×

অর্থনীতি

পড়তে পড়তে তলানিতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩৩ এএম

পড়তে পড়তে তলানিতে
পড়তে পড়তে তলানিতে

বিশ্বের অন্য দেশগুলোর পুঁজিবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারের কোনো তালমিল নেই। বাজার সম্পর্কে নেই কোনো প্রণিধানযোগ্য গবেষণাপত্রও। কেন বাজারে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে আর কবেই বা এর উন্নতি হবে- তাও জানে না কেউই। বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বন্ধ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আইপিও বন্ধের এই প্রস্তাবকে অপেশাদার সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, স্টক এক্সচেঞ্জগুলো বাজার নিয়ে গবেষণা করছে না, বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে পুঁজিবাজারের এই চরম অবনতি। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। চেয়েছেন বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ। এই অস্থিরতা নিরসনে আগামী সোমবার জরুরি বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

দেশের পুঁজিবাজারে কয়েক বছর ধরেই চরম মন্দা বিরাজ করছে। চলছে ধারাবাহিক দরপতন। গত কয়েক দিনে তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। গতকাল মঙ্গলবারও ঘটে বড় ধরনের দরপতন। এতেই ফুঁসে ওঠেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ডিএসইর নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করেন তারা। বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই বিক্ষোভ হয়। এতে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান ড. খাইরুল হোসেনের পদত্যাগের পাশাপাশি সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানান বিনিয়োগকারীরা। সংগঠনটির সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে পুঁজিবাজার ভালো করা যাবে না। আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। সেই সঙ্গে পুরো কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে বলেও দাবি জানান তিনি।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের আর্থিক খাতে সুশাসনের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। ব্যাংক খাতের ‘নন-পারফর্মিং লোন’ বেড়ে গেছে। যে কারণে তৈরি হয়েছে তারল্য সংকট। এর প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। কোম্পানি তালিকাভুক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয়ে চরম স্বেচ্ছারিতার আশ্রয় নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। এই কারণে বাজার নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া আরো একটি কারণ হলো- বাজারের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির ঝামেলা চলছে। বাজারের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরতে ডিএসইর মুখ্য ভ‚মিকা পালন করার কথা থাকলেও কার্যত প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হচ্ছে। বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাজারে সার্বিক চিত্র তুলে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক মানের কোনো গবেষণা সেল নেই। আর প্রাইমারি মার্কেটে নৈরাজ্য তৈরির পরিপ্রেক্ষিতে আইপিও বন্ধ হলেও কার্যত কোনো কাজই হচ্ছে না। বাজারের সমস্যাগুলো চিহ্নিত হলেও বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই কারো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি আব্দুর রশিদ লালী ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারের এই অবস্থার জন্য বেশ কটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- তারল্য সংকট, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা, বাজারের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গ্রামীণ ফোনের সঙ্গে

বিটিআরসির ঝামেলা। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের উন্নতির জন্য আইপিও বন্ধ করেছে প্রায় ৬ মাস ধরে। তারপরও কোনো কাজ হচ্ছে না। কিন্তু বিশ্বের কোথাও আইপিও বন্ধের নজির নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ডিএসই পারফর্ম করতে পারছে না। কারণ বাজার সম্পর্কে তাদের কোনো গবেষণা নেই। বিশ্বের অন্য স্টকগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বা তারা কীভাবে পলিসি নিচ্ছে এমন কোনো প্র্যাকটিসও ডিএসইর নেই। বাজারের অবস্থা কী হবে, কবে খারাপ হতে পারে, আর কীভাবে ভালো হবে- এই বিষয়ে কারো কোনো ধারণা নেই। সর্বোপরি ডিএসইর একটা শক্তিশালী ‘গুড গভর্নেন্স ডিপার্টমেন্ট’ করা উচিত বলেও মনে করেন ডিএসইর সাবেক এই সভাপতি।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ ৮ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ দিনই শেয়ারের বড় দরপতন হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৪০০ পয়েন্টের ওপর। এর মধ্যে শুধু মঙ্গলবারই কমেছে ৮৭ পয়েন্ট। এর আগে ১ জানুয়ারি লেনদেনের শুরুতে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। অব্যাহত দরপতনের কারণে মঙ্গলবার তা ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। জানুয়ারি মাসে লেনদেন হওয়া ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ দিনই সূচক ছিল নিম্নমুখী। এ সময় ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৪১৬ পয়েন্ট। অর্থাৎ নতুন বছরের মাত্র ১০ কার্যদিবসে মূলধন কমেছে ২৬ হাজার ১৫৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজারের সার্বিক বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং এন্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। নন-পারফর্মিং লোনের কারণে মানি মার্কেটে সুদের হার বেড়ে গেছে। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা বিরাজ করছে আর্থিক খাতে যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে চিহ্নিত সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।

এদিকে পুঁজিবাজারের অস্থিরতা নিরসনে জরুরি বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ২০ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল মঙ্গলবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার উন্নয়নে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে অংশীজনের মতবিনিময় সভার প্রস্তাবনার যথাযথ বাস্তবায়ন কাজ সমন্বয় ও তদারকির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের গঠিত কমিটি এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনার জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নূরের সভাপতিত্বে দুপুর ২টায় ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুদ বিশ্বাস, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক : দেশের পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে এ পর্যন্ত যতগুলো প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে সর্বোত্তম প্রস্তাব বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ কথা জানান। বৈঠকে ডিসিসিআইর সভাপতি শামস মাহমুদ, সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন, এফসিএ, এফসিএস এবং সহসভাপতি মোহাম্মদ বাশির উদ্দিনসহ পর্ষদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি প্রতিনিধি দল গভর্নর ফজলে কবীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে সিঙ্গেল ডিজিটের সুদহার বাস্তবায়ন, খেলাপিঋণ, ব্যবসা সহজীকরণ, বর্তমান পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি এবং এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে আলোচনা হয়। তবে পুঁজিবাজারের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন গভর্নর। তিনি ডিসিসিআইর প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় এ পর্যন্ত যেসব প্রস্তাব পাওয়া গেছে তার মধ্যে সর্বোত্তম প্রস্তাব বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ধরনের সহায়তা করবে।

সরকারি ৪ ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশ : পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট নিরসনে সরকারি ৪ ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে এই আহ্বান জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম। সাক্ষাতে বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ মতিন উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের বিষয় নিশ্চিত করে বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থা দূর করতে করণীয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। উনাকে বাজারের এই অবস্থায় তারল্য সংকটের বিষয়টি অবহিত করি। একই সঙ্গে বাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ডের বিষয়ে অবহিত করি। তিনি পুঁজিবাজারের চলমান মন্দাবস্থা দূরীকরণে আশাদুল ইসলাম রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংককে বিনিয়োগ সীমা অনুযায়ী বিনিয়োগের জন্য মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য করণীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে আশাদুল ইসলাম আমাদের জানিয়েছেন, সোনালী ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবও পুঁজিবাজারের চলমান পতনের কারণ দেখছেন না বলেও জানিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App