×

সাময়িকী

হারুন হাবীবের বহুমুখিতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৪৩ পিএম

হারুন হাবীবের বহুমুখিতা
অনেক কাজে অনেকভাবে যুক্ত হারুন হাবীব, কর্মসাধকই তাকে বলতে হবে। সাংবাদিকতায় তিনি উচ্চপদে আসীন ছিলেন এটা তার ক্ষেত্রে বলবার কিছু নয়। ইতিহাস-চর্চা ও সাহিত্য-চর্চাতেও নিবেদিত রয়েছেন হারুন হাবীব। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম উপন্যাস ‘প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম’, সাহিত্যকর্ম হিসেবে এর সার্থকতা বিচার করবেন রসতত্ত্ববিদরা, আমার কাছে ভিন্নতর কারণে উপন্যাসটি তাৎপর্যময়।
হারুন হাবীব সদা একই রকম থেকে গেলেন, কী অবয়বে, গড়নে, চারিত্র্যে, ঔদাস্যে এবং সর্বোপরি স্বভাবে ও আদর্শে। চিন্তার ক্ষেত্রে নমনীয়তা ও আদর্শের ক্ষেত্রে ঋজুতাÑ মহাজনেরা এমনিভাবে চলবার পথনির্দেশ করে গেছেন। কিন্তু মহাজনী বাক্য তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিণত হয় আপ্তবাক্যে, তা পালনে উৎসাহী অথবা পারঙ্গম মানুষ বেশি দেখা যায় না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমীদের একজন হারুন হাবীব, সেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে টগবগে যৌবনে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, তারপর থেকে জীবনভর মুক্তির জন্য যুদ্ধই করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা শরীক হয়েছিলেন তারা কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য সেটা করেননি, তেমন ভাববার অবকাশও ছিল না। কেননা পরাক্রমী হিংস্র সশস্ত্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বার জন্য বড় প্রয়োজন ছিল অন্তরের শক্তির, নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়ার মনোভাব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব ছিল না এবং অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন কত না মানুষ! তবে বিজয়ের পর রাতারাতি আরেক বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম আমরা, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠলো বিপণনযোগ্য পণ্য, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ব্যবহারযোগ্য বাস্তবতা। এই নতুন পরিস্থিতির সুবিধা-অর্জনের জন্য সব ধরনের সুযোগ হারুন হাবীবের সামনে ছিল, কিন্তু সে-পথ তিনি একেবারেই মাড়াননি। ভিন্ন এক ঔদাস্য নিয়ে সকল প্রলোভনের হাতছানি উপেক্ষা করে পথ চলেছেন তিনি। আর তাই দেখি চারিত্র্যে, ঔদাস্যে, স্বভাবে তিনি একইরকম থেকে গেছেন এবং আদর্শের একাগ্রতা দিয়ে অন্তরের ধন ঋদ্ধ করে চলেছেন। এ কারণে তিনি আমাকে খুব টানেন, হয়ে উঠেছেন আমার প্রিয় মানুষদের একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন হারুন হাবীব, আর সেই সূত্রে স্বাভাবিকভাবে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধ-সংবাদদাতা। এই অবস্থান থেকে ঘনিষ্ঠতা পেয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর এম. এ. তাহেরের। কাজ করেছেন সেক্টর এগারোতে, মেঘালয় সীমান্তে, সেই সাথে ত্রিপুরা, আগরতলা অঞ্চলেও ছিলেন মাসাধিককাল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে কর্মতৎপর নিষ্ঠাবান এই তরুণের হাতে আপন ইয়াসিকা ক্যামেরাটি তুলে দিয়েছিলেন মেজর এম. এ. তাহের। হারুন হাবীব হয়ে উঠেছিলেন একই সঙ্গে কলমের ও ছবির যোদ্ধা। জীবন বাজি রেখে লড়ে-চলা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্যামেরা তখন বিশেষ ছিল না, হারুন হাবীবের হাতে তৎকালীন বিচারে উঁচু মানসম্মত ইয়াসিকা তাই হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চিত্ররূপদানকারী আরেক আয়ুধ। এইসব চিত্র এখন, বহু বছর পর হয়ে উঠেছে একাত্তরের অনন্য ও ঐতিহাসিক দলিল। এসব ছবি দেশবাসীর কাছে মুক্তিযুদ্ধকে দৃশ্যমান করে তুলেছে এবং যথার্থ অর্থে বয়ে নিয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। আজ বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ ও অসা¤প্রদায়িক চেতনার সপক্ষে দাঁড়িয়েছে দেশবাসী এবং নতুন প্রজন্ম এখন উদগ্রীব হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের নানামুখি বাস্তবতায় অবগাহনের জন্য। পালাবদলের স্বপ্নভরা এই সময়ে তরুণ সমাজের জন্য হারুন হাবীবের রচনা, কর্ম ও আলোকচিত্রমালা সেরা উপহার হিসেবেই বিবেচিত হবে। অনেক কাজে অনেকভাবে যুক্ত হারুন হাবীব, কর্মসাধকই তাঁকে বলতে হবে। সাংবাদিকতায় তিনি উচ্চপদে আসীন ছিলেন এটা তার ক্ষেত্রে বলবার কিছু নয়, কিন্তু তিনি যে আন্তর্জাতিক কতক সংবাদ-সাময়িকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এটা অনেকেই জানেন না। ভারতের ব্যতিক্রমী ও সফল গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দি হিন্দুর পাক্ষিক সাময়িকী ফ্রন্টলাইনে হারুন হাবীবের প্রতিবেদন আমি সবসময় আগ্রহ নিয়ে পড়ি। ইতিহাস-চর্চা ও সাহিত্য-চর্চাতেও নিবেদিত রয়েছেন হারুন হাবীব। এ-ক্ষেত্রে তার দুটি গ্রন্থের ভ‚মিকা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করবো। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম উপন্যাস ‘প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম’, সাহিত্যকর্ম হিসেবে এর সার্থকতা বিচার করবেন রসতত্ত¡বিদরা, আমার কাছে ভিন্নতর কারণে উপন্যাসটি তাৎপর্যময়। এর বিষয় হচ্ছে, চিকিৎসার জন্য যুদ্ধাহত তরুণদের পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশে গমন। মুক্তিযুদ্ধের এক অনালোচিত মাত্রা এভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে উপন্যাসে। আরেক উল্লেখযোগ্য রচনা ‘মুক্তিযুদ্ধ : ডেটলাইন আগরতলা’। মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সেই রাজ্যের জনসংখ্যার চাইতেও বেশি মানুষ। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর প্রতি সমর্থন প্রদানে ত্রিপুরাবাসীর ভ‚মিকায় কোনো ঘাটতি ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তখন আগরতলা হয়ে উঠেছিল আপন আবাস-সম। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ত্রিপুরাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বাংলাদেশের সরকার ও জনসমাজ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের এই বিস্মৃত অধ্যায় ও আরাধ্য কাজ পুনরায় সবার গোচরে এনেছিল হারুন হাবীবের গ্রন্থ। সুখের কথা, এরপর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মৈত্রীবন্ধন নানা সূত্রে বিকশিত হয়ে চলেছে। পথিকৃতের ভ‚মিকা পালনের জন্য হারুন হাবীব এ-ক্ষেত্রে কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারেন, যদিও তেমন দাবি তিনি কখনো করেন না। সা¤প্রতিককালে ত্রিপুরাসহ প্রতিবেশী আরো দুই ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয় নিয়ে তিন খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধকালীন দলিলপত্র প্রকাশ করেছেন হারুন হাবীব। গবেষকদের জন্য রত্নভাণ্ডার জমা হয়েছে এখানে। এমনিভাবেই চলছে হারুন হাবীবের কর্মসাধনা, বহুমুখিতা ও বহুবিস্তার নিয়ে। আমি তার সামান্যই উল্লেখ করলাম, একাত্তরের এই যাত্রীর নিরন্তর পথচলা বিষয়ে আমার মুগ্ধতা প্রকাশের জন্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App