বিশুদ্ধ খাদ্য গ্রহণ সুবিধা নয়, অধিকার
nakib
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২০, ১১:০৪ পিএম
সম্প্রতি স্কটল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু আমার বাসায় বেড়াতে এসে গভীর নলক‚পের পানি পানে অস্বীকার করায় তাকে বোতলজাত পানি দিতে গিয়ে সাবধান করেছিলাম, এ পানিও যে জীবাণুমুক্ত তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। বন্ধুটি অসহায়ের মতো বলেছিলেন, এ কারণেই তিনি আজ শেষ বয়সে নিজ বাসভ‚মে ফিরে আসতে পারছেন না। তিনি যতবারই ছুটিতে আসেন তার ছোট ছেলেটি পেটের পীড়ায় ভোগে। ওখানে অন্তত বিশুদ্ধ খাবারটুকু মেলে। পাওয়া যায় উন্নত চিকিৎসাসেবা। অথচ আজ বাংলাদেশে জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য পানিও আজ দূষিত। বোতলজাত পানির প্রায় ৫০ শতাংশ দূষিত। অফিস-আদালতে, বাসাবাড়িতে সরবরাহকৃত বড় বড় জারের পানির ৯৮ শতাংশই জীবাণুপূর্ণ। আর খাবারের বিশুদ্ধতার কথা ভাবতে গেলে হিমশিম খেতে হয়। অথচ খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম প্রধান। খাদ্য গ্রহণ ছাড়া মানুষসহ কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে খাবার অবশ্যই হতে হয় বিশুদ্ধ। দূষিত বা ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য মানুষের জন্য স্বাস্থ্যহানিকর হয়ে থাকে। অথচ আজকের বাংলাদেশে সেই বিশুদ্ধ খাবার খুঁজে পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছে ফরমালিন মিশিয়ে মাছের পচন রোধ করে বিক্রি করা হয়। প্রকৃতি প্রদত্ত শাকসবজিতে বিষাক্ত স্প্রে, সব ধরনের ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে সর্বত্রই কার্বাইড, ইথোফেন আর ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। পোল্ট্রি ফার্মের ডিমে ট্যানারি বর্জ্যস্থিত বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। আনারসে হরমোন প্রয়োগ করে দ্রুত বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলে আসছে। আম গাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে রাসায়নিক ব্যবহার এখন ওপেনসিক্রেট। মিষ্টি জাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রং, সোডা, সেকারিন, মোম। মসলায় কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হয়। নকল ও ভেজাল ওষুধে ছেয়ে গেছে বাজার। অপারেশনের কাজে ব্যবহৃত প্যাথেডিনসহ নানা ধরনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বাজারজাত করে চলেছে ভেজালচক্র।
রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের খাবারের দোকানে, রেস্তোরাঁয় ভেজালমিশ্রিত খাদ্যের ছড়াছড়ি। অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে ভোক্তাদের অখাদ্য-কুখাদ্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে। খাবার রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয় পুরনো পোড়া নিম্নমানের তেল। খাদ্য প্রস্তুতের উপাদান মসলায়ও থাকে বিষাক্ত রংসহ নানা ধরনের ভেজাল। রাস্তার পাশের কম দামের খাবারের দোকানগুলোর অবস্থা আরো করুণ। সম্প্রতি রাজধানীর কিছু রেস্তোরাঁর পরিবেশ ও খাবারের মানভেদে বিভিন্ন রঙের স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। খারাপ মানের রেস্তোরাঁকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে তাদের মানোন্নয়ন করে স্টিকারের রং বদলের। তাতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় তেল, সাবানসহ অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীও ভেজালমুক্ত নয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহকৃত ৪৩ ধরনের খাদ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে ২ হাজার ১৪৭টি নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ভেজালের উপস্থিতি ধরা পড়ে। মহাখালীর পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারে দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হয়। দেশের ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় বাংলাদেশের খাবারের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশে^র প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়াও দূষিত খাবারজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সার নামক মরণব্যাধিতে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ ১৫ লাখ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। ২০১৫ সালে দিনাজপুরে কীটনাশক মিশ্রিত লিচুর বিষক্রিয়ার ৮ এবং ২০১২ সালে ১৪ জন শিশুর প্রাণহানি ঘটে। বিষাক্ত প্যারাসিটামল খেয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৩ সালে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে ১৪ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডেরও বিধান রয়েছে সেই আইনে। ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হলেও ভেজাল দানকারী চক্রকে দমন করা যাচ্ছে না। খাদ্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব বিএসটিআইর। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশসহ ৬টি মন্ত্রণালয়ের ১০টি বিভাগ ভেজাল বন্ধের দায়িত্বে নিয়োজিত। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগেরও এ ব্যাপারে ভ‚মিকা রয়েছে। কিন্তু এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে ভেজাল প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামান্য জেল, জরিমানার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভেজাল পণ্য উদ্ধার ও পরীক্ষা-সংক্রান্ত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতায় ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা আজ থমকে গেছে। খাদ্যকে বিষমুক্ত রাখতে ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ বিল-২০১৫’-এ ফরমালিনের ব্যবহার রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ২০ লাখ ও সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান হয়েছে। এ আইনে ফরমালিন বিক্রয়ের দোকান সাময়িকভাবে বন্ধসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া ফরমালিন উৎপাদন, আমদানি, মজুদ, বিক্রয়, পরিবহন এমনকি ব্যবহার বা দখলে না রাখার নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু এসবের কার্যকারিতা খুবই সামান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য দিবস উপলক্ষে গত বছর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গণমানুষের জীবন রক্ষার্থে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রদান বন্ধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য লোকবল সমস্যা সমাধানেরও আশ্বাসসহ দেশের সর্বত্র যেন নিয়মিত ভেজাল প্রতিরোধে ব্যবস্থা গৃহীত হয় সে ব্যাপরেও আশ^স্ত করা হয়। তারপরও খাদ্যে ভেজাল পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশব্যাপী ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য সরবরাহের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভেজালকারীদের মানবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা। এ ব্যাপারে মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো দরকার। ভেজাল মিশ্রণ মহাপাপ। ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ মেশানো মানুষকে তিলে তিলে মেরে ফেলার মতো অপরাধ। ভেজালকারী, মুনাফাখোরদের মধ্যে এই উপলব্ধি জেগে উঠলে ভেজাল এমনিতেই কমে আসবে। তবে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে অতি মুনাফালোভী, অসাধু খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় এনে দেশব্যাপী ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য সরবরাহের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা অসাধুদের ধর্মের কাহিনী আমলে নিতে সময় লেগে যেতে পারে। জন্মের প্রথম প্রহরে একটি শিশু যেমন সর্বপ্রথম বিশুদ্ধ মাতৃদুগ্ধ পান করার স্বাদ নেয়, তেমনি সুস্থ দেহমন নিয়ে বেড়ে উঠতে সেই শিশুর সারাজীবন বিশুদ্ধ খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কেননা বিশুদ্ধ খাদ্য গ্রহণ মানুষের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা নয়, অধিকার।
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ : কলাম লেখক।
[email protected]