×

অর্থনীতি

সিন্ডিকেটের খপ্পরে শ্রমবাজার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ১১:০২ এএম

সিন্ডিকেটের খপ্পরে শ্রমবাজার

প্রতীকী ছবি।

সিন্ডিকেটের খপ্পরে শ্রমবাজার

প্রতীকী ছবি।

সিন্ডিকেটের খপ্পরে শ্রমবাজার

প্রতীকী ছবি

মালয়েশিয়ার কাটা জিটুজির মধ্যস্বত্বভোগী! প্রধানমন্ত্রীর আবুধাবি সফরে জনশক্তি রপ্তানি ইস্যু অগ্রাধিকার।

দক্ষ জনশক্তির অভাব ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সুখবর মিলছে না। কিছু নতুন বাজার সৃষ্টি হলেও পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মিলছে না কাক্সিক্ষত সুফল। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, বায়রা নানাভাবে চেষ্টা করলেও শ্রমবাজারের মন্দাভাব কাটছে না কিছুতেই। সিন্ডিকেট ও পদে পদে দুর্নীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে জগাখিচুড়ি অবস্থা। ফলে ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে সম্ভাবনার এ বাজার। তৈরি হচ্ছে না বিদেশিদের পছন্দের দক্ষ শ্রমিক। এর মধ্যে প্রতি মাসে বিদেশ থেকে ফিরছে শত শত শ্রমিক। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় গত বছর কমেছে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক রপ্তানি।

জানা গেছে, জিটুজি চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষ থাকায় দেশের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ; এ নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে সরকার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চলছে। আরো কয়েকটি দেশেও জনশক্তি রপ্তানি কার্যত বন্ধ রয়েছে।

এদিকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ থাকলেও অন্য ১২টি দেশের সঙ্গে তাদের জিটুজি চুক্তি রয়েছে। যাতে তারা বিনা পয়সার জনশক্তি নিচ্ছে এবং ওই সব দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠিয়ে জনপ্রতি ৫০০ ডলার করে কমিশন পাচ্ছে। অবশ্য মালয়েশিয়ায় বেস্টিনেট মালিকানাধীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনার ফ্ল্যাস্ক পরিচালিত এসপিপিএ সিস্টেম কালো তালিকাভুক্ত হলেও ফের ‘কাজ বাগাতে’ সিন্ডিকেট গড়ার সুযোগ খুঁজছে বলেও চাউর রয়েছে।

মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলা সেগারান সম্প্রতি বলেছেন, দু-একটি বিষয় ছাড়া বাংলাদেশ ১০-১২টি শর্তের প্রায় সবগুলোতে একমত হয়েছে। বাকি ২-১টি বিষয়ে একমত হতে পারলে মালয়েশিয়ার বাজার খুলে দেয়া হবে। এ জন্য বাংলাদেশকে

এগিয়ে আসতে হবে প্রথমে। মালয়েশিয়া সরকার চায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আসুক। তবে সেটা হবে একটি স্বচ্ছ মাধ্যম ও শ্রমিকবান্ধব। তার মতে, নেপাল থেকে বিনা খরচে শ্রমিকরা যেভাবে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে শর্ত পূরণ হলে বাংলাদেশ থেকেও শ্রমিকরা একইভবে মালয়েশিয়া যাবে।

অভিযোগ রয়েছে, মধ্যপাচ্যে শ্রমিক পাঠানোর আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) বা গালফ মেডিকেল কাউন্সিলের (গামকা) নির্ধারিত ৪৬টি স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের কতিপয় সদস্য দুর্নীতি করে আসছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, টাকা না হলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট উল্টে দিয়ে ‘আনফিট’ করা হয়! আবার রিপোর্টের ওপর ‘সাক্ষাৎ’ লেখা হলে অনুক‚ল রিপোর্ট পেতে গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। অবশ্য এ দেশে টাকা দিয়ে ‘ফিট রিপোর্ট’ নিয়ে পরে সৌদি আরব গেলে সেখানকার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আনফিট রিপোর্ট আসায় ওই শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে। অবশ্য অভিযোগ প্রসঙ্গে গামকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের একটি বনানীর আল গোফিলি মেডিকেল সেন্টার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সোবহান ভূঁইয়া বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠান আপাতত বন্ধ রয়েছে। তার দাবি, কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক এ ধরনের কাজে কোনোভাবেই জড়িত নয়। তবে কোনো অসাধু কর্মচারী এসব করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

অন্যদিকে শত শত রিক্রুটিং এজেন্সি থাকলেও জনশক্তি রপ্তানিতে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তাতে মন্ত্রী, সাংসদ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, বায়রা ও বিএমইটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম রয়েছে। আছে দেশি-বিদেশি দালাল চক্রও। তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিদেশের শ্রমবাজার।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভিবাসন কল্যাণ শাখা) ড. আহমেদ মনিরুশ সালেহীন বলেছেন, শ্রমবাজারে এখন মিশ্র অবস্থা চলছে। কখনো কোনোটা খুলে আবার কোনোটা স্থবির হয়। প্রধানমন্ত্রীর আবুধাবি সফরে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি এজেন্ডা হিসেবে রয়েছে। মালয়েশিয়ায় বাজার চালুর ব্যাপারে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানকার মানবসম্পদমন্ত্রী এ ব্যাপারে আগ্রহী। তারা বিনা পয়সায় শ্রমিক নিলে সরকার সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। যাতে বলা হয়েছে, নিয়োগকর্তা সব ব্যয় বহন করবে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, তারা কোনো সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দেয় না। মন্ত্রণালয় সবসময় শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে।

একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট) সাবিহা পারভীন বলেছেন, জাপান, চীনসহ অনেক দেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরি হচ্ছে। অনেক দেশে তাদের অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কিছু প্রভাব পড়লেও দেশে যেভাবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে; তাতে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তবে সিন্ডিকেট নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, নতুন শ্রমবাজারের কোনো সুনির্দিষ্ট খবর নেই। মালয়েশিয়ার বাজার খুলতে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। দক্ষ জনশক্তি গড়তে রিক্রুটিং এজেন্টদের সঙ্গে কাজ করছে বিএমইটি। বিশেষ করে নারী শ্রমিক তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ থাকার পরও গত বছর ৭ লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছে। আগামীতে জনশক্তি রপ্তানি আরো বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।

১ হাজার ৪০০ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেছেন, দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে। ফলে বিদেশে শ্রমবাজার সংকুচিত নয় বরং প্রশস্ত হবে। তিনি বলেন, শ্রমবাজার নিয়ে আর কোনো সিন্ডিকেট করতে দেয়া হবে না। অতীতে যা হয়েছে তাও ভেঙে গেছে। বায়রায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অভিযোগ স্বীকার করে তিনি বলেন, সব সংগঠনে কমবেশি গ্রুপিং রয়েছে।

সরকারি হিসাব মতে, প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি অভিবাসী বিশে^র ১৬২টি দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, লেবানন, জর্ডান ও লিবিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি সীমাবদ্ধ। এর বাইরে অন্য দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা গেলেও তার হার অনেক কম। শ্রমবাজার সম্প্রসারণের চেষ্টার অংশ হিসেবে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, পশ্চিম ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ব্রাজিল, ইতালি ও সুইডেনে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার আরব আমিরাত উন্মুক্ত হয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আগে থেকেই দেশটিতে প্রায় ২৪ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান মতে, গত বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিশে^র বিভিন্ন দেশে শ্রমিক গেছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৪ হাজার ৭১৩ জন শ্রমিক গেছেন সৌদি আরবে। পরের অবস্থানে আছে জর্ডান। দেশটিতে গেছে ১২ হাজার ১২৩ জন। ওমানে গেছে ৭ হাজার ৯২৭ জন। আর কাতারে গেছে দুই হাজার ৫২৩ জন। ওই ৮ মাসে বিদেশে যত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে তার মধ্যে ৭১ হাজার ৯৪৫ জন নারী শ্রমিক।

[caption id="attachment_195091" align="aligncenter" width="700"] প্রতীকী ছবি[/caption]

গত বছরের জানুয়ারিতে ৫৯ হাজার ৩৭ জন শ্রমিক বিদেশে যান। মার্চ মাস পর্যন্ত ওই ধারা অব্যাহত থাকে। এপ্রিল ও মে মাসে বেড়ে আগের অবস্থায় ফিরে। কিন্তু জুন মাসে তা আবার কমে যায়। জুলাই মাসে বেড়ে ৫২ হাজার ৫৮ জনে দাঁড়ায়। কিন্তু ১ মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ আগস্ট মাসে কমে ৩২ হাজার ২৭২ জনে ঠেকে। অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট ১ মাসের ব্যবধানে ২০ হাজার শ্রমিক রপ্তানি কমেছে। অথচ ২ বছর আগেও বাংলাদেশ থেকে এক বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল। এখন তা কমে গড়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। লিবিয়া, কাতার, ওমান, জর্ডান, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের বাজার কার্যত বন্ধ রয়েছে। সৌদির বাজার খোলা থাকলেও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এর সুফল মিলছে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সভাপতি শাহ মো. আবু জাফর বলেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজার এখন দালালের খপ্পড়ে পড়েছে। সেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। সৌদিতে বৈধভাবে শ্রমিক যাচ্ছে না। দালাল চক্র নানান কায়দায় কিছু লোক পাঠাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, ওমান, দুবাই, কাতারসহ সব দেশে শ্রমবাজার খারাপ। ইউরোপে কোনো শ্রম বাজার কখনো ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে স্টুডেন্ট ভিসা বা বৃত্তি নিয়ে সে সব দেশে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে জনশক্তি রপ্তানি শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ১৭০টি দেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত ও দুবাই এবং পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্রæনাইয়ে বাংলাদেশের জনশক্তি রয়েছে। ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ দিয়ে যে সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তা ভেঙে দেয় মালয়েশিয়ার নতুন সরকার। যাতে বন্ধ হয়ে যায় ওই দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।

মালয়েশিয়ার তৎকালীন ফার্স্ট লেডি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) বা সরকার থেকে সরকার যে চুক্তি হয়েছিল তাতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। দাতো শ্রী আমিন নামের এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশীয় এতে মধ্যস্বত্বভোগী ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রুহুল আমীন স্বপন নামের আরেকজন। দেশের রিক্রুটিং এজেন্ট সিন্ডিকেট ও মালয়েশীয় চক্র মিলে হাতিয়েছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। অথচ জিটুজি মানে সরাসরি সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হওয়ার কথা। মাঝখানে কারো থাকার কথা নয়। এ অবস্থায় চুক্তি বাতিল হওয়ায় মালয়েশিয়ায় যাওয়া কয়েক হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App