×

সাময়িকী

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:২৬ পিএম

[ পর্ব : ৭ম ]

আমার আনন্দ তাদের তুলনায় তাই অর্ধেক নয় সিকি। পালাওয়ে পর্যটকদের আগমন ক্রমবর্ধমান। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাই এ বিষয়ে খুবই সচেতন যাতে করে তাদের মেরিন এনভায়রনমেন্টের কোনো ক্ষতি না হয়। এখানে পর্যটকদের অবাধ বিচরণের কোনো সুযোগ নেই। আমার ইচ্ছা ছিল স্কুবা ডাইভিংয়ের। জলের গভীরে কোরাল ঝোপের তলদেশ অবধি বিচরণের। সে কথা রবার্টকে আইল্যান্ডস ট্যুর ঠিক করার সময় বলতেই জানাল, এখানে স্কুবার জন্য সার্টিফিকেট লাগে। আপনার কি সার্টিফিকেট আছে? না তো। সার্টিফিকেট পাওয়া তেমন কঠিন কিছু নয় কিন্তু এজন্য ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। ট্রেনিং শেষে টেস্ট দিতে হয় সঙ্গে ত্রিশ ডলার ফি। কিন্তু সে সময় তো আপনার হাতে নেই। আমার তাই স্কুবা ডাইভিংয়ের বদলে স্লোরকেলিং চলছে। স্লোরকেলিং হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে পানির নিচে থাকাবস্থায় একটি নলের সাহায্যে মুখে দিয়ে ওপর থেকে নিঃশ্বাস নেয়া যায়। সে সময় মাস্কে নাক চোখ ঢাকা থাকে বলে পানির গভীরে যে মেরিন আকর্ষণ তা অবলোকন করা যায় সহজেই। স্কুবা ডাইভিংয়ের তুলনায় এই ব্যবস্থা অনেক সহজ। স্কুবাতে হয়তো দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকা সম্ভব কিন্তু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ইকুইপমেন্ট বহনও কম ঝক্কির নয়। পানির নিচের প্রকৃতি যে কত আকর্ষণীয় তা না দেখলে ধারণা করা যায় না। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাই মন্থর গতিতে যতটা পারি সাঁতরিয়ে দেখছিলাম। সবাইকে ছেড়ে বেশি দূর চলে যেতেও ভরসা হচ্ছিল না। দলের সবার তো ভরসার জন্য নিজ নিজ সঙ্গী রয়েছে। আমি তো এ যাত্রায় তাদের মতো অতটা সৌভাগ্যবান নই। সাঁতরাতে সাঁতরাতে এক সময় খেয়াল করি আমার পেছনে ওয়েট। নিঃশব্দে আমাকে অনুসরণ করছে। আমি পানি থেকে মাথা তুললে বলল, আপনার কাছেই আছি চিন্তার কিছু নেই। আমি কোনো চিন্তা করছি না। জবাব দেই। ওয়েট হাত উঁচিয়ে তখন বলল, ওই দিককার মেরিন লাইভস আরো আকর্ষণীয়। এখনো কিছুটা সময় আছে। সাঁতরিয়ে আসুন স্যার। সাঁতরাচ্ছি আর আমাকে অনুসরণ করছে ওয়েট। ইমপ্যাক আমাদের প্যাসিফিকের যে এলাকায় নিয়ে এসেছে তা মূলত বিনোদন ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনেও এখানে নানাবিধ কার্যক্রম চলে। পালাওয়ে যেসব পর্যটক আসে তাদের ‘রক আইল্যান্ডস ইউজ পারমিট’ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই পারমিট থাকলে তারা নির্দিষ্ট এলাকায় স্কুবা ডাইভিং, ¯েœারকেলিং, বোটে করে বেড়ানোসহ বিভিন্ন কিছু করতে পারে। অনুমতি ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। অধিকন্তু এই পারমিটের সাহায্যে তারা শুধু নির্ধারিত সৈকত কিংবা ভ‚মি ব্যবহার করতে পারে। পর্যটকদের মাছ ধরার জন্য রয়েছে পৃথক পারমিটের ব্যবস্থা। তবে কোনো অবস্থাতেই তাদের সার্ডিনের জন্য অভয়ারণ্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যে সংরক্ষিত অঞ্চল রয়েছে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। স্লোরকেলিং শেষে সবাই উঠে পড়ি। হ্যারল্ড ছাড়া সবাই জলে নেমেছিল। মনে হলো সে যথারীতি সুপারি চিবিয়ে যাচ্ছে। ওয়েটকে জিজ্ঞেস করি, সাঁতারের পোশাক কি খুলে ফেলব। ভেজা কাপড়ে থাকতে অসুবিধা হলে খুলে ফেলাই ভালো। আবারো কি পরতে হবে? হ্যাঁ। তাহলে আর খুলছি না। তুমি আমাকে সারাদিনের