×

পুরনো খবর

ব্রিটেনে স্মরণাতীত নির্বাচনের ফলাফল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:৫৯ পিএম

ব্রিটেনে স্মরণাতীত নির্বাচনের ফলাফল

ব্রিটেনের জাতীয় ইলেকশনে বরিস জনসন রেকর্ড মাত্রায় আসন পেয়ে কেন বিজয়ী হলেন এবং কী কারণেই বা বিরোধী দলের নেতা জেরিমি করবিনের ভরাডুবি হলো, নির্বাচনের আগেই তার কারণগুলো অনেকটা স্পষ্ট হয়েছিল। ব্রেক্সিট বিতর্ক নিয়ে কনজারভেটিভ বনাম লেবার পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদ উত্তপ্ত করার পরিস্থিতি থেকেও বোঝা গিয়েছিল, ২০১৬-এর গণভোটের ফলাফল উপেক্ষা করে নতুন করে গণভোটের দাবি, কিংবা এ সম্পর্কে লেবার পার্টির অবস্থান স্পষ্ট না করার পলিসি, তাদের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনবে না। সাড়ে তিন বছর ধরে পার্লামেন্টে বিস্তর ধস্তাধস্তি শেষে তাই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার রক্ষণশীল দলের যে সুবিশাল বিজয় হলো, ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা চিরকাল স্মরণীয় হয়েই থাকবে। ১৯৮৭ সালে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারের পরে এত বড় মাপের বিজয়লাভ রক্ষণশীল দলের জন্য যেমন কখনো হয়নি, তেমনি ১৯৩৫-এর পরে এতটা দুস্থ অবস্থায় লেবার পার্টিকেও পড়তে হয়নি কখনো। ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনী ফলাফলে রক্ষণশীল দলের আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬৫টি। লেবার পার্টির ২০৩। স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির অর্জন ৪৮। আর লিবারেল ডেমোক্রেট লাভ করেছে ১১টি সদস্যপদ। প্রাক-নির্বাচনী জনমত জরিপ করেও এই অনুপাতেই রাজনৈতিক দলগুলোর আসনলাভের ধারণা দেয়া হয়েছিল। ব্রেক্সিট নিয়ে এবারের নির্বাচনী যুদ্ধ যথার্থ অর্থেই ছিল জয়-পরাজয় নিশ্চিত করার অভিজ্ঞ প্রতিশ্রুতি। কয়েক সপ্তাহ ধরে যা ওলট-পালট করে দিয়েছে গ্রেট ব্রিটেনের চার প্রান্তকে। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের ভোটাররা যেমন, তেমনি রাজনৈতিক দলের নেতারাও তারিখ ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের ঝড়তুফানে প্রচন্ডভাবে উড়েছেন। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রগুলোতে সারাদিন ধরে উপচে পড়েছে ভোটারদের ভিড়। যা এখানকার ভোটের ইতিহাসে আগে কোনোদিন দেখা যায়নি। দীর্ঘ লাইনে সুদীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে করতে ভোট দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মাঝরাত অবধি সারাদেশের ১৪৪টি এক্সিট পোল থেকে স্থানীয়ভাবে ভোট প্রয়োগের পরে ১০ হাজার ভোটারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। দফায় দফায় নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে প্রোজেকশন দেয়া হয়েছে সেসব এক্সিট পোল থেকে। ১০০ পার্সেন্ট না হলেও পূর্বধারণা যে ৯৯.৯ পার্সেন্টই সঠিক ছিল, ফল প্রকাশের পরে সেটা সবার কাছেই স্পষ্ট। সংসদে কনজারভেটিভ দলের এই একক মেজরিটি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের রাজনৈতিক হাতকে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী করবে। সংসদে নির্ধারিত সময়ে (৩১ জানুয়ারির মধ্যে) ব্রেক্সিট ডিল পাস করা তো বটেই, ইইউর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ট্রেড ডিল নিয়েও নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে তিনিই থাকবেন মজবুত অবস্থানে। রক্ষণশীল দলের এই বিশাল বিজয়কে ব্রিটিশ মার্কেটও গ্রহণ করেছে ইতিবাচকভাবে। ব্রেক্সিট সমর্থনকারী দলের মেজরিটি নিশ্চিত হতেই ইউএস ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য বেড়েছে ২.২ পার্সেন্ট। এটাই ১৮ মাসের মধ্যে ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ডের সর্বোচ্চ মূল্যমান (১ পাউন্ড সমান ১.৩৩৪ ডলার)। ইউরোর বিপরীতেও ব্রিটিশ পাউন্ডের অবস্থান ঊর্ধ্বমুখী। স্টক মার্কেটের সূচক একদিনে ৫.৫ পার্সেন্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথমদিনেই বিভিন্ন সংবাদপত্রের নজর কেড়েছে ব্রেক্সিট-পরবর্তী অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। স্টক মার্কেটের সরগরম সংবাদ বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাই শিরোনাম হয়ে প্রকাশ পেয়েছে কয়েকটি দৈনিকের প্রথম পাতায়। এখন প্রশ্ন হলো, এবারকার জাতীয় নির্বাচনে লেবার পার্টির এতটা দুঃসময় ঘনিয়ে আসার কারণ কি শুধুই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের শক্তিশালী নেতৃত্ব? নাকি অন্য বাস্তবতাও রয়েছে এর পেছনে? লেবার দলের জনসমর্থন হারানোর মূলে, বর্তমান বাস্তবতা থেকে নেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার প্রবণতা। যা সৃষ্টি হয়েছে দলের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে ভারসাম্যহীন আদর্শের উপস্থিতিতে। অবাক হলেও সত্য, বর্তমান লেবার পার্টিতে অতিবাম ও অতিডান, দুই বিপরীত মেরুরই অস্তিত্ব বিরাজমান। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি যে পথে যাচ্ছে তাতে রাজনৈতিক আদর্শের জগাখিচুড়ি অবস্থান সচেতন ভোটারদের সমর্থন পেতে ব্যর্থ। সময়ের সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক আদর্শ অবশ্যই বদলেছে। যেমন- অর্ধশতাব্দী আগে শিল্প-কলকারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা সমর্থন করতেন বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে। ডানপন্থিদের দিকে আকর্ষণ ছিল সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণিদের। বিগত কয়েক দশকে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের এই ধারাও বদলে গিয়েছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু ব্রেক্সিটের কারণে গণভোটের পরে বাস্তবতা ধীরে ধীরে চোখ খুলে দিয়েছে শহর-গ্রামের সব শ্রেণির ভোটারদেরই। ইইউর ইমিগ্রেশন পলিসিসহ আরো কিছু আত্মঘাতী সিদ্ধান্তকেই সাধারণ ভোটাররা দায়ী করেছেন এদেশে অতিরিক্ত মাইগ্রেশন এবং অনুপ্রবেশের কারণ হিসেবে। যার জন্য জাতীয় অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা বেড়েছে। বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতাসহ চরমপন্থিদের ক্রাইমের ঘটনাগুলোও। অতিবামদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারণাও বর্তমান বাস্তবতায় নিষ্ফল। শহরের প্রফেশনাল শ্রেণি এই সত্য মর্মে মর্মে অনুধাবন করেই সমর্থন তুলে নিয়েছেন বামপন্থাদের থেকে। কেননা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কাউন্সিলের ওপর ইমিগ্রেশন পলিসি নিয়ে চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে লেবার দলের ম্যানিফেস্টোতে রয়েছে নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত ইনকাম ট্যাক্স এবং করপোরেট ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা। সাধারণ মানুষের টাকায় অতিরিক্ত মাইগ্র্যান্টদের পুষে রাখার এই অর্থনৈতিক আদর্শে সিংহভাগ ভোটাররাই আজ বীতশ্রদ্ধ। এর ওপর আরো এক বিশেষ বাস্তবতাও জেরিমি করবিনের ভরাডুবির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবার। ইউনাইটেড কিংডমে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ছাড়াও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী রয়েছেন। যেমন চাইনিজ, আরব, ইহুদি, ভারতীয়, পাকিস্তানি প্রভৃতি। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এথনিক গ্রুপ ব্রিটিশ ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং আরব। ১৯৯৭ সালে লেবার পার্টির ম্যাসিভ বিজয়ের পেছনে ৭৭ শতাংশ ব্রিটিশ ভারতীয়দের সমর্থন ছিল। পাকিস্তানিদের ছিল ৯০ পার্সেন্ট। ২০১৭-এ ভারতীয়দের সমর্থন ১২ শতাংশ কমে যায়। জেরিমি করবিনের লেবার পার্টির অভ্যন্তরে রেডিক্যাল আদর্শের ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য বেড়ে যাওয়ার কারণে। ২০১৫ থেকেই ভারতবিরোধী দল হিসেবে স্পষ্ট হয়ে পড়ে এ দলের অবস্থান। এরপর ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে লেবার নেতারা কাশ্মির ইস্যুতে প্রবলভাবে এন্টি ইন্ডিয়ান বক্তব্য দিলে ভারতীয় কমিউনিটিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া একইভাবে চলতে থাকে ইহুদিবিরোধী বক্তব্য আর মন্তব্যও। এসব ঘটনা ভীষণভাবে ক্ষেপিয়ে তোলে জুইশ কমিউনিটিকে। দলের অস্বচ্ছতা আর দায়িত্বহীনতার অভিযোগ এড়াতে জেরিমি করবিন এককালে জানিয়েছিলেন, তিনি কারোর বিরুদ্ধেই যেতে চান না। কারণ সমাজের সব মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একত্রে এগিয়ে চলায় তিনি আগ্রহী। কিন্তু সমাজের গভীর থেকে যখন ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করা হয়, তখন যে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ফাটল ধরানো পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া চলে না, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯-এর নির্বাচনের ফলাফল সেটা জানিয়ে দিয়েছে লেবার পার্টির প্রধানকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকার নীতিমালা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা জাতিবিদ্বেষ কতটা বিপজ্জনক, ব্রিটেনের জনসাধারণ এবার সেটাই তাকে মর্মে মর্মে অনুভব করিয়েছেন।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App