×

মুক্তচিন্তা

বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে কেন?

Icon

nakib

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২০, ০৭:৪০ পিএম

চলুন আমরা কিছু সাহসী ব্যক্তিদের কথা বলি। এদের এক বিষম ক্ষমতা আছে, অপরিসীম বললেও ভুল হবে না। সেটা হলো, ‘পুরুষত্ব’। জানে সবাই-ই, আপনি আমি এটাকে খুব ছোটখাটো ধরে নেই আজকাল। কারণ এই ক্ষমতার হাত ধরে হারানোর আকুলতার চেয়ে পাওয়ার উৎসব বড় বেশি। হ্যাঁ, কারণ এই ক্ষমতা যারা ধারণ করে, তারা বহুমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের মহাপ্লাবিত পরিকল্পনা চেম্বার আছে এবং সেটি সুসজ্জিত। তারা ওখানে নানা নিরীক্ষা কৌশল আবিষ্কার করে এবং অবশ্যই তার উদ্দেশ্য রয়েছে। পরিকল্পনায় দুদল থাকে, একদল পরিকল্পনাবিদ আরেকদলের ওপর সে পরিকল্পনার নিরীক্ষা চালায়। ক্ষমতাসীন দল জানে যে, তারাই সফল হবে। কারণ তারা পূর্বের বহু ঘটনার ওপর গবেষণা চালিয়েই হয়তো মাঠে নামে। ধরুন কিছুক্ষণের জন্য যদি গৌণ দলকে নিয়ে ভাবি। নাহ, যে কোনো একজনের কথাই বলি। একজন ‘পুরুষত্ব’ ক্ষমতাহীন মেয়ে, সে বাসে বা যে কোনো যানবাহনে উঠল। তার দুটো চোখ কিন্তু শান্ত নয়, মনও নয়। খুঁজছে, কেউ তার ওপর নজর রাখছে কিনা, কোনদিক থেকে রাখছে, কি করে তার নজর এড়িয়ে সে পুরো পথ যাবে, যে লোকটির তার ওপর চোখ পড়েছে সে কোথায় নামবে, একই জায়গায় নামলে তার কি করণীয় হবে। মোটামুটি বেশ ভালো মগজ খাটানো, শ্রম দেয়া বটে। এসব চিন্তায় হয়তো দুর্বলমনা মেয়েটির প্রেসার বাড়ছে। আর যে মেয়েটিকে সবাই শক্তপোক্ত বলে জানে, সে আত্মবিশ্বাসী অঙ্গভঙ্গির মুখোশে আবৃত করছে নিজেকে। তাতে অবশ্য মুখ্য দলের লোকদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললে খুব একটা ভুল হবে না বোধ করি। পরিকল্পনা যখন বাস্তবায়ন হয়ে যায়, কয়েক মিনিটে খবরের ঝড়ে সোশ্যাল মিডিয়া আর টেলিভিশনের পর্দা ফাটানো শব্দের তীব্রতা কোনো হাহাকারের চেয়ে কম নয়। মাঝখানে একটু খবর সংগ্রহকারীদের কথা বলি, তারা এত খবর জোগাড় করে; এসব পরিকল্পনাকারীর কোনো খোঁজই থাকে না তাদের? যেন কাজটা শেষ করার অপেক্ষায় ছিল খবরের পোর্টালগুলো। কোনোদিন তো শুনিনি যে, অমুক খবরের রিপোর্টার ধর্ষকদের পূর্বপরিকল্পনার খবর জেনে ফেলে প্রশাসনকে নিয়ে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং তাতে একজন মেয়ে উপকৃত হয়েছে। তৈরি হয়েছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কি সহজেই না তারা জার্নালিস্ট হওয়ার দায় সারছে। বিচারব্যবস্থার কথা না হয় একটু তুলে রাখি। আমাদের মজ্জাগত কিছু স্বভাব হলো, ঘটনা ঘটলে দায় কার এটা নিয়ে গবেষণায় বসি, হাজারখানেক দায় বানিয়ে স্বস্তি লাভ করি। এই ধরুন, মেয়েটি একা বের হয়েছিল কিনা, সে কোন পথ দিয়ে যাচ্ছিল, পোশাকের বিষয়ে যাব না; তার মা-বাবাকে তুলোধুনো করে ছাড়ে, কেন মেয়েকে একা যেতে দেয়া হলো। কোনো কোনো বাবা-মা এসব তুলোধুনো আর সর্বনাশ এড়াতে সারাজীবন মেয়েটাকে এক সুশৃঙ্খল, আলো-বাতাস দেখার ব্যবস্থা করেন; এতে তাদের দোষ নেই। কাজের ক্ষেত্রে বা বিশ^বিদ্যালয়ে যে প্রজাতির লোক দলে ভারী হন, তাদের শক্তি একটু হলেও বেশি, এ জন্য তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলা হয়। বাবা-মায়েরা যদি এভাবে তাদের প্রচেষ্টায় মেয়েদের সংখ্যাটা কমিয়ে রাখেন। তবে ক্ষমতাসীন এই দলেরাকি ক্ষমতা ফলানোর চেষ্টা মোটেই করবেন না? ক্ষমতার ধরনই হলো ফলানো, তবে সেটি আমাদের ওপর নির্ভর করে কীভাবে আমরা সেটি ব্যবহার করছি। হ্যাঁ, আমি মেনে নিয়েছি, পুরুষত্ব