×

মুক্তচিন্তা

ওহির রাজনীতি এবং ব্রিটেনের বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৪৮ পিএম

বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেশের নেতাকর্মীরাই সিদ্ধান্ত দেবে দল কিংবা আন্দোলনের রূপরেখা কী হবে। দলের স্বার্থে কিংবা জাতির প্রয়োজনে আন্দোলনের ইস্যু নির্ধারণ করাই তো নেতাদের কাজ। অথচ স্কাইপে ‘ওহি’ পাঠিয়ে বরং দলকেই বিভক্ত করছেন তারেক রহমান। এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে তাদের নেতাদের কথাবার্তায়। ‘ওহি’ আর বাণী দিয়ে পথে নামানো যায় না কর্মীদের। অন্তত তারেক জিয়া সেই বাণীপ্রধান নেতা হয়ে উঠতে পারেননি এখনো।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটা প্রধান ছোঁয়া থাকে ব্রিটেনে। সেটা এক ধরনের ঐতিহ্যই হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির যখন দুঃসময় থাকে, তখন সব দলে, বিশেষত আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেন জানি ব্রিটেনকে বেছে নেয়, তাদের প্রচার-প্রচারণা লবিং করার ক্ষেত্র হিসেবে। আওয়ামী লীগ প্রধানও একসময় এই ব্রিটেনে এসে তার কিছু নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়ে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর চষে বেড়িয়েছেন। উজ্জীবিত করেছেন নেতাকর্মীদের। পার্লামেন্ট, লর্ড সভায় সমর্থন চেয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় সফলতাও পেয়েছেন। দলের এমনকি অর্থনৈতিক সংকট সময়ে ব্রিটেনের কর্মীদের সহযোগিতায় বাংলাদেশে অনেক এমপি পর্যন্ত নির্বাচিত হতেও দেখেছে ব্রিটেনের বাঙালিরা। এখন বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চরম দুঃসময় পার করছে। এ সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনেই অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক দুঃসময় হলেও তার সময়টা এখানে মোটেও প্রতিক‚ল নয়। রাজনৈতিক তো নয়ই, অর্থনৈতিকভাবে তিনি সফল একজন মানুষ হিসেবেই জানে ব্রিটেনে সব অভিবাসী বাঙালি। বরং তার সুসময়ই বলা যায়। তার যখন মন চায়, তিনি ডাক দেন। ব্রিটেনেও বিএনপির বিশাল এক ওয়ার্ক ফোর্স আছে। তার ডাক শোনলে বিএনপির কর্মীরা দলে দলে যোগ দেয় এবং প্রায়ই তিনি ‘বাণী’ দেন কর্মীদের। এসব আহ্বানে কিংবা তার বক্তৃতায় ইতোপূর্বে তিনি বঙ্গবন্ধু কিংবা বাংলাদেশ নিয়ে জাতিকে করেছেন বিভ্রান্ত। এ নিয়ে দলের কর্মীরা প্রকাশ্যে মুখ খোলে না ঠিকই কিন্তু অফ দ্য রেকর্ড অনেকেই তার এসব বিভ্রান্তির সমালোচনায় মুখর থাকে। তার এসব বাণীতে কর্মীরা কি উজ্জীবিত হয়ে উঠছে? সে কথাটা আছে চারদিকেই। একটা বিরাট হলে বসে রাজার মতো মসনদ পরিচালনার নাম বিরোধী দলের রাজনীতি নয়। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে শেখ হাসিনা যেখানে চষে বেড়াতেন, ব্রিটেনের এমনকি বিভিন্ন জায়গায়, অথচ তারেক রহমান তার এক দশকেরও অধিক প্রবাস জীবনে তার দলের চরম দুঃসময়ে কয়দিন ঘর থেকে বের হয়ে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন এ প্রশ্নটি আছে খোদ দলের ভেতরেও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন ব্রিটেনে আসেন, তখন তার দলের নেতাকর্মীদের লাগাতার প্রতিবাদে তিনি তো কোনোদিন কোনো হোটেলে সামনেও যাননি। ব্রিটেনের কোনো শহরে গিয়ে তিনি কি একটা মিটিং করেছেন কখনো? মিডিয়ার মুখোমুখি হতেও দেখি না তাকে। একজন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের এক চরম সংকটময় সময়ে তারেক রহমান খুব কমসংখ্যক মতবিনিময়ের আয়োজন করতে পেরেছেন এ দেশের এমপি কিংবা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সঙ্গে। অর্থাৎ রাজনীতিতে বহু উচ্চারিত লবি তৈরিতে তার গুরুত্বপূর্ণ পদটি কতটুকুই ব্যবহার করতে পেরেছেন তারেক রহমান। কেউ কেউ বলে থাকেন, তারেক রহমান নিরাপত্তার কারণেই খুব একটা বাইরে বের হন না। ব্রিটেনে অন্তত এ কথার পক্ষে কোনো যুক্তি ধোপে ঠিকবে না। কারণ এখানে নিরাপত্তা সরকারই দিয়ে থাকে। তা ছাড়া তারেক রহমানের মতো নেতার কিছু হলে বিএনপির কর্মী বাহিনীর তা প্রতিহত করার মতো শক্তি আছে যুক্তরাজ্যে, যা তারা প্রায়ই প্রমাণ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে এলে। তিনি এই ব্রিটেনে থাকেন। বিএনপির একজন নেতা জানিয়েছেন, তাদের প্রায় ৪৮টি বিভিন্ন শাখা আছে ব্রিটেনে। আমরা যদি ধরে নেই দলটির বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন মিলে একেকটা শাখায় গড়ে ২৫০ জন নেতাকর্মীও থাকেন, তাহলে বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২ হাজার। যুক্তরাজ্যে অবস্থান করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (প্রধান নেতা এখন) হয়ে যুক্তরাজ্য কমিটি ঘোষণা করতে তার সময় লেগেছে এক বছরেরও বেশি। মাত্র কয়েক