×

মুক্তচিন্তা

পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্ভাবনার হাতছানি

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ০৭:৩৭ পিএম

আমি একজন পাটের কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষিতত্ত¡বিদ। তারই সূত্রে গত প্রায় ২২ বছর ধরে পাটের কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার কাজ পরিচালনা করে আসছি। জিন বিজ্ঞান বা বায়োটেকনোলজি আমার বিষয় নয়, তবে কাজের স্বার্থে জানা আর জানার সূত্র ধরেই কিছু কথা লেখার চেষ্টা করা। পাদ্রি গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের কথা আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তিনিই প্রথম জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। যেমন লম্বা আর খাটো মটরশুঁটির বৈশিষ্ট্য কীভাবে বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়, সেটি জানতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান এক নতুন বিজ্ঞানের। তার ধারণা থেকেই মানুষ জানতে পারে যে, দেখতে যেমনই হোক আর বহিরাবরণে যাই থাক জীবনের বৈশিষ্ট্যেরও একক আছে এবং সেই এককের ভিন্নতার জন্য জীবনের নানা প্রকাশ। তবে তখনো মেন্ডেলের এই ধ্যান-ধারণা গুরুত্বের সঙ্গে কারো নজর কাড়তে পারেনি। তার প্রায় ১০০ বছর পর মানুষ তার এ ধারণার কথা জানে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে শুরু হয় বংশগতি বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। মানুষ জানতে পারে জীবনের বৈশিষ্ট্যের একক হলো জিন, আর সেই বিজ্ঞান হলো জেনেটিক্স। তারপর আবার ধীমেধরা গতিতে কেটে যায় প্রায় ৫০ বছর। এক সময় ধরা দেয় এক জোড়া বিজ্ঞানী, নাম ওয়াটসন ও ক্রিক, যাদের দেয়া ধারণা থেকেই মানুষ জানতে পারে জিন মাত্রই এক ধরনের এসিডের চাঞ্চল্য। নিউক্লিক এসিড (ডিঅক্সিরাইবো বা রাইবো)। সবটার নাম ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) বা আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড)। ডিএনএর কাজ হলো জীবনের জন্য কি ধরনের প্রোটিন বানাতে হবে, সেটির নির্দেশনা নিয়ে কাজ করা। আর আরএনএর কাজ হলো সেই বার্তা প্রয়োজনীয় স্থানে বয়ে নিয়ে যাওয়া। তার অর্থ হলো জীবন মানেই ডিএনএ ও আরএনএর দৌড়ঝাঁপ ছাড়া কিছু নয়। একজন মানুষের চোখের রং নীল হবে না কালো হবে, তার তথ্য প্রথম মাতৃকোষেই লেখা থাকে, লেখা থাকে ডিএনএর দ্বিসূত্রকের বিন্যাসে। মাতৃকোষের বিভাজন থেকে শরীর গঠনের এক পর্যায়ে চোখ গঠিত হয়। আর তখন আদি কোষের ডিএনএ থেকে আরএনএ নীল চোখের বার্তা পৌঁছে দেয় সেখানে। তৈরি হয় নীল চোখ, আর আমরা দেখি নীল নয়নাকে। এভাবেই আসলে সব জীব কোষের সব বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত আছে ডিএনএর জিনে। মোট কথা কোনো জীবের জীবনকে বুঝতে হলে, তার জিনের অনুক্রম বা বিন্যাসটা জানতে হবে। আর এটাই হলো জিন বিজ্ঞানের মূল বিষয়। অর্থাৎ জীবন রহস্যের আসল বিষয় জিন-নকশা বা জিন সিকোয়েন্স। পৃথিবীর সবচেয়ে সরলতম ভাইরাস থেকে সবচেয়ে জটিলতম মানব সন্তানের মাঝে একটা গভীর মিল আছে। তাদের সবার গঠনের একটা নীল নকশা আছে। আর সেই নীল নকশা অনুযায়ীই কেউ পিঁপড়া আর কেউবা বিশাল আকারের হাতি, কেউ লজ্জাবতী আর কেউ বটগাছ, কেউ সাপ আর কেউবা জলহস্তী হয়ে গড়ে ওঠে। এটুকু তথ্য যদি বিশ্বাস করা যায় তাহলে পরের অংশটুকু আরো চমৎকার ও চমকপ্রদ। সেটা হলো পৃথিবীর সব প্রাণীরই একটি জীবন নকশা আছে এবং সেই নকশার ভাষা একটি। সেই ভাষাটি লেখা হয়েছে ইংরেজির মাত্র চারটি অক্ষরে। আর সেই চারটি অক্ষর হচ্ছে এ, টি, জি এবং সি। যা জীবনের মৌলিক উপাদানগুলোর আধ্যক্ষর। সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এমন পর্যায় পৌঁছে গেছে যে, মানুষ ইচ্ছা করলে যে কোনো প্রাণের উৎসের চার অক্ষরে লেখা জীবনের সেই নীল নকশাটি পড়ে ফেলতে পারে। মানুষের জীবনের সেই নীল নকশাটির নাম ‘মানবজিনোম’। সবমিলিয়ে সেই জিনোম বা নীল নকশায় আছে ৩০০ কোটি অক্ষর যা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘বেসপেয়ার’। এই জিনোম রহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা আছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। যে কোনো জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক অনেক জিনের দ্বারা। জিনগুলো তৈরি ডিএনএ দ্বারা, আর ডিএনএ তৈরি নিউক্লিওটাইড দ্বারা। এই নিউক্লিওটাইডের বেস আবার চার ধরনের। এডেনিন (এ), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি) ও সাইটোসিন (সি)। আসলে জীবের ক্রোমোজোমে এই চারটি বেসই ঘুরেফিরে নানা কম্বিনেশনে আছে এবং এদের কম্বিনেশন ও বিন্যাসের উপরেই নির্ভর করছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। তাই