বিজয়ের মাসে গত ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার, জ্যাকসন হাইটসের একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো 'সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্কের ' ১০৯তম মাসিক সাহিত্য আসর। অনুষ্ঠানটি পরিচালনায় ছিলেন একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন। যাঁরা দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, শহীদ হয়েছেন, নানাভাবে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরুতেই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।

এবারের আসরে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা হলেন, লেখক ফেরদৌস সাজেদীন, চট্টগ্রাম একাডেমির মহাপরিচালক কবি জিন্নাহ্ চৌধুরী, কবি ও অধ্যাপক হোসাইন কবির, কবি কাজী আতীক, লেখক আদনান সৈয়দ, লেখক সুরীত বড়ুয়া, লেখক এবিএম সালেহ উদ্দীন, বিপার কর্ণধার এনি ফেরদৌস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনে প্রাক্তন সভাপতি স্বপন বড়ুয়া।

ফেরদৌস সাজেদীন বলেন, নিউইয়র্কে আমি জন্মাইনি। কিন্তু নিউইয়র্ক আমার জীবনভরের শহর। লেখাপড়ার পর কর্ম জীবনের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এই শহরে বাস করছি। আমার চোখের সামনে এই শহরে নির্মিত হতে দেখেছি আমার আপন ভিটা। যে ভিটায় আমার অবিরত বসবাস তার অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে সাহিত্য একাডেমি। সকলের সম্মীলনে সাহিত্য একাডেমির প্রতি মাসের আসরটি সম্মেলনে রূপান্তরিত হয়েছে। সাহিত্য একাডেমির প্রতিটি আসর বৈচিত্রপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ।

ফেরদৌস সাজেদীন আরো বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আজকাল কবিতা বিভিন্নভাবে ঘরে বসেও শোনা যায়। কিন্তু সাহিত্য একাডেমিতে এসে কবিতা শোনার যে হৃদ্যতা, উষ্ণতা, স্নিগ্ধতা পাওয়া যায়, তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। সাহিত্য একাডেমিতে আসার এটিও একটি কারণ। বলুন, এমন একটি পরিবেশ এই শহরে আর কোথায় পাবেন?

জীবনানন্দ দাসের ঝরা পালকের উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেন, লেখালেখিতে নিজস্বতা থাকা জরুরি। একটি লেখা সম্পূর্ণ হবার পর লেখক যেন তৃপ্ত হোন সত্যিকারের সৃষ্টির আনন্দে। লেখালেখি সাধনার বিষয়। এজন্য অবিরত পড়তে হবে এবং লিখতে হবে। সাহিত্য একাডেমি একটি অভাবনীয় সিঁড়ি বেয়ে প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সাহিত্য একাডেমি নিরলসভাবে কাজ করে যাবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

জিন্নাহ্ চৌধুরী বাংলাদেশ এবং চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সবাইকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সাহিত্য একাডেমিতে আসার অনেক দিনের ইচ্ছে আজ পূর্ণ হয়েছে। এখানে এসে পূর্বপরিচিত অনেক অগ্রজ এবং অনুজ লেখকদের সঙ্গে পুণরায় দেখা হয়ে ভালো লাগছে। মুক্তিযুদ্ধ সময়কার সহপাঠী কাজরী দত্ত, যাঁকে তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন, অনেক বছর পরে আবার যোগাযোগ হয়। তাঁর স্মরণে তিনি একটি স্মৃতিচরণমূলক কবিতা পাঠ করেন আসরে।

হোসাইন কবির বলেন, মনোযোগ সহকারে সবার পাঠ শুনলাম। আগেও সাহিত্য একাডেমিতে এসেছি, আজো এলাম। তবে আজকের অনুভূতি আমাকে অভিভূত করেছে। এখানে এসে দেখলাম বিদেশে থেকেও সবাই দেশকে বুকে যত্নে ধারণ করে রেখেছেন। আইনস্টাইনের ‘যখন মানুষ উদবাস্তু হয় সে শুধু লোটা কম্বল নিয়েই যায় না, যে ভূমিতে সে জন্মায়, যে সংস্কৃতি, ভাষার নদীতে সে অবগাহন করে তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়’ কথাটির উদ্ধৃতি টেনে হোসাইন কবির বলেন, সাহিত্য একাডেমিতে এসে দেখলাম প্রত্যেকেই তাঁদের লেখায় দেশটাকে উপস্থাপন করেছেন। যুদ্ধকালীন কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে তিনি বলেন, রাজাকার বাদে মুক্তিযুদ্ধ সময়ের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। স্বরচিত কবিতা পাঠের মাধ্যমে তিনি আলোচনার সমাপ্তি টানেন।

কাজী আতীক বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলতে সশস্ত্র যুদ্ধকেই বুঝি, কিংবা যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তাদেরই বুঝি। কিন্তু যে মানুষগুলো প্রতিদিন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের ভেতরেই ছিলেন, তাঁদেরও মূল্যায়ন করতে হবে। আলোচনা শেষে তিনি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।

সুরীত বড়ুয়া বলেন, সাহিত্য একাডেমি আমার জন্য উঠোন। যে উঠোনে আমি অবাধ বিচরণ করতে পারি। যেখানে এসে আমি আমার আবেগ, অনুভূতি সব সমর্পণ করতে পারি। সেই সঙ্গে কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এক কথায় যাঁরাই সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পাই। আমার জানার, বোঝার বিশাল আকাশ উপহার দিয়েছে সাহিত্য একাডেমি। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে আমার জন্ম হয়েছে। আমার বাবার বই বের করেছে বাংলা একাডেমি। আমার ছোট ভাই সাহিত্যের ছাত্র। আমার বাড়িতে তেমন কিছু নেই, তবে একটা বিশাল লাইব্রেরি আছে। সাহিত্যে অবগাহন করে বেড়ে উঠেছি আমি। দেশ ছেড়ে প্রবাসী হবার পর সাহিত্য একাডেমিতে এসে আমার সে তৃষ্ণা নিবারণ করি।

