দলের ভেতর শবনমকে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে দলেরই কেউ কেউ বলেছে বামদের বিশ্বাস করতে নেই। টিকতে না পেরে আমাদের দলের উপর সওয়ার হয়েছে। কখন ছোবল দেবে বিশ্বাস নেই। ছোবল আগেও দিয়েছে। পলিটিক্যাল সেক্রেটারি বলেছেন, বাম আবার কি? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ডান-বাম সব এক হয়ে গেছে। শবনম আমাদের দলের অনেক পলিটিশিয়ানের চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি দক্ষ এবং বেশি সক্রিয়। আমরা যদি মূল্যায়ন না করি অন্য দলে যাবে। পলিটিক্যাল সেক্রেটারির এসব কথা শবনমই আমাকে শুনিয়েছে আমি ‘ওহ আচ্ছা! তাই নাকি? বেশতো’Ñ এসব বলে তাকে সাড়া দিয়েছি।

সরকারের মন্ত্রী কাজী এমদাদ হোসেনের মানি লন্ডারিং-এর ঘটনা প্রমাণপত্রসহ এমনকি সরকারি দলের পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। রাজনৈতিক উপদেষ্টা বলেছেন, অভিযোগ তদন্ত না করে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে তা সত্য প্রমাণিত হলে বিষয়টি আমাদের সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে। বাজারে দুটো কথা রটলো- এই সংবাদ ফাঁসের নেপথ্যে রয়েছেন পলিটিক্যাাল সেক্রেটারি। অভিযুক্ত মন্ত্রী এবং তিনি একই জেলার মানুষ। কনুয়ের এক গুঁতোয় এমদাদ হোসেনকে শুইয়ে দিতে পারলে তিনিই হয়ে উঠবেন জেলার অবিসংবাদিত নেতা। দ্বিতীয় রটনাটি হলো শবনম চিশতিকে মন্ত্রী বানাতে হলে অন্তত একটা শূন্যপদ সৃষ্টি করতে হবে। উপায় দুটো : মন্ত্রীর মৃত্যু অথবা মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ। আরো একটা দুর্ঘটনাই ঘটল বলা যায়। সবচেয়ে সুদর্শন প্রতিমন্ত্রী- কাউসার আহমেদ এবং একজন হাই সোসাইটির কমার্সিয়াল সেক্স ওয়ার্কারের যৌনকর্মের ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেল। প্রতিমন্ত্রী বললেন, ষড়যন্ত্র। অন্যকোনো ছবি থেকে তার মাথাটা কেটে যৌনকর্মে ব্যস্ত লোকটির ঘাড়ের উপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন আইটি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দক্ষ হাতে এ ধরনের ম্যানিপুলেশন করা সম্ভব। তবে প্রতিমন্ত্রীর ভিডিওটি সেরকম কিনা পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব নয়। পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ও কাউসার আহমদের ঘনিষ্ঠতা সবারই জানা। তিনি বললেন, যারা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তায় হানা দেয় তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের চিন্তাভাবনা চলছে। সরকার শপথ গ্রহণের এক বছর সাত মাস একশ দিন পর কেবিনেট রিশাফলিং হলে কাজী এমদাদ হোসেন, কাউসার আহমেদ এবং অজ্ঞাত কারণে নুরুন্নবী চৌধুরী বাদ পড়লেন। কয়েকজন মন্ত্রীর দপ্তর রদবদল হলো। নতুন মন্ত্রী হবেন আলী মুস্তফা চৌধুরী এবং রুহুল আমিন সরকার এবং প্রতিমন্ত্রীও দু’একজন হবে বলে খবর বের হলো।

অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলতেই বঙ্গভবনের খাম দেখি। খামটা অক্ষত রাখার জন্য খুব যতœ করে স্কট টেপ টেনে তুলি। ভেতরে একটা কার্ড। সবার আগে চোখ পড়ে নিচের দিকে। লিখা আছে : ড্রেস কোড : ফর্মাল, ব্যাকেটে আনুষ্ঠানিক। এতে একবার মেজাজ খারাপ হলো। ভেতরের লেখা পড়ে মেজাজ আরো একবার খারাপ হলো- তিনজন মন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তিনজন কেন তিরিশ হলেও আমাকে কেন যেতে হবে। এটা কি উপভোগ করার মতো অনুষ্ঠানÑ এটা কি হরিপ্রসাদ চুরাশিয়ার বাঁশি শোনার অনুষ্ঠান? এটা কি রুশ বিপ্লব নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান? এটা কি ওস্তাদ আল্লারাখার তবলাবাদন? যদি তা না হয় আমি কেন যাব? সারাটা সন্ধ্যা আমার খুব বাজে কাটল। আমার মেজাজ খারাপ থাকলে রাতে ঘুম হয় না। ঘুম না হলে পরের দিনটা খুব অস্বস্তিকর অবস্থায় মধ্য দিয়ে যায়। আমি বের হয়ে মাইল দেড়েক হেঁটে একটা সস্তা রেস্তোরাঁয় ঢুকি। এখানে আটারুটি বানানো হয়। আমি আটারুটি, সবজি এবং মুগের ডালের অর্ডার দিই। আমি ডায়াবেটিক নই, তবে গ্লুকোজ লেভেল মার্জিনে। তবুও কড়া মিষ্টি এককাপ চা খাই। আমার ঘুমের উপর চায়ের কোনো প্রভাব নেই, মেজাজ ঠিক থাকরে আমি চা খাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে পারি। আমি ফিরে এসে দুটো ডায়াজিপাম খাই। ইনসমনিয়ার আশঙ্কা থাকলে আমি ঘুমের বড়ি খাই। আমি টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে টেপাটেপি করতে থাকি। আমার প্রিয় চ্যানেল অ্যানিমেল প্লানেট বড় প্রাণীর যৌনজীবনের উপর একটি ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। আমি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে হাতি ও আফ্রিকান গণ্ডারের যৌনক্রিয়া এবং সন্তান প্রজনন দেখলাম। আমার হাই উঠতে থাকে। আমি রিমোটের সুইট অফ করি। অবন্তী থাকলে আমি এই প্রোগ্রামটা দেখতাম না। দ্রুত সুইচ ওভার করতাম আল-জাজিরা টিভিতে। আমার সবচেয়ে প্রিয় নিউজ চ্যানেল। হাই উঠা খুবই ভালো লক্ষণ। আমি একটা দারুণ ঘুম দেব, টানা আটঘণ্টার ঘুম। তাই হলো। ইউরিনারি ব্লাডার ফেটে পড়ার অবস্থা হলে আমি উঠে বাথরুমে যাই। ব্লাডার খালি করি। আয়নায় মুখ দেখি। শেভ করতে হবে, গোঁফটা একটু ছাঁটতে হবে। নিজেই করব না কি সেলুনে যাব ভাবতে ভাবতে বেডরুমে এসে খাম থেকে আবার বঙ্গভবনের কার্ডটা বের করি। আবার পড়ি : শপথ গ্রহণ সন্ধ্যা সাতটা। ছয়টা তিরিশ মিনিটের মধ্যে অবশ্যই আসন গ্রহণ করতে হবে। কার্ডটা সাথে আনতে হবে। এই কার্ডটা হস্তান্তরযোগ্য নয়।