কোনো জীবের এই জিনোম ডিকোড বা এ, টি, জি, সি’র পারস্পরিক বিন্যাসটা আবিষ্কার করা মানেই সেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর অবস্থান ও ফাংশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া। যেমন মানুষের জিনোম ডিকোডিং করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন জিনের অবস্থান জানা গেছে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পাটের জিনোম ডিকোডিং বা জিন সিকোয়েন্সিং হওয়া মানে আমরা এখন পাট সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি বা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর সম্বন্ধেও জানি। এটা অবশ্যই একটা বড় অর্জন। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা পাট একটি অর্থকরী মাঠ ফসল। এটি গাছ। এরও জীবন আছে। আমাদের দেশে শীতকালে পাট হয় না। আর যে কারণে হয় না, সে তথ্যটি জিনোম সিকোয়েন্সের কোথাও না কোথাও আছে। যা বিজ্ঞানীরা বের করে একটা নতুন জাতের পাট উদ্ভাবন করতে পারবেন, তখন কনকনে শীতেও পাট ফসলে মাঠ ভরে যাবে। আর বিজ্ঞানীরা চাইলে ঠাণ্ডা পানির পাট, লোনা পানির পাট, কম পানির পাট, চিকন সুতার পাট, শক্ত/নরম আঁশ উৎপাদনকারী পাট, পোকা/রোগ-নিরোধক পাট, ঔষধি পাট এমনকি রঙিন পাটের জাত পর্যন্ত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবেন ভবিষ্যতে। যেহেতু সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবেশের চাহিদার রূপ পাল্টিয়েছে তাই পুরনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে নতুনভাবে শুরু করা প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন ধবধবে পাট। যাতে বিøচ করার প্রয়োজন না হয় এবং লিগনিন কম থাকে, যার আঁশ হবে মানসম্পন্ন ও মিহি। তবে সমস্যা হলো পাট খুবই স্পর্শকাতর। পোকার আক্রমণ ও রোগবালাই সহ্য করতে পারে না। আবার এমন পাট আছে যে পোকার আক্রমণ সহ্য করতে পারে কিন্তু লিগনিন বেশি। পচাতে অনেক সময় লাগে। তাই শুরু হলো কম লিগনিন ওয়ালা পাটের খোঁজ করা। কিন্তু সেটা কোথায় পাওয়া যাবে? ধানের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই চিন্তা করা যায়, নিশ্চয়ই এমন পাট প্রকৃতিতে আছে যার দেহে লিগনিনের পরিমাণ কম। অতএব বিজ্ঞানীদের কাজ হবে একটির বৈশিষ্ট্য অন্যটিতে ঢুকিয়ে দেয়া। তবে তা করতে গিয়ে দেখা গেল ধানের মতো হাজার হাজার জাত পাটের নেই। পাটের আছে হাতেগোনা কয়েকটি জাত। পাটের জিন-নকশার সুবাদে পাট চাষকে বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ুর উপযোগী করে আঁশের সেরা মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে উন্নত মানের পাটের জাত উদ্ভাবন করে পাটের ফলন ও আঁশের মান বাড়িয়ে বিশ্বে পাটের বাজারে বাংলাদেশকে আবারো সুপ্রতিষ্ঠিত করা। উন্নত জাতের সুতা ও ওষুধ তৈরিতেও এ আবিষ্কার অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশেষ ধারণা। এত সব সম্ভাবনাকে জোড়া লাগালে একদিকে কৃষি ও কৃষকের বিকাশ, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির উজ্জ্বল ছবি অনুমান করা অসম্ভব কিছুই নয়। এখন তথ্যপ্রযুক্তি আর বায়োটেকনোলজির সহযোগিতায় বাংলাদেশের দিনবদলের নতুন অধ্যায় শুরু হবে। বিশ্বজুড়ে জৈব তথ্যপ্রযুক্তি খাত দ্রুত বড় ও শক্তিশালী হচ্ছে। জৈব তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিয়ে কেবল ভারতই প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ খাতে আয় আরো বেশি। বাংলাদেশেরও এ খাতে প্রবেশ করার সুযোগ এখন অপার। ড. মাকসুদুল আলমের এই আবিষ্কার পাটের রোগবালাই দমন করে বৈরী আবহাওয়ায় পাটকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে ফলে লাখ লাখ কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে। পাট সত্যিকার অর্থে আবারো সোনালি আঁশে পরিণত হবে। তবে এখন প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে প্রায়োগিক সাফল্য অর্জনের সব ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিশ্চিত করা। অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ কৃষি জিনোমিক্স ইনস্টিটিউট’ নামে একটি স্বতন্ত্র জিনোম গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ যার ফলে বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে উচ্চস্তরের গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে। শুরু হবে সব ধরনের ফসল, মৎস্য ও প্রাণীর নানাবিধ বিষয়ে জিনোম আবিষ্কারের গবেষণা। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশও কৃষি গবেষণায় অবদান রাখতে পারবে। ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম : পরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App