×

পুরনো খবর

আশার নতুন বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:০৬ পিএম

উন্নতি তো হচ্ছে; জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, উদ্ভাবনায়, চিকিৎসায় বিশ্ব অনবরত এগুচ্ছে; আমরাও পিছিয়ে নেই। আমাদের জন্য বিদ্যুৎ ক্রমশ দুর্মূল্য হচ্ছে বটে কিন্তু তবু তো আমরাও ডিজিটাল হয়েছি, এনালগে নেই, আমাদের দেশেও রোবট এসেছে, মাশাল্লাহ আরো আসবে, এমনকি সব রকমের ঝুঁকি উপেক্ষা করে পারমাণবিক যুগেও সসম্মানে প্রবেশ করে ফেলেছি।

নতুন বছর আসে নতুন আশা নিয়ে। মনে করা হয় যে দিন বদলাবে। কিন্তু বদলায় না; এবং বদলায় না যে সেই পুরাতন ও একঘেয়ে কাহিনীই নতুন করে বলতে হয়। না-বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি। ওই অসফলতার কারণেই আমাদের প্রত্যাশাগুলো বারবার পর্যদস্ত হয়, হতাশার আবর্তে ঘুরপাক খেতে হয়। সম্ভাবনাগুলো জ্বলে উঠেও দপ করে নিভে যায়। আমাদের সামষ্টিক জীবনে মুক্তি যে আসেনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যর্থতার স্মারকচিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করছে। সবকিছুই গা-সওয়া হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ঘটনা ঘটে যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি, পরস্পরকে বলি যে আমরা তো ভালো নেই, কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীর নির্মম ঘটনা। চলতি বছর মার্চে ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে। পরে থানায় অভিযোগ করলে প্রিন্সিপালের পরিকল্পনায় ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার চেষ্টা করে তার অনুসারীরা। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত। সমাজে দেখছি আত্মহননের অসংখ্য ঘটনা। আত্মহত্যা কেউ এমনি এমনি করে না। যন্ত্রণা কেমন দুঃসহ হলে, হতাশা কতটা গভীরে চলে গেলে, নিঃসঙ্গতা কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে একজন তরুণ বা তরুণী আত্মহত্যা করে, মনে করে যে তার জন্য মৃত্যুই হচ্ছে বাঁচার একমাত্র উপায়, তা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এমনকি কল্পনা করাও সম্ভব নয়। জানে তা কেবল ভুক্তভোগী। আত্মহত্যার ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে; সকলে যে ওই পন্থাকেই বাঁচবার একমাত্র উপায় বলে মনে করে তা নয়, অনেকে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে, জীবনকে কঠিন বোঝা মনে করেও কোনো মতে টিকে থাকে; টিকেই থাকে শুধু, বেঁচে থাকে না। মেয়েরাই আত্মহত্যা করে বেশি, কেননা দুঃখের ঝড়ঝাপটাগুলো তাদেরই আক্রমণ করে প্রথমে এবং সহজে। ঘরে এবং ঘরের বাইরে, পথে, কর্মস্থলে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। খাদ্যের অভাব হলে বনের বাঘ জনপদে চলে আসে। বনের বাঘের জন্য সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষ যখন ক্ষুধার্ত বাঘে পরিণত হয় তখন সেই অস্বাভাবিকতাটা যে কেমন ভয়ঙ্কর হতে পারে কিশোরীদের আত্মহত্যা তারই নিদর্শন বটে। যে সব যুবক মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, দেখা যাবে তাদের অধিকাংশেরই কাজ নেই, কারো কারো কাজ থাকলেও কাজের কাজ নেই। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকেই তারা বীরত্ব প্রদর্শনের সবচেয়ে সহজ পন্থা বলে মনে করে। তারা ভয় পায় না, কেননা তাদের শাস্তি হয় না। পাড়ায়-মহল্লায় স্কুলের সামনে মেয়েরা সন্ত্রস্ত থাকে। অভিভাবকরা নিজেদের নিতান্ত অসহায় অবস্থায় দেখতে পান। কর্মহীন এই বখাটেদের পেছনে শাসক রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এরা দলের কাজে লাগে, দলও এদের কাজে লাগায়। দল বদলাতে এদের যে সময় লাগে তাও নয়। সামাজিক চাপে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সে আইনকে যে আরো বিস্তৃত ও শক্ত করা আবশ্যক মেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা সেই সত্যটাকেই জানিয়ে দেয়। আইনের প্রয়োগকেও কঠোর করা দরকার; সেই সঙ্গে আইনের বিধিগুলোর প্রচার ও তাদের প্রয়োগের দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে তুলে ধরাও আবশ্যক। কিন্তু যে ব্যাধির কারণে নির্যাতন ও আত্মহত্যা ঘটছে সেটা তো কেবল আইনের পরিধির বিস্তার এবং প্রয়োগের নিশ্চয়তা ও যথার্থতা দিয়ে দূর করা যাবে না, ব্যাধিটিকে উৎপাটিত করা চাই। পুঁজিবাদের যে গুণ নেই তা নয়, অবশ্যই আছে। সামন্তবাদের তুলনায় সে অবশ্যই উন্নত। ব্যক্তিকে সে স্বীকার করে, মর্যাদাও দিতে চায়, কিন্তু তার যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তাতে ব্যক্তিকে যে নিরাপত্তা দেবে সে কাজটি সে করতে পারে না। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক করে, তাকে ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়। এর ফলে দুর্বল যাদের অবস্থান সেই ব্যক্তিরা- অর্থাৎ দরিদ্র, শিশু ও মেয়েরাÑ যাদের হাতে বিত্ত ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয়। আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা অহরহ বলি, কিন্তু সব মানুষের মুক্তি তো কিছুতেই আসবে না যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা না ঘটাই। মুক্তির জন্য আমরা যে সংগ্রাম করিনি তাও নয়, কিন্তু মুক্তির জন্য সমাজব্যবস্থার অত্যাবশ্যক পরিবর্তনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না।

