×

মুক্তচিন্তা

প্রবীণদের নিয়ে আমরা কতটা ভাবছি?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:২৮ পিএম

একটি ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। সেটি হলো, প্রবীণদের সবাই কর্ম-অনুপযোগী নন। তাদের অনেকেরই এখনো কাজ করার শক্তি বা মানসিকতা আছে। এসব কর্মক্ষম প্রবীণকে অন্তত স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে যুক্ত করা যায়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ নিয়ে ভাবতে পারে, ভাবতে পারে সরকারও। তাতে প্রবীণের শরীর মন দুই-ই ভালো থাকবে।

গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দেশে প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে হয়তো তাদের দুর্ভোগ। সামাজিক পরিবর্তন ও যুগের ঘাত-প্রতিঘাত এ রকম দুর্ভোগ সৃষ্টির কারণ হবে। পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় আনুক‚ল্য এবং পরিবার ও সমাজের সহৃদয়তা ব্যতীত এর প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সরকার বিষয়টি নিয়ে একেবারেই ভাবিত না এ কথা বলব না। বয়স্কভাতার প্রচলন প্রমাণ করে সরকারি মহল প্রবীণদের সমস্যাদি নিয়ে সীমিত পরিসরে হলেও ভাবছে। সীমিত বলা এ কারণে যে, ঘোষিত ভাতার পরিমাণ খুবই স্বল্প আর প্রাপকের সংখ্যাও অতি নগণ্য। এখানে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরোত্তর সুবিধার কথা না তুললেও চলে, কেননা এ প্রথা আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। বর্তমান সরকার তা বৃদ্ধি করে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে সুবিধাদি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের সর্বস্তরে প্রসারের উদ্যোগ নিলে তারা আরো বেশি প্রশংসিত হবেন। বুঝতে পারছি যে কাজটি সহজ নয়; বয়োবৃদ্ধ সবাইকে সুবিধার আওতায় আনা কঠিন কাজ, এর সঙ্গে সক্ষমতার প্রশ্নও যুক্ত। সে বিবেচনা থেকে অন্তত শুরুটা দেখতে পাওয়াও প্রশান্তিজনক হবে। শুনে আসছি ২০১৩ সালেই সরকার ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। সেগুলো হলো- তাদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও পরিবহনের ব্যবস্থা। কিছু বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ ছাড়া এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।

প্রবীণদের সমস্যা নানামুখী। সাধারণ মানুষের সমস্যা আর প্রবীণের সমস্যা এক প্রকার নয়। সে কারণেই তাদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দরকার। অর্থনৈতিক টানাপড়েন মুখ্য তো বটেই, তবে সেটি দূর একমাত্র করণীয় নয়। অর্থনৈতিক টানাপড়েন প্রায় সবার জন্যই অবধারিত হয়ে উঠে এ কারণে যে, পরিবারের দায়িত্ব পালন শেষে জীবনের শেষ প্রান্তে নিজের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। থাকলেও তার জিম্মাদারি হারান স্বজনদের কাছে। নিজের গচ্ছিত সম্পদ চেয়েচিন্তে নিতে হয় সেই স্বজনদের কাছ থেকে অনেকটা অপ্রিয় হয়ে, কখনোবা নেয়াই যায় না।

হাহাকারে পুড়তে হয় তখন। অর্থনৈতিক এই বিরূপ বাস্তবতা ছাড়াও প্রবীণদের জীবন জটিল সব সমস্যায় আক্রান্ত থাকে সব সময়। জরাজীর্ণ জীবনে রোগব্যাধির বাসা থাকে সর্বকালীন, থাকে দুঃসহ একাকিত্বের কশাঘাত, অবহেলা-অযতে্নর নির্মমতা নিয়তি হয়ে ওঠে। এ রকম বহুবিধ সমস্যায় ভুগতে হয় তাদের। দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে প্রাগোক্ত সমস্যাদির বিপরীতে যৎকিঞ্চিত সুবিধা তাদের প্রাপ্য। একে অধিকার বললেও অত্যুক্তি হবে না। উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের সে অধিকার নিশ্চিত করা হয়। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত তাতে হাতই দেয়া হচ্ছে না বলতে গেলে। আমরা উন্নয়নের পথযাত্রী দাবি করছি, কিন্তু উন্নয়নমুখো যাত্রায় প্রবীণদের ঠাঁই দিচ্ছি না- এটি অন্যায্য। তাদের প্রতি আনুক‚ল্য প্রদর্শনের দায়িত্ব বিবেকতাড়িত হওয়া উচিত সব মহলে।

প্রবীণদের নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন কেন- এর জবাব খুঁজতে গিয়ে দৃষ্টিকে সামান্য প্রসারিত করলেই চলে। স্মরণ করা যায়; তারা নিজেদের সামর্থ্যরে সবটুকু ঢেলে আমাদের লালন-পালন করেছেন, দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করে গেছেন। তাদের সবার অবদানের সমষ্টি আজকের এই জাতীয় অগ্রযাত্রা। আজ যারা নবীন কাল তারা প্রবীণ হবেন, এ ভাবনাটা মনে গাঁথলে প্রবীণদের জন্য করণীয়বোধ জাগ্রত হবে। বয়োবৃদ্ধদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন চিকিৎসা সুবিধা। সেই সুবিধা হওয়া উচিত বিনামূল্য কিংবা সাশ্রয়ী মূল্যের। বৃদ্ধ বয়সে অর্থের টানাপড়েন থাকে প্রায় সবারই। তা ছাড়া বার্ধক্যজনিত সমস্যা মনে করে কোনো কোনো পরিবার চিকিৎসার ব্যাপারে হেলাফেলা করে, অর্থব্যয়কে নিরর্থক ভাবে। গরিব পরিবার তো বৃদ্ধদের চিকিৎসা নিয়ে ভাবেই না, সামর্থ্যরে অভাবে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না তাদের। প্রতিকারস্বরূপ রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদিতে প্রবীণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রবীণ কর্নার, আলাদা বেড ইত্যাদি সুবিধাসংবলিত বিশেষ ব্যবস্থা সরকারি নির্দেশনায় সহজেই করা যায়।

