×

জাতীয়

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২৯ এএম

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বছর

ভয়াবহ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে থাকল-২০১৯ সাল। এ বছরের শুরু এবং শেষ দিকের অন্তত চারটি অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহতার দিক থেকে ছাড়িয়েছে অতীতের রেকর্ড।

আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিয়েছে বস্তি-ফুটপাত-সড়ক থেকে শুরু করে বহুতল ভবনে অবস্থান করা ২ হাজার ১৩৮ জনের প্রাণ। জন্ম দিয়েছে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি, এফআর টাওয়ার, কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানা, গাজীপুরের ফ্যান কারখানা ও চলন্তিকা বস্তি পুড়ে ছাই হওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনার। জানমালের ক্ষতিসহ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে। আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। বিদায়ী বছরে একের পর এক অগ্নি-ট্র্যাজিডিতে টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট সবার। ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রোধ ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বেড়েছে কয়েকগুণ।

ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এ ঘটনাগুলোতে ২ হাজার ১৩৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৪ হাজার ৯৩২ জন। আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ২০৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৩১৫ টাকা। মাসভিত্তিক হিসেবে জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১৭৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ হাজার ৪৪টি, মার্চ মাসে ২ হাজার ৯৩৮টি এবং এপ্রিল মাসে ২ হাজার ৬৪২টি ঘটনা ঘটেছে। সর্বনিম্ন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে অক্টোবর মাসে, ১ হাজার ৩২৪টি। ২০১৯ সালের এ আগুনের ঘটনাগুলোর প্রায় ৩৯ শতাংশের জন্য দায়ী বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট। এরপরই ২২.৭ শতাংশ আগুন লেগেছে চুলা থেকে।

২০১৯ সালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে। কেমিক্যাল থেকে সৃষ্ট ওই অগ্নিকাণ্ডের একের পর এক বিস্ফোরণ কেড়ে নেয় ৭৬টি তাজা প্রাণ। ১২ ঘণ্টা স্থায়ী ভয়াবহতম এ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া এ প্রাণগুলো নাড়িয়ে দেয় গোটা জাতির বিবেক। চুড়িহাট্টায় বিভীষিকাময় স্মৃতির ক্ষত শুকাতে না শুকাতে ৫ সপ্তাহের মাথায় রাজধানীর অভিজাত বনানী এলাকায় এফ আর টাওয়ারে ফের ঘটে আরেক ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা। ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা নির্মাণ করা এই ভবনে প্রাণ যায় ২৬ জনের। প্রাণ বাঁচাতে বহুতল ভবন থেকে মানুষের লাফ দেয়ার দৃশ্য আজও মনে করিয়ে দেয় আগুনের ধ্বংসলীলা। উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে নিহত হন এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীও। এ দুটি আগুনের ঘটনা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। আগুনের ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

চুড়িহাট্টার ঘটনার ৬ দিন আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় অবস্থিত সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে এক শিশু রোগী মারা যায়। ওই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট কাজ করে। অন্যত্র সরিয়ে নেয়া সব রোগীকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সেখানে ওষুধসহ দাহ্য পদার্থ ছিল। এ ঘটনার পরে ৩০ মার্চ গুলশান-১ নম্বরে ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট। পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিতে দেখা যায়।

এরপর ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় ভয়াবহ আগুনে রূপনগরের চলন্তিকা বস্তি পুড়ে নিঃস্ব হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। আট থেকে ১০ হাজার পরিবার সেখানে বসবাস করতেন। এ ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও অনেকেই আহত হন।

সর্বনাশা আগুনের হানা অব্যাহত ছিল বছরের শেষ দিকেও। ১১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জে প্রাইম প্লেট এন্ড প্লাস্টিক কারখানার অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৩২ জন দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ২২ শ্রমিকের। এ ঘটনায় দগ্ধদের পোড়ার ভয়াবহতা বাংলাদেশের ইতিহাসের সব ঘটনাকে হার মানায় বলে মন্তব্য করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। প্লাস্টিক কারখানার এ আগুনের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুরের লাক্সারি ফ্যান কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ১০ শ্রমিক। সে রাতেই আগুন লাগে হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্টের বস্তিতে। ছাই হয়ে যায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীতে পৃথক অগ্নিকাণ্ডে কালশী বাউনিয়া বাঁধ এলাকার বস্তির ২ শতাধিক ঘর ও হাজারীবাগে একটি প্লাস্টিক কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয় বস্তির হাজার হাজার মানুষ।

ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। বাসাবাড়ি কিংবা বহুতল ভবনের ডেকোরেশনে হার্ডবোর্ডসহ ফলস সিলিং ব্যবহার করা হচ্ছে। যা আগুনের খুবই ভালো উৎস। এর সঙ্গে মানহীন ইলেক্ট্রনিকসামগ্রী ও কপারের পরিবর্তে দস্তার তৈরি ইলেক্ট্রিক তারের ব্যবহারও অনেকাংশে দায়ী। সবচেয়ে বড় বিষয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকার কারণেই অগ্নিকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও বিগত কয়েক বছরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।

এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, চলতি বছরের বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে এটি করতে গেলে জনভীতি তৈরি হবে ভেবে নোটিস দিয়ে ভবন মালিকদের সাবধান করার পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস নিয়মিত ভবনগুলোর ফলোআপ করছে। কোথাও কোনো ঘাটতি থাকলে সেগুলো সংস্কার করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ইউএনডিপির সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে, শুধু মাত্র বড় ধরনের ভ‚মিকম্প ছাড়া যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করার সক্ষমতা আছে ফায়ার সার্ভিসের। শুধু মাত্র ভবন নির্মাণ আইন মানলে এবং নিজে সচেতন হলে সময়ের সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা কমে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App