×

পুরনো খবর

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বৈপরীত্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:০২ পিএম

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বৈপরীত্য

নতুন বছর এলে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি অপূরণীয় স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করি এবং সেটা প্রতি বছরান্তে নতুন বছর এলেই যথা নিয়মে প্রত্যাশা করে থাকি। কিন্তু নতুন বছর আমাদের প্রত্যাশা পূরণের বারতা নিয়ে আসে না। গতানুগতিক বছর পেরিয়ে বছর আসা-যাওয়া করে কিন্তু আমাদের সামষ্টিক জীবনে কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না। আমাদের জীবন স্মৃতিতে একই বৃত্তে বৃত্তবন্দি ব্যতীত ইতিবাচক বিকল্প কিছু ঘটেছে বলে স্মরণ করতে পারব না।

খ্রিস্টাব্দের একটি বছর পেরিয়ে নতুন বছরে আমরা পদার্পণ করছি। শতাব্দী থেকে শতাব্দী জুড়ে প্রতি বছরান্তে নতুন বছরে প্রবেশ চিরায়ত ঘটনা। প্রতিটি পুরাতন বছর বিয়োগে আমাদের জীবন থেকে একটি বছর যে খসে গেল, সেটিও কি গুরুত্বপূর্ণ নয়! আমাদের অতীত আর বর্তমানের জীবনাচারে উৎসব, পার্বণ, আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করে আসছি। আমাদের সামাজিক জীবনে উৎসব-পার্বণের আধিক্য এবং মাত্রা ব্যাপক হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এর পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ যে নেই, তা কিন্তু নয়। আমাদের উৎসব মুখে ঠেলে দেয়া, সামাজিক জীবনে নতুন নতুন উৎসব অনুষ্ঠানকে যুক্ত-সংযোজন করার মধ্য দিয়ে ভোগবাদিতার অভিমুখে ঠেলে দেয়ার নানা প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। যেটিকে অনায়াসে পুঁজিবাদী অপতৎপরতা বলেই চিহ্নিত করা যায়। অথচ এমন সব উৎসব আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে যার অস্তিত্ব অতীতে আমরাই দেখিনি।

৩১ ডিসেম্বর নিয়ে স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরেও মাতামাতির এত তীব্র প্রবণতা আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি। হলেও অত্যন্ত সীমিত পরিসরে এবং অনাড়ম্বর আয়োজন-অনুষ্ঠানিকতায় ছিল সীমাবদ্ধ। এখন তো ওই দিনটি উচ্ছৃঙ্খলতার মাত্রা-জ্ঞানহীন পর্যায়ে উপনীত। যেন ৩১ ডিসেম্বর পালন মানেই সীমাহীন স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খলতার অবাধ স্বাধীনতা। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বিজাতীয় সংস্কৃতিতে নিজেদের বিলীন করে পালিত হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। যার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সামান্যতম যোগসূত্রতা ছিল না এবং নেই। তবে খ্রিস্টাব্দের সন-তারিখের ভিত্তিতেই আমাদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক সব দিবস পালনসহ সব কিছুই ঔপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতায় নির্ধারিত। একমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের দিন-ক্ষণ হিজরি সন-তারিখের ভিত্তিতে পালিত হয়ে থাকে। জাতীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় সন-তারিখের অনুসরণে আমরা পালন করে থাকি। আমরা যে অতিমাত্রায় ঘটা করে পহেলা বৈশাখের লাগামহীন উৎসব আনুষ্ঠানিকতা করি; একমাত্র পহেলা বৈশাখের দিনটি ছাড়া জাতীয়ভাবে দ্বিতীয় একটি দিনের দৃষ্টান্ত নেই যেটি বঙ্গাব্দের সন-তারিখের ভিত্তিতে জাতীয় এবং সামাজিক পরিসরে পালিত হয়ে থাকে।

