×

জাতীয়

অনুমোদন ছাড়াই ফ্যান কারখানাটি চলছিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৫৫ এএম

অনুমোদন ছাড়াই ফ্যান কারখানাটি চলছিল
গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কেশরিতা গ্রামে রবিবার সন্ধ্যায় লাক্সারি ফ্যান কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১০ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার দুপুরে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়। এর আগে ১০টি মরদেহ শনাক্ত করেন তাদের স্বজনরা। এরপর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকার ফরেনসিক বিভাগে প্রেরণের জন্য প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শাহীনুর ইসলাম জানান, উদ্ধারের পর মরদেহগুলো গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়। দগ্ধ ও ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়ায় রবিবার রাতে তাদের সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। গতকাল সকালে স্বজনরা জামা-কাপড়, হাতের ব্রেসলেট, জুতা, গলার চেইন ইত্যাদি দেখে নিহতদের শনাক্ত করেন। মরদেহগুলো দাফন ও সৎকারের জন্য প্রতিটি পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং কারখানা মালিকের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এদিকে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নোয়াগাঁও এলাকার লাল মিয়ার ছেলে পারভেজ (১৯), ময়মনসিংহের রাঘবপুর এলাকার সেলিম মিয়ার ছেলে মো. তরিকুল ইসলাম (২৪), দিনাজপুরের কাহারোল থানার বারপটিকা এলাকার হামিদ মিয়ার ছেলে মো. লিমন ইসলাম (২০), গাজীপুর সদর উপজেলার কালনী গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ ফয়সাল খান (২২), একই উপজেলার কেশরিতা গ্রামের নির্মল চন্দ্র দাসের ছেলে উত্তম চন্দ্র দাস (২৬), গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মারতা গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে শামীম (২৫), একই গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে রাশেদ (৩২), রংপুরের কাচুবকুলতলা এলাকার তাজুল ইসলামের ছেলে ফরিদুল ইসলাম (২১), নরসিংদীর বেলাব থানার চরকাশিনগর এলাকার সাজু মিয়ার ছেলে সজল মিয়া (২৫) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর এলাকার মোর্শেদ মিয়ার ছেলে ইউসুফ মিয়া (২৭)। অন্যদিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল থেকে তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহীনুর ইসলাম জানান, তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন স্থানীয় কলকারখানা পরিদর্শকের পক্ষে একজন, শিল্প পুলিশের পক্ষে একজন, জেলা পুলিশের পক্ষে একজন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে একজন। সাত কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল সকালে সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আবাসিক ভবনের আদলে তৈরি দোতলা ভবনের ছাদে নির্মিত টিনশেড ঘরে কারখানটি অবস্থিত। এতে একটি মাত্র ছোট সাইজের সিঁড়ি ও দরজা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এ ঘরটিতে কেমিক্যালসহ বিভিন্ন মেশিনারিজ ও নির্মাণ সামগ্রী রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা এ ঘরটিতেই ফ্যানের ফিটিংকাজ করত। অগ্নিকাণ্ডে যাবতীয় মালামাল ও পুরো ঘরটি পুড়ে কয়লার মতো হয়ে গেছে। পুলিশ পুরো ভবনটি ঘিরে রেখেছে। তারপরও ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি দেখতে ভিড় করে আছে উৎসুক জনতা। এদিকে রওজা হাইটেকের লাক্সারি ফ্যান কারখানাটির কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। গতকাল সকালে তারা কারখানা পরিদর্শন করে এমন তথ্য দেন। আর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কারখানাটির কোনো ফায়ার লাইসেন্স এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিচালক ফরিদ আহমেদ জানান, কারখানাটির শ্রম মন্ত্রণালয় তথা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন ছিল না। সম্ভবত শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের পর দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারখানাটিতে তৃতীয় তলা থেকে নিচে নামার একমাত্র সিঁড়ি ছাড়া বিকল্প কোনো সিঁড়ি বা পথ ছিল না। তৃতীয় তলায় দরজার পাশে আগুনের সূত্রপাত হলে সেখানে থাকা ১৯ জনের মধ্যে ৯ জন ঝুঁকি নিয়ে নিচে নামতে সক্ষম হলেও বিকল্প পথ না থাকায় ১০ জন শ্রমিক সেখানে আটকে পড়ে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে নিয়মানুয়ায়ী মামলা দায়ের করা হবে। এছাড়া আইন অনুযায়ী নিহত ও আহতদের কারখানার মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. মামুন অর রশিদ জানান, কারখানাটির কোনো ফায়ার লাইসেন্স ও অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না। আর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিজি মো. সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, তাদের তরফ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে ওই তদন্ত কমিটি। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, লাশ হস্তান্তরের সময় তার ঘোষিত ২৫ হাজার টাকা এবং মালিকের পক্ষ থেকে আরো ২০ হাজার টাকা প্রতি লাশের স্বজনদের প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরো ৫০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হবে। এদিকে জয়দেবপুর থানার ওসি মো. জাবেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অন্যদিকে লাক্সারি ফ্যান কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ হোসেন ঢালী মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং তারা যে উৎসব বোনাস ও বেতন পেতেন তাদের পোষ্যদের আজীবন তার সুবিধা প্রদান করা হবে। তবে ফায়ার লাইসেন্স এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অনুমোদনের বিষয়ে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App