×

রাজনীতি

‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২০, ০৪:৪৪ পিএম

‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’

স্বদেশে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ছবি: ফাইল।

‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’

স্বদেশে ফিরে ভাষণ দিতে গিয়েও কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ছবি: ফাইল।

‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’

স্বদেশে ফিরে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময়ও কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ছবি: ফাইল।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও বঙ্গবন্ধু তখনো বন্দী ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে। দেশ-বিদেশে চলছিল বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। তাকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার ইতিহাস- সবকিছুই ছিল অসম্পূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতাকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখে। বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্য মুক্তির যুদ্ধ করছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপে পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে কাটানোর পর লন্ডন-দিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছান ১০ জানুয়ারি। সেদিন বাংলাদেশে ছিল উৎসবের আমেজ। পূর্ণতা পেয়েছিল অর্জিত স্বাধীনতা আর বিজয়। বঙ্গবন্ধুর জন্য গোটা বাঙালি জাতির সে কি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা! বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যার কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই ময়দানেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বজ্রকণ্ঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি ছিল ১৮ মিনিটের। আর ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তিনি প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতে বলেছিলেন,
‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাই, পুলিশ, জনগণ, হিন্দু, মুসলমান যাদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আপনাদের কাছে দুই একটা কথা বলতে চাই।’ আবেগের আতিশয্যে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ।’
ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘আমার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না।’ কত বড় দার্শনিক কথা! ‘বাঙালি’ এবং ‘মুসলমান’।
সিরাজউদ্দৌলাকে বলা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। কিন্তু জনগণকে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। বলা হয়ে থাকে, পলাশীর প্রান্তরে চারপাশের প্রতিটি লোক যদি একটি করে ইটও সেদিন ছুঁড়তো তাহলে লর্ড ক্লাইভের দখলদার বাহিনীর পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হতো না। তাই, বাংলা নামের যে দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার প্রকৃত রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। [caption id="attachment_194442" align="aligncenter" width="700"] স্বদেশে ফিরে ভাষণ দিতে গিয়েও কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ছবি: ফাইল।[/caption] ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই সত্তা যাকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সোহরাওয়ার্দীর মতো মহান ব্যক্তিরা নিজের মতো করে আকার দিয়েছেন। সেই স্বপ্নেরই এক কঠিন সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল গুরুদায়িত্ব। তার হাতেই পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনকে সামনে রেখে ১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র (শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী আবেদন) প্রকাশিত হয়। এর এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ‘শেরে বাংলা আজ পরলোকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নাই। যাঁরা প্রবীণতার দাবি করেছেন তাঁদের অধিকাংশই হয় ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণির বাঙালি-বিদ্বেষীদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিতে তল্পীবাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন; নয়তো নিষ্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন এবং অন্যের সলা-পরামর্শে বশীভূত হয়ে কথা ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরই কথা বলতে হবে। তাদের চাওয়া ও পাওয়ার স্বার্থক রূপদানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে।’ ইতিহাস চর্চা থেকে বেরিয়ে একেবারে সাদামাটাভাবেও বলা যায়, বাঙালি হয়ে আমরা সবাই বাংলা নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন করি। বৈশাখী মেলায় যাই। এই সংস্কৃতি বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যেরই অংশ। আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান হিসেবে আমরা ঈদ, পূজা, পূর্ণিমা কিংবা বড়দিন উদযাপন করে থাকি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে মুসলমান হয়েও বাঙালি হিসেবে আমরা মন্দিরে যাই। প্রসাদ নিই। বন্ধু হিসেবে তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করি। তাইতো বলা হয়ে থাকে ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কখনো কখনো ঈদ, পূজায় আমরা হয়তো ভাগ হয়ে যাই। যার যার মতো করে উৎসব পালন করি। কিন্তু বৈশাখের প্রথমদিন, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে সবাই এক হয়ে যাই। কারণ ওই দিনগুলোতে আমরা হিন্দু-মুসলিম থাকি না, বাঙালি হয়ে যাই; দেশটা হয়ে যায় সবার। ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম / আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...।’ এর চেয়ে সুন্দর কথা কি হতে পারে! হিন্দু অধ্যুষিত বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফেরার পথে দিল্লির প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার সংক্ষিপ্ত ও মর্মস্পর্শী ভাষণের এক জায়গায় বলেছিলেন,
‘আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি-এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল।’
বংশ পরম্পরায় বাগদাদের দরবেশ বংশের উত্তরাধিকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার বাবা-মা ছিলেন ধার্মিক মানুষ। মানুষের নিজ নিজ ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তার ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল রাসুল (সা.) এর মদিনা সনদের শিক্ষার অনুসরণে। ‘মদিনা ইহুদি-নাসারা, পৌত্তলিক ও মুসলমান সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’ [caption id="attachment_194445" align="aligncenter" width="700"] স্বদেশে ফিরে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময়ও কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ছবি: ফাইল।[/caption] ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসুলে করিম (সা.)– এর ইসলাম। যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বার বার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারে তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করে দুনিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য।’ ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ জারি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। মেশকাত শরিফের অনুবাদক হিসাবে সুপরিচিত মাওলানা ফজলুল করিমকে সেই ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক নিয়োগ করেন। ‘বায়তুল মোকাররম সোসাইটি’ এবং ‘ইসলামিক একাডেমি’ নামে তৎকালিন দুটি সংস্থার বিলোপ সাধন করে এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে পুনর্গঠন করেন। জুয়া, হাউজি, মদসহ অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান করেন। কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণ করে রমনা পার্কের অনেকখানি জায়গা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় সরকারের পক্ষ থেকে জমি দেয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ বিষয়ে যে জ্ঞানগর্ভ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন- আজ সময়ে এসেছে তা নিয়ে গবেষণার। বিষয় দুটির ওপর আলোকপাত করে তার যথার্থ ও সুষ্ঠু প্রয়োগ করা গেলে রাতারাতিই পাল্টে যেতে পারে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা। প্রকৃত বাঙালি ও মুসলমানের দ্বারা কখনোই অন্যায় ও নীতিহীন কাজ সম্ভব নয়। লেখক : সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App