হাজার কর্মীর একটা কেন্দ্রীয় ইউনিট চালাতে যাকে হিমশিম খেতে হয়, তিনি একটা দেশের দলের ভার নেন কীভাবে লন্ডনে বসে। এ প্রশ্নটি এখন এমনকি বাংলাদেশেও বিএনপির ভেতরেই উচ্চারিত হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই তা বাংলাদেশের নেতারা এ নিয়ে কথা বলে আসছেন, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, আরেক নেতা দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খানও দল থেকে পদত্যাগ করেছেন তারেক রহমানের সমালোচনা করেই। এখন যা প্রকাশ্যে আসছে বিভিন্ন সভায়-সমাবেশে বাংলাদেশে। গত ডিসেম্বরে সারা ব্রিটেনেই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছে। আওয়ামী লীগের যুবলীগ, মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়েও আছে বিভিন্ন সংগঠন দেশজুড়ে। লীগ পরিবারের বিভিন্ন ইউনিট বিজয় দিবস অনুষ্ঠান করেছে অনেকগুলো। যদিও আওয়ামী লীগের এই অনুষ্ঠানগুলোও দায়সারাভাবে করা হয়েছে। এই সভাগুলোতে বসেছেন নেতাকর্মীরা, বন্ধনা করেছেন, তারপর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সত্যি কথা হলো, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলো জাঁকজমকভাবে করেছে লন্ডন বার্মিংহাম-ম্যানচেস্টারসহ বিভিন্ন শহরের বাংলাদেশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, বাংলা স্কুলগুলো। অনেক সংগঠন বিজয় দিবসকে উৎসবে রূপ দিয়েছে, যা করতে পারেনি এমনকি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও। এ হিসেবে দূতাবাসগুলোর আয়োজন উল্লেখ করার মতো। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিএনপি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলো কোথায় করেছে, তা মাইক্রোসকোপ দিয়ে দেখতে হয়েছে। লন্ডনে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। একটা অনুষ্ঠানও হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির কর্মীরা। কিন্তু এর বড় ধরনের কোনো প্রচার-প্রচারণা পরিলক্ষিত হয়নি। বিএনপির নতুন কমিটি এসেছে সম্প্রতি। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসভাপতি, সহসাধারণ সম্পাদক, উপদেষ্টাসহ গুরুত্বপূর্ণ পদবিও জুটেছে অনেকের। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হলো আমার শহর ম্যানচেস্টারসহ আশপাশের অন্তত দশটা শহরের বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের ইউনিট থেকে বিএনপির কোনো বিজয় দিবস অনুষ্ঠানের খবর পাইনি। আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের কাছে থাকাই একটা দলের মূল লক্ষ্য থাকতে হয়। ব্রিটেনেও বাংলাদেশের মতো বিএনপি সেই লক্ষ্য থেকে ক্রমেই কি সরে যাচ্ছে। একজন নেতাকর্মীর প্রথম কাজ তো দলকে সংগঠিত করা, নেতার কাজ তো জনমুখী ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে তা দিয়েই মাঠ উষ্ণ করে রাখা। লন্ডন তথা ব্রিটেনে বিএনপির কর্মীরা যেমন নীরব রাজনীতি নিয়ে সময় কাটাচ্ছে, ঠিক তেমনি সারা ইউরোপেও বিএনপির হাজার হাজার কর্মীদের সেই একই অবস্থা। বিএনপির উদ্যোগে বিজয় দিবসের হাতেগোনা অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া গেছে সারা ইউরোপ থেকেই। আর সেজন্যই হয়তো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উদ্দেশে বলেছেন, “লন্ডনে বসে ‘ওহি’ পাঠাবেন না। স্কাইপের মাধ্যমে দল পরিচালনা করবেন না। তিনি তারেককে লন্ডনে বসে দুই বছর মাস্টার্স বা এমফিলে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।” বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেশের নেতাকর্মীরাই সিদ্ধান্ত দেবে দল কিংবা আন্দোলনের রূপরেখা কী হবে। দলের স্বার্থে কিংবা জাতির প্রয়োজনে আন্দোলনের ইস্যু নির্ধারণ করাই তো নেতাদের কাজ। অথচ স্কাইপে ‘ওহি’ পাঠিয়ে বরং দলকেই বিভক্ত করছেন তারেক রহমান। এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে তাদের নেতাদের কথাবার্তায়। ‘তারুণ্যের অহংকার’ স্লোগানের শ্লাঘা নিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের তো নয়ই, এমনকি তার দলের তরুণদের কি আকৃষ্ট করতে পারছেন তিনি। তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে এখন ব্রিটেনে একটা বলয় সৃষ্টি হয়েছে, সে জন্যই দেশেও এর বিপরীতে কথা উঠেছে। যতই দলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, ততই আন্দোলন-সংগ্রামে সেই তেজোদ্দীপ্ত বিরোধী দল হারাচ্ছে বাংলাদেশ। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনও বেগবান হচ্ছে না। ‘ওহি’ আর বাণী দিয়ে পথে নামানো যায় না কর্মীদের। অন্তত তারেক জিয়া সেই বাণীপ্রধান নেতা হয়ে উঠতে পারেননি এখনো। ব্রিটেনে বিএনপির রাজনীতিতে তিনি সে স্বাক্ষরই রাখছেন। ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App