আদনান সৈয়দ, লেখক হাসান ফেরদৌসের ‘যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ’ বইটি আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ১৯৭১ এ যে নয় মাস আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল, সে যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশে হয় নি। বাংলাদেশের বাইরেও বিভিন্নভাবে সে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। কূটনৈতিক ভাবে, বিদেশি সাংবাদিকদের হাত দিয়ে এবং এমন আরো ঘটনাগুলো ঘটেছিল, যে কারণে আমাদের যুদ্ধ আরো বেগবান হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে, আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বইটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড়রা তো বটেই নতুন প্রজন্মও বইটি পড়লে যুদ্ধকালীন অনেক তথ্য জানতে পারবেন এবং উপকৃত হবেন।

এবিএম সালেহ্ উদ্দীন বলেন, বিজয় যেমনি আনন্দের তেমনি কষ্টেরও। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারাই আমাদের দেশের সূর্য সন্তান, বুদ্ধিজীবীদের। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের।

বিপার কর্ণধার এনি ফেরদৌস বলেন, নবীনদের লেখা প্রবীণরা এমন পিনপতন নীরবতায় বসে শোনেন এবং উৎসাহ দেন, এমনটা সাধারণত খুব একটা দেখা যায় না সাহিত্য একাডেমির বাহিরে অন্য কোথাও। এখানে এলে আমি উৎসাহ বোধ করি। এজন্য সাহিত্য একাডেমিতে আসতে ভালো লাগে।

স্বপন বড়ুয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিউইয়র্কে আছি। সাহিত্য একাডেমির কথা অনেকদিন ধরে জানি। পত্রপত্রিকায়ও পড়েছি। নানান কারণে আসতে পারিনি। আজ এসে হলভর্তি সাহিত্যপ্রেমীদের দেখে মুগ্ধ হলাম। আমি সাহিত্যের ছাত্র। ভবিষ্যৎতে সময় পেলেই চলে আসবো। তিনি বলেন, সাহিত্য একাডেমিতে এসে সবার গল্প, কবিতা, কথা শুনে মনে হলো, সাহিত্য একাডেমি একদিন ইতিহাসের অংশ হবে।

এবারের আসরে নাদিম আহমদের লেখা ও সুরে একটি দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী তাহমিনা শহীদ। এছাড়াও আবৃত্তি করেন, পারভীন সুলতানা ও তন্ময় মজুমদার।

আসরে গল্প, কবিতা, ছড়া পাঠ করেন- নীরা কাদরী, আবু সায়ীদ রতন, তাহমিনা খান, লুৎফা শাহানা, বেনজির শিকদার, জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না, মিশুক সেলিম, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, আনোয়ার সেলিম, নিলুফার রেজা, মোহাম্মদ নাসিরুল্লাহ, শামীম আহমেদ, হাবীবুর রহমান, স্বপ্ন কুমার, আবদুস শহীদ, আবুল বাশার, কামরুন্নাহার রীতা, ফারহানা হোসেন, আশরাফ হাসান, শিবলী ছাদেক শিবলু, সাফওয়ান নাহিন, তামান্না শান্তি আহমেদ ও পলি শাহীনা প্রমুখ।

[caption id="attachment_191473" align="aligncenter" width="700"] নিউইয়র্কে সাহিত্য আসরে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: প্রতিনিধি।[/caption]

আসরে উপস্থিত ছিলেন- কুলসুম পপি, রাহাত কাজী শিউলি, ফরিদা ইয়াসমিন, শামস আল মমীন, খালেদ সরফুদ্দীন, শামস চৌধুরী রুশো, শুক্লা রায়, ইশতিয়াক রুপু, মনিজা রহমান, তাহরীনা পারভীন প্রীতি, কামাল হোসেন মিঠু, নাসির শিকদার, তানভীর কবির, পারভীন হোসেন, রেজাউল হক, নাসিমা আক্তার, মনিরা মমতাজ, সেলিনা আক্তার, শাফী মাহমুদ, বীনা মজুমদার, রীনা আবেদীন, শওকত রিপন, আম্বিয়া অন্তরা প্রমুখ।

পরিচালক মোশাররফ হোসেন লেখক ফেরদৌস সাজেদীনকে সবার উপস্থিতিতে সাহিত্য একাডেমির আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের আহ্বায়ক হিসেবে স্বাগত জানান। আসরে যাঁরা নতুন এসেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, এই আসরটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত একে অন্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে ধৈর্য সহকারে সবার পাঠ শোনেন। যা সাহিত্য একাডেমিকে শক্তি যোগায় সামনে এগিয়ে যাবার। এটি আজকের নতুন বিষয় নয়, প্রথম দিন থেকেই দেখে এসেছি। এজন্য সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, নতুন বছরের প্রথম মাস থেকে সম্মেলনের কার্যক্রম পুরোদমে চলবে। এতে সকলের সহযোগিতা চান। সবাইকে নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ এবং ইংরেজি নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে আসরের সমাপ্তি টানেন।

উল্লেখ্য, বইপড়া কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই মাসেও বই আদান-প্রদান হয়েছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন বেনজির শিকদার।