×

পুরনো খবর

শীতের পিঠা : শহুরে জীবনে গ্রামীণ পরশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:৩২ পিএম

শীতের পিঠা : শহুরে জীবনে গ্রামীণ পরশ

শীতকালজুড়ে এককালে গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে দেখা মিলত খেজুর গাছের সমারোহ। আর সেই গাছের রসের মিষ্টি গন্ধ ম-ম করত সারা গ্রাম। টাটকা খেজুর রসের তৈরি পায়েসের মিষ্টি স্বাদ আজো যেন জিভে অমৃতের স্বাদ এনে দেয়। গাঁয়ের বধূরা ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করতেন। চালের গুঁড়া, নারকেল কুচি আর খেজুর রসের গুড় দিয়ে ভাপা, পাটিসাপ্টার মতো বাহারি সব পিঠা বানাতেন। ছেলেমেয়েরা শীত সকালে বা সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে পাতা উনুনের পাশ ঘিরে বসে গায়ে উত্তাপ মেখে, গরম গরম পিঠা খেত। কখনো পায়েস ছাড়াও খেজুর রসে চিতই পিঠাসহ নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করতেন মায়েরা। সেই সময়ে বাংলার গ্রামগঞ্জসহ মফস্বল শহরের প্রতিটি ঘরে শীতের পিঠা-পায়েসের ধুম লেগে যেত। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যভরা ষড়ঋতুর দেশ আমাদের রূপসী বাংলা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্তহীন বিচিত্র, রূপে-রংয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আমাদের এ দেশ। বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির স্বাতন্ত্র্য ষড়ঋতুর শ্যামল বাংলাকে করে তোলে আরো মোহনীয়। খালবিল, নদীনালা, গাছপালা, লতাগুল্মে ছড়িয়ে পড়ে ঋতু পরিবর্তনের মোহন পরশ। আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে বাঙালির মন-প্রাণ। শীতের শুরুতে কুয়াশার চাদর ঢেকে দেয় বাংলার পথ-প্রান্তর। শহরের চেয়ে গ্রামগঞ্জের চেহারা যেন রাতারাতি পাল্টে যায়। গ্রাম-বাংলার ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় রূপ শহরের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান। হেমন্তের শুষ্ক আর উষ্ণ প্রকৃতিকে দূরে ঠেলে শীত নামে ধীরে ধীরে। টুপ টুপ শব্দে শিশির ঝরে, পত্র-পল্লবে শিহরণ জাগায়। মলিন দূর্বাঘাস শিশিরের ছোঁয়া পেয়ে কেমন হাসি মেলে। গাছের পাতা, গাঁয়ের মেঠোপথ ভিজে যায় শিশিরের স্নিগ্ধ জলে। অন্যদিকে বাতাসের দোল খেয়ে গাছের শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। শুকাতে থাকে খাল-বিল, নদী-নালার টলটলে জল। সোনালি ধানের গোছা কাটা শেষ হলে ক্ষেত পড়ে থাকে শুকনো খড়ের গাদা বুকে নিয়ে। মাঠজুড়ে নতুন করে চোখে পড়ে হলদে সর্ষে ফুল। মাঠে, ঘরের আঙিনায় শীতকালীন বাহারি সব শাকসবজির সবুজ সমারোহ মনকে মাতোয়ারা করে তোলে। গ্রামীণ জনপদ যেন মুখরিত হয়ে ওঠে ভিন্ন রূপে, ভিন্ন গন্ধে। বাগানে বাগানে ফোটে সোনালি সূর্যমুখী আর হলুদ গাঁদাফুল। চিরচেনা রূপসী বাংলার চিরন্তন এই রূপ ধূসর হয়ে ক্রমশ ম্লান হতে চলেছে স্মৃতির পাতা থেকে। যান্ত্রিক জীবনের ডামাডোলে শহুরে মানুষের আজকাল গ্রামগঞ্জে যাওয়ার বড় একটা সুযোগ হয়ে ওঠে না। গ্রামগঞ্জেও নেই আগের মতো পিঠাপুলি আর পায়েসের তেমন ধুম। সময়ের নিষ্ঠুর প্রয়োজনে এবং নগর জীবনের যান্ত্রিকতার জাঁতাকলে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম-বাংলার শীতকালীন পিঠাপুলির সব ঐতিহ্য। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত গ্রামীণ জনপদের মানুষের এখন দুবেলা খাবার জোগাতে প্রাণান্ত চেষ্টা। পিঠা-পায়েস তৈরি করে খাওয়া আজ তাদের কাছে অনেকটা বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। কমে গেছে খেজুর গাছের সংখ্যা। আবহাওয়ার পরিবর্তনে মরে গেছে অনেক গাছ। গৃহ নির্মাণের স্থান আর জ্বালানির প্রয়োজন মেটাতেও কেটে ফেলা হয়েছে অনেক খেজুর গাছ। খেজুর বাগানে তৈরি হয়েছে ঘরবাড়ি, করা হয়েছে অতি প্রয়োজনীয় শস্যের আবাদ। খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা গাছিদেরও আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অন্য পেশায়। সময়ের ব্যবধানে গ্রাম-বাংলার সেই পিঠাপুলি আজ শহরে এসে জায়গা করে নিয়েছে। সবার অলক্ষ্যে ঢাকাসহ বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে বসেছে পিঠাপুলির পসরা। শুধু শীতকালেই নয়, বছরজুড়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব পিঠা আজ শহরে বসে খাওয়া যায়। ছোট-বড় খাবারের দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাতে বসে পর্যন্ত নেয়া যায় পাটিসাপ্টা, চিতই, ভাপা পিঠার মনকাড়া স্বাদ। ঢাকায় বনানী, গুলশান আর বেইলি রোডের মতো অভিজাত এলাকার খাবার দোকানেও উচ্চমূল্যে বিক্রি হয় এসব পিঠাপুলি। অভিজাত এলাকায় কখনো বা চলে পিঠা-উৎসব। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বা ইট পেতে বসে দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষরা শখের বশে নয়, তাদের ক্ষুধা মিটাতে পিঠা খেয়ে থাকেন। আর শীতকালের মধুর খেজুর রস ছাড়া অন্যান্য ধরনের চালের রুটি, চিতইয়ের মতো সস্তা দামের পিঠাপুলি খেয়ে থাকেন ভাত কিংবা রুটির বদলে। আর শহরের ব্যস্ত জীবনে কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে রাস্তার পাশে রিকশা বা ভ্যান থামিয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে গিয়ে সেই পিঠা খেতে খেতে কখনো তাদের মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সুখের দিনগুলো। গ্রামগঞ্জে ফেলে আসা প্রিয়জনের মলিন মুখ। ছেলেবেলার কোনো শীতের সকালে উঠানে উনুনের পাশে বসে মায়ের আঁচল জড়িয়ে ধরে গরম পিঠাপুলি খাওয়ার মধুর সব স্মৃতি। আর এরই মাঝে হয়তো তারা খুঁজে পান শীতকালের গাঁয়ের পিঠা উৎসবের আমেজ, গ্রাম-বাংলার চিরচেনা মাটির সোঁদা গন্ধ আর নতুন ফসলের মিষ্টি ঘ্রাণ।

প্রকৌশলী, ঢাকা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App