প্রোগ্রাম বল তো। এখান থেকে আমরা যাব জেলি ফিশ লেকে। বিশ্বে জেলি ফিশের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল সেটি। সেখান থেকে লাঞ্চের পর মিল্কি ওয়েতে। এ দুই জায়গায়ই সাগরে নামতে হবে। আমি ভাবি তাহলে তো কাপড় পালটানোর যুক্তি নেই। জিজ্ঞেস করি, তা তোমাদের মিল্কি ওয়ে বলতে কি বোঝাচ্ছ? প্যাসিফিকের এইখানটাতে পানি সাদা। গভীরতাও সামান্য। আসলে এখানকার কাদা সাদা হওয়ায় জলের রং দুধের মতো লাগে। তবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলো এই কাদা দেহের জন্য এক ধরনের লোশন। এটি গায়ে মাখলে ত্বক ভালো থাকে। মিল্কি ওয়েকে তাই বিউটি মাড প্যাকও বলে। তা আমাদের সেখানে কী কাজ? সবাই জলে নেমে ডুব দিয়ে কাদা তুলবে আর বোটে বসে গায়ে মাখবে। তারপর স্নান। স্নানের পর সময় পাওয়া গেলে ম্যানগ্রোভ চ্যানেলে কায়াকিং। সময়ে কুলোবে তো। আমাকে কিন্তু যেভাবেই হোক ৪টার মধ্যে কোরোর ফিরতে হবে। সে আমার মাথায় আছে স্যার। চিন্তার কোনো কারণ নেই। জেলি ফিশ লেকে আসতে বোট থেকে নেমে আমাদের পাহাড় ডিঙোতে হলো। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আবহাওয়া সামান্য দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পাথুরে পাহাড়। গাছপালাও রয়েছে। পথ পিচ্ছিল। এতটাই পিচ্ছিল যে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য কোথাও কোথাও মোটা দড়ির রেলিং। সেটি ধরে উপরে উঠতে বেগ কম লাগে। অভিযাত্রী দলে আমি ছাড়া সবাই তরুণ। ক্লান্তি তাই সবার আগে আমারই প্রাপ্য। পাহাড় ততটা উঁচু নয়। এক দেড়শ মিটার হবে হয়তো। অর্থাৎ ওঠা নামায় তিনশ মিটার। আমরা উপরে উঠছি। আমার পিছে সাচিকো আর ইয়োকো। দলের মাঝামাঝি স্থানে আছি আমরা। বললাম, অসুবিধা হচ্ছে? না। উত্তর দিল ইয়োকো। ইয়োকো যুবতী তবে সাচিকোর তুলনায় বয়সে বড়। বলল, অসুবিধা হচ্ছে না কারণ এই পথ আমাদের পরিচিত। তার মানে আগেও এসেছে? হ্যাঁ। একবার নয় দুবার। অর্থাৎ এবার নিয়ে তিনবার হলো। আশ্চর্য। জবাব দেই। ইয়োকো-সাচিকো সাবধানে পা ফেলছে। আমিও। সবার পা খালি। পাথুরে বৃষ্টিভেজা পথ। পিছলে না যাই। কেটে না যায় পা। নিচে পাহাড়ের গা ঘেঁষে প্রশান্ত মহাসাগরের কালো জল। আদিগন্ত বিস্তৃত। বললাম, তাহলে বোঝাই যাচ্ছে প্যাসিফিক তোমাদের খুবই ভালো লাগে। অবশ্যই। বলল দুজন প্রায় একসঙ্গে। পাহাড়ের একপাশ থেকে আমরা আরেক পাশে এলাম। জেলি ফিশ লেকে নামার জন্য পাহাড়ের গোড়ায় কাঠের জেটি। ওপারেও কাঠের জেটি। যেখানে এখন আমাদের বোট নোঙর করে আছে। বিশাল লেক। পাহাড়ের বেষ্টনী তাকে সাগর থেকে পৃথক করেছে। এটি আসলে লেগুন। লেকে সাগরের কোনো উথাল-পাথাল নেই। সাগরের মাঝে থেকেও যেন সাগরে নেই। জলে আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হাইড আর ওয়েট। কিন্তু ওয়েট সারাক্ষণ ঘেঁষে আছে আমাকে। জেলি ফিশের রাজ্যে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। শত শত ফিশ আমাদের চারপাশে। আমাদের স্পর্শে। জলের ভেতর দিয়ে যখন তাকাই মনে হয় তারা পানিতে ঝুলে আছে। খেয়াল করলে তাদের বয়স বুঝতেও অসুবিধা হয় না। কোনো কোনোটার শরীর বয়সের ভারে ঢিলে। কোনো কোনোটার দেহ আবার অটুট। অর্থাৎ সে তরুণী। চার পাশের পাহাড় পাথুরে হলেও বৃক্ষহীন নয়। বৃক্ষহীন নয় বলা ঠিক হলো না। বরং বলা শ্রেয় বৃক্ষশোভিত। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে জেলি ফিশের রাজ্য আরেক জগৎ। সাগরের এ এলাকায়ই রয়েছে নাকি আরেক বিস্ময়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের ঝিনুকের সম্ভার।