নতুন বছর এলে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি অপূরণীয় স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করি। এবং সেটা প্রতি বছরান্তে নতুন বছর এলেই যথা নিয়মে প্রত্যাশা করে থাকি। কিন্তু নতুন বছর আমাদের প্রত্যাশা পূরণের বারতা নিয়ে আসে না। গতানুগতিক বছর পেরিয়ে বছর আসা-যাওয়া করে কিন্তু আমাদের সামষ্টিক জীবনে কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না। আমাদের জীবন স্মৃতিতে একই বৃত্তে বৃত্তবন্দি ব্যতীত ইতিবাচক বিকল্প কিছু ঘটেছে বলে স্মরণ করতে পারবো না। সেই সুদূর কৈশোর থেকে দেখে এসেছি একই বৃত্তের চক্রে আমরা ঘুরে ফিরছি। নতুন বছর এলে আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপক রকমফের ভিন্ন সব সম্ভবনার অভিজ্ঞতা কিন্তু এ যাবৎ দেখা হয়নি। পরিবর্তন কেবল ঘটেছে আনুষ্ঠানিকতার, অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়। সামষ্টিক জীবনের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক হওয়া তো পরের কথা- নেতিবাচকের মাত্রাই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। যেন এটাই আমাদের সামষ্টিক জীবনের অদৃষ্টের লিখন। শান্তি আসেনি কিন্তু স্বস্তিও যেন পালাতে উদ্যত।

আমাদের পূর্ব পুরুষরা নানা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন অতীত সময়কে বর্তমানের সঙ্গে বিবেচনা করে। ব্রিটিশ আমলের প্রশংসা করতেন পাকিস্তানি আমলের তুলনা বিচারে। আনা-পয়সায় বেচা-কেনার অবিশ্বাস্য হরেক কাহিনী বলে বলে অতীতের সুখ-স্মৃতিকথা বলতেন। অল্প রোজগারে অধিক চাহিদা পূরণ হলেও এখন অতীতের তুলনায় বেশি রোজগার করেও অভাব যেন পিছু ছাড়ে না। ব্রিটিশ আমলে খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর স্বল্প মূল্যে ক্রয়ের হরেক কথা অনর্গল বলতেন। অথচ পাকিস্তানি আমলে তাদের নাকাল হতে হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের আইন, কানুন, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজের নানা চিত্র তুলে ধরতেন পাকিস্তানি আমলের তুলনা বিচারে। শাসনামলের পরিবর্তনে তাদের অপ্রাপ্তির খতিয়ান শুনে ভাবতাম পাকিস্তানি আমলের পরিসমাপ্তিতে নিশ্চয় সুদিন আমরা ফিরে পাবো। কেননা যে সুদিনের আকাক্সক্ষায় বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে এবং পাকিস্তানের একাংশ হতে দ্বিজাতিতত্ত¡কে আস্থায় নিয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্র ও সরকারে তাদের অবস্থান শূন্যে নেমে এসেছিল। বিপরীতে সমস্ত ক্ষমতা এবং অধিকার পাঞ্জাবি শাসকদের অধীনে চলে যায়।

বাঙালি মুসলমানরা আরো পশ্চাৎপদ অভিমুখে নিজেদের আবিষ্কার করতে বড় বেশি কালক্ষেপণ করেনি। পাকিস্তান অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্তে¡র মোহমুক্তি ঘটেছিল দ্রুতই। পাকিস্তানি রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্ন। তেইশ বছরের পাকিস্তানি আমলের অবসান হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাভ‚ত করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দেশবাসীর স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা অপূরণীয় রয়ে যায়। তাই এখনো অনেকে পাকিস্তানি আমলের সঙ্গে বাংলাদেশ আমলের তুলনামূলক বিচার করে হতাশা ব্যক্ত করেন। অতীত আমলের জীবনাচারের সুখ স্মৃতির কথাও বলেন। স্বাধীন দেশে জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা-ক্ষমতা প্রাপ্তি কোনোটি ঘটেনি, এটা অতীব বাস্তব-সত্য কথা। ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা কতিপয়ের অধীনে এবং নিয়ন্ত্রণে। অবস্থাদৃষ্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দেশের শাসক শ্রেণির প্রজা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনের পাকিস্তান কিংবা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বাংলাদেশ কোনোটি এ দেশের সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি। এটা হতাশাজনক নিশ্চয়। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারণ কি? প্রধানত কারণ বৈষম্য।

অনিবার্যরূপে শ্রেণি বৈষম্য। সকল নাগরিকের অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে চরম বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থা টিকে থাকা এবং ক্রমেই ওই ব্যবস্থাটি শক্তিশালী হওয়া। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশ কোনো আমলেই মানুষে মানুষে শ্রেণি বৈষম্য কমেনি বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জাতির যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই ঐক্য আর থাকেনি। বিশেষ শ্রেণি, সংখ্যায় যারা ক্ষুদ্র অংশ তারা ধনী হওয়ার সুযোগে ধনী হয়েছে। গরিব আরো গরিব হওয়ার পথে নেমেছে। সামাজিক এই শ্রেণি বৈষম্য তীব্র হয়ে পড়েছে বলেই অতি সহজে পরিবারে পরিবারে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। ভাই-বোন হতে নিকটাত্মীয়-পরিজনদের মধ্যকার সম্পর্ক থাকা-না থাকাও নির্ধারিত হয়ে পড়েছে শ্রেণিগত অবস্থানের ভিত্তিতে। আমাদের শ্রেণি বিভক্ত সমাজে মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ওই শ্রেণি বৈষম্যের কারণেই। শ্রেণি বৈষম্যের অবসানেই সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা পূরণ সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই সেটা সম্ভব হবে বলে অনুমান করা যাবে না।

পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসনামলের প্রচুর বিচার-বিশ্লেষণ, ইতিহাস-গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছেও। কিন্তু পাকিস্তানি আমলের প্রায় দ্বিগুণেরও অধিক সময়ের বাংলাদেশ আমলের বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে কি? না, হয়নি। স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছরেও আমাদের দুরবস্থার কারণগুলোকে চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ-গবেষণা আমরা সঠিক অর্থে করতে পারিনি। কেবল স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বস্তির ঢেকুর তুলেছি। অনুসন্ধান করে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে পারিনি। যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতির পাশে দাঁড়িয়ে জাতিকে মুক্তির দিশা দিয়ে নতুন দিনের পথ নির্দেশনা দেবেন; তাদের সংখ্যা কমে কমে এখন আঙুল দিয়ে গোনা যাবে। অন্যরা অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠরা দলীয় বৃত্তে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন পার্থিব সুযোগ-সুবিধার লোভ-লালসায়। আর রাজনীতিকেরা? তারা তো নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে রাজনীতি নামক পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন।

রাজনীতি এখন পেশা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যারা প্রকৃত অর্থে জনগণের ভাগ্য ফেরাতে চান, বদলাতে চান সমাজ ও রাষ্ট্র, তারা পরস্পর অনৈক্য বিভাজনে এতটাই বিভক্ত যে, তারা হয়ে পড়েছেন জনবিচ্ছিন্ন। তাদের ঐক্যই একমাত্র আলোর দিশা। কেননা তাদের পক্ষেই কেবল সম্ভব নিজেদের ঐক্যের পাশাপাশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলে শাসকশ্রেণিকে পরাভ‚ত করে জনগণের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা ও মুক্তি নিশ্চিত করা। জনগণকে ধোঁকা দিয়ে দিয়ে বোকায় পরিণত করে গত ৪৯ বছর যারা শাসকরূপে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন এবং আছেন, তারা কেউ জনগণের প্রকৃত বন্ধু নন। নির্ভেজালরূপে শোষক ভিন্ন অন্য কিছু নন। তারা তাদের শ্রেণির সীমার বাইরে যাবেন তেমন প্রত্যাশা হাস্যকর এবং অবান্তরও বটে। নয়তো ৪৯ বছরের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন নির্বাচিত-অনির্বাচিত একটি সরকারকেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিতে দেখা যায়নি। প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকার অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৃত্ত অতিক্রমের নজির স্থাপন করতে পারেনি।

আমরা অতীত আমলের সুখ্যাতি বর্ণনা করি কেন? নিশ্চয় অপ্রাপ্তির হতাশায়। বর্তমান আমলের তুলনা বিচার করে অতীত আমলের সুখ-স্মৃতি রোমন্থন করি এই কারণে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাভ‚ত করে বিজয় অর্জন করেও সামষ্টিক আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। সেই ব্যর্থতার আড়ালে অতীত রোমন্থনে বর্তমানকে ভুলতে চাই। কিন্তু বর্তমানই দৃশ্যমান বাস্তবতা। একে এড়ানোর উপায় নেই এবং অসম্ভবও। আমাদের সামষ্টিক স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা এবং সর্বোপরি বৈষম্য নিরসনের একমাত্র উপায় বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং শাসকশ্রেণিকে পরাভ‚ত করা। এদের পরাভ‚ত না করা অবধি বছর ঘুরে বছর আসবে- যাবে, আমাদের জীবনের আয়ুষ্কাল খসে পড়বে কিন্তু আমাদের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেজন্য জনগণের অধিকার সচেতনতার পাশাপাশি জনগণের ঐক্য ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই। জনগণের ঐক্যেই অতীতের সকল জাতীয় অর্জন সম্ভবপর হয়েছে। আগামীতেও অনুরূপ ঐক্যে সমষ্টিগত মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব হবে বলেই মনে করি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App