×

মুক্তচিন্তা

সুশাসনের পক্ষে কিছু চ্যালেঞ্জ-মোকাবেলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০৮ পিএম

বর্ষ বিবেচনায় ২০২০ সরকারের সামনে, সমাজের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে। তা যেমন নৈতিক, আদর্শিক, তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিক। স্বভাবতই এগুলোর কিছুটা হলেও সফল মোকাবেলা করতে না পারলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা প্রবৃদ্ধিকে নেতিবাচকতায় প্রভাবিত করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার ওপর ভরসা রাখুন।’ বলেছেন দুর্নীতি দমন সম্পর্কে। মানুষ তা বিশ্বাস করেই দেখতে চাইবে সরকারি তৎপরতার ফলাফল, যেখানে দলীয় পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। দলের স্বার্থেই সরকারকে এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তৎপর হতে হবে।

বিগত ২০১৯ সালটা অনেক অঘটন ঘটিয়ে শেষ হলো। সেসব ঘটনা যেমন রাজনৈতিক তেমনি সামাজিক-অর্থনৈতিক। চলমান ২০২০ সালের জন্য রেখে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জের উপহার ক্ষমতাসীন শাসকদের জন্য। সেগুলোর সমাধান দূরে থাক সফল মোকাবেলায় কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য কাউকে যদি সেসব পাশ কাটিয়ে চলতে হয় তা অবশ্য আলাদা কথা।

ইতোপূর্বে লেখা চ্যালেঞ্জগুলোর বাইরে মূল যে সমস্যা শুধু চলমান বছরটিকেই নয়, পরবর্তী সময়কেও বিরূপতা বা নেতিবাচকতায় স্পর্শ করতে পারে তা চরিত্র বিচারে আর্থসামাজিক, সেইসঙ্গে শিক্ষা ও প্রযুক্তিগতও বটে। এ দিকটিতে গুরুত্ব দেয়া না হলে ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট সমস্যা তৈরির পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সেইসঙ্গে চাপ সৃষ্টি করবে দুয়েকটি কঠিন সমস্যা যা দীর্ঘস্থায়ী ও জনসংখ্যাগত সে প্রভাব ছড়াবে সমাজে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার বিপরীত ধারায়।

জনসংখ্যা স্ফীতির সামাজিক সমস্যার দিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না, যদিও রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ দেশ চীন এ ইস্যুটিকে যথাযথ গুরুত্বের ব্যবস্থা নিয়ে সুফল পেয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির ভূখণ্ড বাংলাদেশে গত শতকের ষাটের দশকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সে সুফল দেখা দিতে শুরু করে তার ধারাবাহিকতা অনুরূপ গুরুত্বে রক্ষা করা হয়নি। হয়নি এ সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন মন্ত্রণালয় গঠন সত্ত্বেও।

ফলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অশনি সংকেত জানিয়ে বেড়ে চলেছে। যথারীতি সেইসঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থানের অভাব তথা বেকারত্ব। এই বেকারত্বের সঙ্গে জড়িত একাধিক সামাজিক সমস্যা, তা যেমন নীতি-নৈতিকতার, তেমনি বেপরোয়া মনোভাবজনিত সামাজিক বিশৃঙ্খলার। ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমানোর মতো ঘটনাবলি তথা অঘটনও এসবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় শিক্ষা খাতের সাধারণ বিস্তার এমনকি সাধারণ মাত্রার প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও দক্ষতা যেহেতু সে হিসেবে সমস্যা মোকাবেলার উপযোগী মাত্রায় বাড়েনি তাই অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। একাধিক উদাহরণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে রেমিট্যান্স খাতে ব্যক্তিক-পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি।

এর অনৈতিক, ট্র্যাজিক পরিণাম বহুদিন থেকে শুরু হলেও কিছুদিন থেকে বিস্ফোরক পর্যায়ে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব আগত নির্যাতিত অদক্ষ গৃহকর্মীদের কান্না, বেদনা ও পারিবারিক জটিলতা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বা সৌদিতে বাংলাদেশি দূতাবাসের ওই বিপর্যয় মোকাবেলায় বড় একটা সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না। দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকার তরুণী বা গৃহবধূ বা অন্তঃসত্ত্বাদের সমস্যা প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে সব দিক থেকেই উদাসীনতা প্রকট। অনেক সমালোচনা, অনেক লেখালেখির পরও সৌদি আরবে অদক্ষ নারী গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কঠোর নীতি ও ব্যবস্থা কোনোটাই কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে নারী গৃহকর্মীদের দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা বাড়ছে। সে যন্ত্রণা যেমন দৈহিক তেমনি মানসিক। এর পারিবারিক জটিলতা কম নয়। এ বিষয়ে সরকারি কঠোরতা কাম্য।

একই রকম কারণে অর্থাৎ বেকারত্ব, হতাশা, অর্থনেতিক সমস্যা যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে চলেছে তার অন্তত কিছু আলামত তো নারী নির্যাতন-হত্যা, শিশুকন্যা ধর্ষণ ও হত্যার ক্রমবর্ধমান ঘটনা। এর বিস্তার শহর থেকে গ্রামে। নারীর জন্য নিরাপদ স্থানের বড় অভাব। কর্মস্থল থেকে শিক্ষায়তন, এমনকি মাদ্রাসা। এই তো ঘটে গেল কুর্মিটোলায় বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা- যেন গত বছরের ধারাবাহিকতা রক্ষায়।