লেকের বিশালতার কারণে জলে নামার সময় ওয়েট সতর্ক করেছিল আমি ওপাড় পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসতে পারব কিনা। আমার নিজেরও সংশয় ছিল তাতে। কিন্তু আমাদের দলের নারীরা যখন দাপিয়ে নেমে গেল তখন সংশয় আর কীভাবে থাকে। তবে স্লোরকেলিং স্পটের মতো নয়- এ যাত্রায় আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়েছি। কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই জ্যাকেট আমাদের ভাসিয়ে রেখেছে জলে। উপুড় হয়ে পানির গভীরে দৃষ্টি ছড়িয়ে সবাই সাঁতরাচ্ছি স্লোরকেলিং করতে করতে। আমাদের নাক চোখ প্লাস্টিক মাস্কে ঢাকা। স্বচ্ছ জলের গভীরে দৃষ্টি তাই সহজেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে সিকের মতো পানির শরীরে ঝুলে থাকা জেলি ফিশদের সৌন্দর্য। তাতে আবিষ্ট হয়ে আমি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আর সত্যি কথা বলতে কী আমি তো প্রকৃত অর্থে সাগরে দল ছুট এক নাবিক। পর্যটকদের এই দলের সঙ্গে আমি ভিড়েছি শেষ মুহূর্তে। বাকি সবাই তো এক গোত্রের তারা হয়তো ভাবছে আমি তাদের প্রাইভেসি নষ্ট করছি। কেবলি জল হতে মুখ তুলেছি শুনলাম ওয়েট বলছে, আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। আর দূরে যাওয়া ঠিক হবে না। কথা সেটি নয়। আমার কথা হচ্ছে ওয়েটকে তো আমি বলিনি আমাকে সর্বদা অনুসরণ করতে। এত সন্তর্পণে তার সাঁতার আমি তো বুঝতেই পারিনি কেউ আমার পিছে কিংবা পাশাপাশি আছে। এর আগের স্পটে স্লোরকেলিং-এর সময়টাতেও সে ছিল সারাক্ষণ অনুসরণরত। রবার্ট ইমপ্যাককে আমার সম্পর্কে কী বলেছে আর তারাইবা কী নির্দেশ দিয়েছে ওয়েটকে আমি জানি না। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App