×

রাজনীতি

বিতর্কে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২০, ১০:১৮ এএম

বিতর্কে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গতকাল প্রচারণায় নামেন চার মেয়র প্রার্থী। দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত শেখ ফজলে নূর তাপস, স্বামীবাগ এলাকায়, বিএনপির ইশরাক হোসেন কমলাপুরে এবং উত্তরে আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম মিরপুর ও বিএনপির তাবিথ আউয়াল উত্তরার আজমপুরে গণসংযোগ করেন। ছবি: ভোরের কাগজ। 

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উতাল হাওয়ার মধ্যেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো। প্রতীক বরাদ্দের পরপরই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অবশ্য দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ‘নির্বাচন-নির্বাচন খেলা’র অভিযোগ করে আসছে শুরু থেকেই। আর ঘরে-বাইরে চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী দুই দলের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার মন্তব্য। তিনি গতকাল বলেন, সিটি নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী সমন্বয়ক হতে পারবেন না এমপিরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সিইসির এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এমপিদের নির্বাচনের সমন্বয়ক হতে বাধা নেই। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারায় এমপি শব্দটিও উল্লেখ নেই।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, ২০১৬ এর ২২ এর ১ উপধারা অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। এই ধারা উল্লেখ করে আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ নৌকার প্রার্থীদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন সিইসি নুরুল হুদা। নির্বাচন কমিশন ভবনে গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে এমপিদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকতে পারবে না। নির্বাচনের কোনো সমন্বয়ও তারা করতে পারবেন না। বিধিতে সেভাবেই বলা আছে। তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমুকে সমন্বয়ক করে গঠিত কমিটি বৈধ কিনা এই প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এটা আমি বলতে পারব না। আমার কাছে অফিসিয়ালি কিছু আসেনি। কারা এই কমিটির মধ্যে আছে, এটা আমরা জানি না। তিনি বলেন, এমপিরা সবই করতে পারবেন। শুধু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা, কোনো প্রচারণা এবং নির্বাচনী কার্যক্রম করতে পারবেন না। এখানে নির্বাচনের বাইরে যে কাজ, সেখান থেকে নিষ্ক্রিয় করার সুযোগ আমাদের নেই। প্রার্থীর সঙ্গে প্রচারে এমপিরা থাকতে পারবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আইনে তো তেমন কোনো বাধা-নিষেধ নেই। এমপিরা যেতে পারবেন, তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হবে না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড- যেমন মুজিববর্ষ পালন হচ্ছে, সেখানে যে কোনো সভা-সমাবেশের আয়োজন হতে পারে, সেখানে তো সবাই যেতে পারবেন। শুধু ভোট চাইতে পারবেন না।

তবে সিইসির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া ছাড়া সবই করতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। জাতীয় সংসদ সদস্যরা কিন্তু সুবিধাভোগী নন। সুবিধাভোগী হলো অফিস অব প্রফিট- যেটা আমরা এমপিরা পাই না। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, হুইপ পান। আমরা নই। তিনি বলেন, শেখ সেলিম সাবেক মন্ত্রী, মাহবুব-উল আলম এরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আব্বাস, গয়েশ্বর সাবেক মন্ত্রী। এরা প্রত্যেকেই মন্ত্রী ছিলেন। তারাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মওদুদ তো এক সময় প্রধানমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আচরণ বিধির এ ব্যাখ্যার মধ্যেই সবিরোধিতা আছে। আমাদের ব্যাখ্যায় ইসি একমত হয়েছে। কিন্তু তারা বলেছে, আমাদের কিছু করার নেই। এখন যদি বিধি সংশোধন করা হয়, মানুষের চোখে সরকারের জন্য ভালো হবে না। আমাদের চোখেও এটা ভালো হবে না। কিন্তু আপনাদের বক্তব্যটা ঠিক। তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা ঘরোয়াভাবে অফিসে মিটিং করতে পারব। আমরা একটা মহল্লায় গিয়ে ঘরের মধ্যে মিটিং করতে পারব। সেগুলোতে কোনো বাধা নেই।