সমাজে অশিক্ষা যত বাড়বে, কারিগরি দক্ষতার সংখ্যা যত কমবে, জনসংখ্যা যত নিয়ন্ত্রণহীন হতে থাকবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নীতিহীনতা, অবৈধ কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতি সেই পরিমাণে বেড়ে চলবে। ভবিষ্যৎ সময়কে তৈরি থাকতে হবে আর্থসামাজিক নৈরাজ্য এবং একটি বিশৃঙ্খল সমাজের জন্য যে সমাজে অপরাধ প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। এমন অবস্থা কারো কাম্য হতে পারে না- কী রাজনীতিবিদ বা শাসকশ্রেণি বা সমাজচিন্তক শ্রেণির কোনো মানুষের।

অশিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতা, সর্বোপরি দুর্নীতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে রাষ্ট্রের জন্য, সমাজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ এর ফলে সব রকমের সুস্থ ও শুভ মূল্যবোধের বিনাশ ঘটে। একমুখী অর্থনৈতিক উন্নতি বা প্রবৃদ্ধি এর অশুভ পরিণাম রোধ করতে পারে না। সে জন্যই উল্লিখিত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিক বিবেচনায় রাখা ক্ষমতাসীন যে কোনো দলের শাসকের জন্য অপরিহার্য।

রুটি-রুজি মানুষের শুধু মৌলিক অধিকারই নয়, যা মেটানোর দায় রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রযন্ত্রের। এর অভাব মানুষকে মনুষ্যত্বহীন করে তোলার পক্ষেও এক ধরনের চালিকা। এ চ্যালেঞ্জ যে কোনো দেশ, যে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে মেটানোর দায় অপরিহার্য হিসেবে বিবেচ্য, তা সে দেশ উন্নত বা উন্নয়নশীল যে শ্রেণিরই হোক।

দুই. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে তাই যে কোনো সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে বহুকথিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিরতা তথা স্থিতিশীলতাও খুব জরুরি, এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। আর অর্থনীতির দৃঢ় ভিত্তির প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয় ও তৎপরতা একই মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বহুকথিত উক্তি- দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিনাশ ঘটায়। উন্নয়নকে সমাজে সর্বজনীন হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে।

হয়তো তাই শাসক কর্তৃপক্ষ থেকে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় দুর্নীতি মোকাবেলার কথা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার কথা। বিগত বছরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পেঁয়াজ নিয়ে মুনাফাবাজি (যা এখনো বিদ্যমান) এবং ভোগ্যপণ্য নিয়ে একই ধরনের কারসাজি সেসব অশুভ তৎপরতা কঠোরহস্তে দমনের পক্ষেই রায় দেয়। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার প্রশাসনিক দুর্বলতা কাম্য নয়। শুধু ২০২০ সালই নয়, পরবর্তী বছরগুলোতেও এগুলো স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হিসেবে মাথা উঁচিয়ে থাকবে যে কোনো প্রকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। কিন্তু পাশাপাশি আর্থসামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সমস্যাও বাংলাদেশের দিকে কাঁটার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তা হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু এবং তা নিয়ে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর নানা ধরনের রাজনৈতিক চাতুর্য যা বাংলাদেশের মানবিক চেতনাকে প্রতারিত করে চলেছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী মিত্র দেশেরও আন্তরিক সহায়তা পাচ্ছে না, পাচ্ছে শুধু মৌখিক আশ্বাস।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের এক ক‚টনীতিক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এই বলে যে, এ সমস্যা আঞ্চলিক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের জন্য। এর রয়েছে আন্তর্জাতিক চরিত্র। আমরা একাধিকবার লিখেছি রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশি সমাজে অভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা, যা একাধিক মাত্রার। একাধিক ঘটনা এর আন্তর্জাতিক চরিত্র প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক সমস্যার মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করছে, যা এ বছরেও ক্ষমতাসীন সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্বে আমলে নেয়া দরকার। সমস্যার সমাধানে যত সময় যাবে, এর জট তত কঠিন হতে থাকবে। এ অপ্রিয় সত্যটি যেন সরকার মাথায় রাখে।

বর্ষ বিবেচনায় ২০২০ সরকারের সামনে, সমাজের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে। তা যেমন নৈতিক, আদর্শিক, তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিক। স্বভাবতই এগুলোর কিছুটা হলেও সফল মোকাবেলা করতে না পারলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা প্রবৃদ্ধিকে নেতিবাচকতায় প্রভাবিত করবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার ওপর ভরসা রাখুন।’ বলেছেন দুর্নীতি দমন সম্পর্কে। মানুষ তা বিশ্বাস করেই দেখতে চাইবে সরকারি তৎপরতার ফলাফল, যেখানে দলীয় পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। দলের স্বার্থেই সরকারকে এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তৎপর হতে হবে। আর সেক্ষেত্রে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলোকে সরকারের নিরপেক্ষভাবে আমলে আনতে হবে এবং তা সুশাসনের ভিত গড়ার লক্ষ্যে।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App