আজকের প্রথম ক্লাসটি এগারটায়। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়াবো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা। ক্লাসটা কীভাবে শুরু করব তার একটা ছক করে নিই। প্রথমেই বলল, এখন আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন টাকার। এটা কি সাফল্য না ব্যর্থতা? নাকি দুটোই। আমি এই বলে উপসংহার টানব যে বড় টাকার অঙ্কই বলে দেয় উৎপাদনশীল কাজে টাকা ব্যবহার করতে আরা ব্যর্থ হয়েছি, এই মুহূর্তে ১০ বিলিয়ন টাকার রিজার্ভ থাকলেই চলত। আমি সেলুনেই যাব। ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে ফিরব। আমি দুটি সাধারণ সেলুন পাশ কাটিয়ে একটি এয়ারকন্ডিশনড হেয়ার ড্রেসারে ঢুকলাম। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক তরুণ নাপিত বেশ যত্ন করে মুখে শেভিং ক্রিম মাখাতে মাখাতে বলল, চুলটা একটু ছোট দিলে ভালো দেখাবে। তারপর একটু কলপ। আমি বললাম, শেভ করা, চুল কাটা, কলপ লাগানো- এই প্যাকেজটা কত পড়বে। বলল, সাড়ে চারশ টাকা, সাথে মাথা ও ঘাড় বানানো ফ্রি। সার্ভিস ভালো লাগলে খুশি হয়ে টিপস যা দেবেন তা-ই সই। সার্ভিস ভালো না লাগলে দেবেন না। আমার চরিত্র আদর্শের সাথে বিরোধিতা করে রাজি হয়ে যাই। আমি বলি, আচ্ছা। দু’হাতের মাঝখানের তিন আঙ্গুল জোড় করে যুবকটি যখন আমার মাথার আদুরে আঘাত করতে থাকে আমার খুব ঘুম পায়। যখন আমার ঘাড় ও কাঁধ টিপতে থাকে তখন আমি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ি। চ‚ড়ান্তবারের মতো চুল আঁচড়ে আমার পেছনে আয়না ধরে তরুণটি বলল, স্যার দেখুন, ঠিক আছে কিনা? আমি আয়নার তাকাই। আমার মসৃণ গাল, ঘন কালো চুল এবং ম্যাজেস-উত্তর চেহারা দেখে পুলকিত হই। আমার মনে হয় তরুণটি আমার কাছ থেকে অন্তত পনেরটি বছর চুষে নিয়েছে। আমি পাঁচশ টাকার একটি নোট দিয়ে বলি, বাকিটা তেমার টিপস। তরুণ ফিসফিস করে বলল, স্যার পেছনে একটা পার্লার আছে বডি ম্যাসেজ। কুড়ি বছরের কম বয়সী মেয়েও আছে। যদি চান আরো কিছু। তারপর সে একটি বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দেয়। শোয়েব আহমেদ, বিএ (অর্নাস), পার্সোনাল সার্ভিস প্রোভাইডার। আমি বললাম, আচ্ছা ফোন দেব। আমার প্রোলেতারিয়েত চরিত্রের বুর্জোয়াকরণ আমাকে অবাক করেছে- কোনটা আমার আসল চরিত্র, প্রথমটা না পরেরটা। আমি অপেক্ষাকৃত দামি একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকি। প্রচুর চর্বিযুক্ত একটি খাবার নেহারি এবং ঘি মাখানো নানরুটি দিতে বলি। বেশ তৃপ্তির সাথে খাই এবং ভাবি এতসব সুস্বাদু খাবার থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার কোনো মানেই হয় না। আমি ফিরে আসি, গোসল করি এবং ইস্ত্রিভাঙা পেন্ট-শার্ট পরি। দশটায় বেরোলেই আমার চলে। বেরোবার জন্য ভেতর থেকে রদজা খুলতে যাচ্ছি দেখি দরজার নিচে দিয়ে ভেতরে ঢুকানো আর একটি খাম। খামের উপর কোনো নাম ঠিকানা নেই। ভেতরে এক চিলতে কাগজে সামান্য কয়েকটি শব্দের একটি চিঠি : আবদুল খালেক, তুমি বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে এলে আমি খুশি হবো। শবনম। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App