একইরকমভাবে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যদি সরকারের তরফ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসার নির্দেশনা পায় তাহলে আশা করা যায় তারা সেই নির্দেশ মেনে চলবে। চিকিৎসকরা এ মাটিরই সন্তান, তারা যদি প্রবীণদের কাছ থেকে পরামর্শক ফি কমিয়ে নেয়ার নির্দেশনা পান নিশ্চয়ই তা মেনে চলবেন। চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ এ ব্যাপারে নিজেরাই উদ্যোগ নিতে পারে। উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসার বন্দোবস্ত আছে বলে শুনেছি। আমাদের দেশে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো বিশেষায়িত বিভাগ। সাধারণ ডাক্তাররাই প্রবীণদের চিকিৎসা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেন প্রবীণ রোগীদের। এদিকে দৃষ্টি দেয়ার অনুরোধ করি নীতিনির্ধারকদের।

প্রবীণদের আনাগোনা বেশি এ রকম বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে তাদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা ভাবা যায়, যার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই করতে পারে। বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার গণপরিবহনে। দূরপাল্লার যাতায়াত-ভ্রমণে আসন বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং রাজধানীসহ বড় শহরে বাস যাতায়াতে প্রবীণদের জন্য আসন সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা হবে। একই সঙ্গে তাদের যদি কিছুটা মূল্যছাড়-সুবিধা দেয়া যায় তো আরো ভালো। চিত্তের প্রফুল্লতার জন্য ভ্রমণ খুব কার্যকর। এ ব্যাপারে কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দেয়া গেলে সেটা টনিকের কাজ করবে। আমরা যদি নিজেদের একটি অগ্রসর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই তাহলে অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও সামনে আনতে হবে।

নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব প্রবীণদের প্রধানতম সমস্যা। এ সমস্যা দিন দিন প্রবল হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন বহু সদস্যের একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস ছিল তাদের। পরিজনবেষ্টিত থাকার কারণে তাদের মধ্যে তখন একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতাবোধ প্রবল হতো না। পরিচর্যার মানুষেরও অভাব থাকত না। সেদিন বিগতপ্রায়। পরিবারের সদস্যসংখ্যা কমছে, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে খানখান হচ্ছে। কার্যব্যাপদেশে সুদূরে, এমনকি বিদেশে অবস্থানরত একেকজন। ফলে প্রবীণ এখন আরো বেশি সমস্যাগ্রস্ত। তাকে সঙ্গ দেয়ার লোক নেই, নেই পরিচর্যার লোক। এর পরিত্রাণ কীভাবে হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে তার উপায় বের করতে হবে। তবে পরিবারের ভ‚মিকা এখানে মুখ্য বিবেচনা করি। বিত্তবান অনেক পরিবার আছে যাদের সব সদস্য বিদেশে থাকেন, বাবা-মাকে করে রাখেন দেশের সম্পত্তি দেখভালের কেয়ারটেকার। এমনটি অনুচিত।

প্রবীণদের ব্যাপারে আমাদের সার্বিক যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে গলদ আছে। তাদের যথাযথ সম্মান দেয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা হয়। স্মরণই করা হয় না যে এরা দেশ ও জাতিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আজকের যারা প্রবীণ তাদের বেশিরভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের সে অবদানকে আমলে নেয়া হয় না। অতীতে আমাদের দেশটি দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত ছিল। শত প্রতিবন্ধকতা পায়ে দলে, নিজেরা আধপেটা খেয়ে সন্তানদের তারা বড় করেছেন। সেটিও ভুলে যান পরিবারের অনেক সদস্য। বেদনার বিষয় এটি। জাতিগত ঐতিহ্য ও মূল্যবোধবিরোধী আচরণও বটে।

দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মর্যাদার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত। তাদের বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে তারা সম্মানিত বোধ করবেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চিত্তের প্রফুল্লতা বাড়ায়। এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রবীণদের উপস্থিতি উৎসাহিত করলে তারা প্রাণবন্ত থাকবেন। সমাজে প্রবীণদের সম্মানজনক অবস্থানের জন্য একটা সামাজিক উদ্যোগ দরকার। অপেক্ষাকৃত নবীনরা এ উদ্যোগে শামিল হলে সমাজের জন্য শুভকর হবে। এ ধরনের উদ্যোগে গণমাধ্যমের সহযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। আশা করি তার সূচনা হবে।

প্রসঙ্গক্রমে একটি ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। সেটি হলো, প্রবীণদের সবাই কর্ম-অনুপযোগী নন। তাদের অনেকেরই এখনো কাজ করার শক্তি বা মানসিকতা আছে। এসব কর্মক্ষম প্রবীণকে অন্তত স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে যুক্ত করা যায়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ নিয়ে ভাবতে পারে, ভাবতে পারে সরকারও। তাতে প্রবীণের শরীর মন দুই-ই ভালো থাকবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App