একটি ক্ষমতা; নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মানছে, আমি না মানার কে? রোজকার ঘটনায় পুরুষত্বের যেসব নমুনা আমরা পড়ি, দেখি, তার ব্যতিক্রম কি আশা করতে পারি না? আমরা আর কতকাল ধর্ষণকে স্বাভাবিক নেয়াটা চর্চা করব? যারা এসব করে, তারা অসুস্থ, আমরা কি সুস্থ? যেসব বিষয়গুলো ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয়, সেসব বিষয়ে সুযোগ না থাকলে কি করে বছর বছর এসব ঘটনার সংখ্যাটা তরতর করে বেড়ে চলে? তাহলে কি চাই আমরা? খবরের কাগজের পাতা ভরার দায়িত্ব নেয়া, নারীকে পুরুষত্ব নিরীক্ষার বস্তু বানানো, গবেষণা করার বহুল আলোচিত টপিক পাওয়া, বিচারব্যবস্থাকে দিনে কয়েকবার করে গালমন্দ করা ইত্যাদি নাকি নিজেদের একটু কাজে লাগানো, বিচারব্যবস্থার অনিয়মে কি আমাদের একটুও হাত নেই বলছেন? শিক্ষাগ্রহণের পথ যখন দুবেলা দুমুঠো খাওয়া আর রংচঙেয় পোশাক পরার একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে। তখন নৈতিক শিক্ষার শিরদাঁড়া কতটা সোজা হবে, সেখানে সন্দেহের পাহাড় বড়সড় মাথা তুলে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় যেহেতু এদেশে যে যা নিয়ে পড়াশোনা করছে, চাকরির ক্ষেত্রে তার উল্টোটা করছে; তাই পড়াশোনা জীবনের অর্ধেকটা যদি নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ আর চর্চার ওপর অতিবাহিত করত এবং সবার জন্য যদি তা বাধ্যতামূলক করা হতো, তবে বোধ হয় কর্মক্ষেত্রগুলো নৈতিকতায় আর রাস্তাঘাটগুলো ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াই আমাদের হাত ধরেই নিরাপত্তা আর শৃঙ্খলা পেত, কি ভালো না হতো তবে। শিক্ষাটা জন্মের পর থেকেই দরকার, মানে পরিবার থেকে। একটি শিশু শৈশবে যা কিছু শেখে, ওটাই তার সারা জীবনের কর্ম প্রতিফলনের অনেকখানি জুড়ে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক পর্যায় থেকে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক এবং তার অনুসরণ নিশ্চিত করা যেতে পারে মার্কিং করার মাধ্যমে এবং অবশ্যই এ কাজে অভিভাবকদের সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করতে হবে। সমস্যা যখন বেড়ে চলে ঊর্ধ্বগতিতে, নিরুপায় হয়ে আমাদের প্রথম থেকে শুরু করাটা জরুরি। এ দশকে আমরা টেকসই উন্নয়নে ভরসা করি, এটাও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে অবশ্যই ধর্ষণের প্রতিটি নিয়ামক এবং উপাদানকে এক এক করে নির্মূল করার দায়িত্ব নিতে হবে। দুর্নীতি শুধু ঘুষ আর অনিয়ম নয়, ধর্ষণও এক ধরনের দুর্নীতি; তাই এক্ষেত্রেও জিরো টলারেন্স দিয়ে আলাদাভাবে এটিকে মোটা দাগে, অভিযানে, কৌশলে দমন করার জোর দাবি আমরা জানাতে চাই। চাই না, এ নির্মম, ব্যথাতুর সংবাদে সকাল শুরু করতে; চাই না আতঙ্কের সংস্কৃতিকে নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে। সময় এসেছে নতুন করে ভাবার, মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি তরুণরা যেন শামিল হয় এ প্রত্যয়ে। কারণ তারাই দুর্বার এবং সম্ভাবনাময় আশার বর্তিতাবাহক হতে পারে; যদি সমস্যা সমাধানের মানসিকতা নিয়ে সত্যিকার অর্থে আইন প্রণয়নকারী এবং আইন রক্ষাকারীরা পাশে থাকেন। আমরা তাদের ধন্যবাদ দিয়ে ক্ষান্ত হবো না, বরং একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ জাতিতে পরিপূর্ণ হবো। অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, নৈতিকতায় মোড়া দক্ষ মানবসম্পদ মানবিকতায় মাথা তুলে দাঁড়াবে সার্বিক উন্নয়নকে রক্ষায়। শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App