অবস্থাটা যে ভালো নেই সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছি, যেদিকে তাকাই দেখি ঝুঁকি রয়েছে, ওত পেতে। জরিপ বলছে বাংলাদেশের শতকরা ৯৭ জন মানুষই এখন কোনো না কোনো প্রকার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ কি? উন্নতি তো হচ্ছে; জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, উদ্ভাবনায়, চিকিৎসায় বিশ্ব অনবরত এগুচ্ছে; আমরাও পিছিয়ে নেই। আমাদের জন্য বিদ্যুৎ ক্রমশ দুর্মূল্য হচ্ছে বটে কিন্তু তবু তো আমরাও ডিজিটাল হয়েছি, এনালগে নেই, আমাদের দেশেও রোবট এসেছে, মাশাল্লাহ আরো আসবে, এমনকি সব রকমের ঝুঁকি উপেক্ষা করে পারমাণবিক যুগেও সসম্মানে প্রবেশ করে ফেলেছি। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? অসুবিধার কারণই বা কি? কারণটা না বুঝলে করণীয় কী তা ঠিক করা যাবে না। অনেকে আছেন যারা একেবারেই নিশ্চিত যে কারণটা হচ্ছে আমাদের নৈতিক অবক্ষয়। তাদের ভ্রান্ত বলা যাবে না। কিন্তু নৈতিকতা জিনিসটা তো আকাশে থাকে না, মনের ভেতরেই সে থাকে। এটা যখন মেনে নেই তখন এটাও তো কোনো মতেই অস্বীকার করতে পারি না যে মন চলে বস্তুর শাসনে। গল্প আছে দুজন ভিক্ষুক কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেছে, তুই যে লটারির টিকেট কিনলি, টাকা পেলে কি করবি? টিকেট-কেনা ভিক্ষুকটি বলেছে, টাকা পেলে সে একটা গাড়ি কিনবে। পরের প্রশ্ন, গাড়ি দিয়ে কি করবি? ভিক্ষুক বলেছে, ‘গাড়িতে চড়ে ভিক্ষা করবো, হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করতে ভারি কষ্ট।’ ভিক্ষুকেরও মন আছে, কিন্তু সে মন ভিক্ষাতেই আটকে গেছে, তার বাইরে যেতে পারেনি। পারবেও না। জীবন যার অনাহারে কাটে, স্বর্গে গিয়ে সে কোনো সুখের কল্পনা করবে, পোলাও-কোরমা খাওয়ার বাইরে? কিন্তু বড়লোকের স্বর্গ তো ভিন্ন প্রকারের। কোটিপতির ছেলে জন্মের পর থেকেই গাড়িতে চড়ে বেড়ায়; জন্মের আগে থেকেও চড়ে। তার স্বপ্ন তো গাড়িতে চড়ে ভিক্ষা করার নয়, সে স্বপ্ন গাড়িতে চড়ে এয়ারপোর্টে যাওয়ার। এয়ারপোর্ট হয়ে আমেরিকায় উড়ে যাওয়ার। ভিক্ষুক ও কোটিপতি একই দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, একই সময়েরই মানুষ তারা; কিন্তু তারা কে কোথায়? আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অন্যসব দেশের মতোই বাংলাদেশও ভালো নেই। রোগে ভুগছে। তার উন্নতিটা অসুস্থ। এই উন্নতি শতকরা পাঁচজনের, পঁচানব্বই জনকে বঞ্চিত করে; কেবল বঞ্চিত নয় শোষণ করেও। তাই যতই উন্নতি হচ্ছে ততই বৈষম্য বাড়ছে। কোটিপতিরা কোটি কোটির পতি হচ্ছে; উল্টো দিকে সংখ্যা বাড়ছে ভিক্ষুকেরও। দূরত্ব বাড়ছে মাঝখানের। ব্যবস্থাটা বদলানো যায়নি, যে জন্য আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। উন্নতি যা ঘটছে তা অল্প কিছু মানুষের, তারাও যে নিরাপদে রয়েছে তা নয়, আর বেশির ভাগ মানুষই কালাতিপাত করছে বিপদের মধ্যে। ব্যক্তিগত চেষ্টায় আমরা এই ব্যবস্থাকে যে বদলাতে পারবো না তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েও সেটা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না। যা প্রয়োজন তা হলো সমষ্টিগত, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেটা না করতে পারলে আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে পারবো না। পাঠকদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে কর্তব্যের কথা স্মরণ না করে পারা গেল না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App