বিশ্লেষজ্ঞদের মতে, বিধিমালার এই ধারাটির স্পষ্ট ব্যাখা না থাকায় দ্ব›দ্ব রয়ে গেছে। জানতে চাইলে আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক ভোরের কাগজকে বলেন, প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কি না- এ নিয়ে ইসির স্পষ্ট বক্তব্য কাম্য। তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বৈঠক, আলাপ-আলোচনায় সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ আইনের ব্যতয় ঘটাবে। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, নির্বাচনের সমন্বয়ক তো পার্টির বিষয়। এটি ইসির দেখার বিষয় নয়। কারণ ইসি সমন্বয়কের স্বাক্ষরিত কোনো কাগজপত্র বা ফাইল গ্রহণ করে না। আর আচরণ বিধিমালাতে কোথাও এমপিদের বিষয়ে কোনো বাধা নেই। স্পিকার, মন্ত্রী, সমপর্যায় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এমপিরা মন্ত্রীদের মতো সুবিধা পান না। তবে সিইসি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার পর আওয়ামী লীগের উচিত হবে অন্যদের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া- এমন মন্তব্য করেছেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ চেয়ারম্যান ও রংপুর বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারে রয়েছে, তাই সিইসির বক্তব্য মেনে নেয়াই উত্তম। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনার জন্য তাদের অসংখ্য দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন। আর এ মুহুর্তে বিধিমালা পরিবর্তন করাও অসম্ভব। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।

আইন বাতিল চায় ১৪ দল : এদিকে এমপিদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আইনের বাধাকে দুঃখজনক আখ্যায়িত করে এই আইনের বাতিল চায় ১৪ দল। গতকাল ধানমন্ডিতে ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, একজন কাউন্সিলরপ্রার্থী যিনি সংসদ নির্বাচনের সময় এমপির পক্ষে কাজ করেছেন, এখন সেই এমপি তার নির্বাচনে রিটার্ন দিতে পারবে না। এটা নাগরিক অধিকার খর্ব করার জন্য করা হয়েছে। সাবেক এমপিরা প্রচার চালাতে পারলে বর্তমান এমপিরা পারবে না, এটা কোনো কথা হলো না। এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো কীভাবে? এই আইন বাতিল করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। এটা স্থানীয় নির্বাচন হলেও এই নির্বাচনকে অরাজনৈতিক নির্বাচন বলার সুযোগ নেই। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমরা মনে করি, সংসদে এই আইনটি পরিবর্তন করা দরকার। যেহেতু ইসির আইন আছে আমরা সেটা মেনেই চলছি। উত্তরে শেখ শহিদুল ইসলাম ও দক্ষিণে দিলীপ বড়ুয়াকে নির্বাচনী সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছে ১৪ দল।

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির আহ্বান বিএনপির : মন্ত্রিত্ব ছেড়ে ওবায়দুল কাদেরকে ঢাকার সিটি নির্বাচনে প্রচারে অংশ নেয়ার চ্যালেঞ্জ দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আসুন- আপনি নৌকার জন্য করেন, আমি ধানের শীষের জন্য করি। লেট আস ফেইস দ্য চ্যালেঞ্জ। দেখা যাক, জনগণ কার দিকে থাকে। নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আজকে ক্ষমতা থেকে নেমে আসুন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করুন। একটা নিরপেক্ষ সরকার বসিয়ে দেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন করুক। সেই নির্বাচনে যদি আপনারা জেতেন, মাথা পেতে নেব। কিন্তু আপনারা জানেন, সেটা কোনোদিন হবে না। সে জন্য কৌশল করে বিভিন্নভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করছেন। এটা কখনোই জনগণ মেনে নেবে না। নির্বাচন-নির্বাচন খেলা করছেন, আমরা জানি। এরপরও আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি খুব পরিষ্কার করে বলেছি- আমাদের গণতন্ত্রের মুক্তি ও খালেদা জিয়ার মুক্তির সংগ্রামের আন্দোলনের একটা হাতিয়ার হিসেবে আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App