×

সারাদেশ

ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধ আজও শেষ হলো না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:১৪ পিএম

ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধ আজও শেষ হলো না

১৫ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের সিংগাইর ধল্লা-গাজিন্দা যুদ্ধ দিবস। চুড়ান্ত বিজয়ের মাত্র একদিন আগে ৭১ সালের এই দিনে উপজেলার ধল্লা-গাজিন্দা গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ সংগঠিত হয় । যুদ্ধাকালীন কমান্ডার অ্যাডকোকেট ফজলুল হক খানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার সাথে এলাকার সাধারণ মানুষও অংশ নেন। এ যুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিছ, রমিজ ও শরিফ।

অপরদিকে, যুদ্ধস্থলে হানাদার বাহিনীর ১১ সেনা নিহত হয়। এছাড়া পাকিস্তানি সেনারা মেদুলিয়া গ্রামের ওফাজুদ্দিন, সাত্তার মোল্লা, আবু বক্কর , বোরহান, গাজিন্দা গ্রামের একই পরিবারের ইব্রাহিম খার ছেলে আকাইলা , তার স্ত্রী ফুলজান, শিশু পুত্র আওয়াল, শ্যালিকা বিশার মা, জায়গীর গ্রামের চরন, পূর্ব বাস্তা গ্রামের সামাদ, বাছের ডাক্তারসহ ২২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন শতাধিক লোক। সেই যুদ্ধে আহতদের মধ্যে অনেকেই মারা গেলেও বেশিরভাগই যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে আজও বেঁচে আছেন।

দিবসটি উপলক্ষে স্থানীয় ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ধল্লা ইউনিয়ন কাউন্সিল উচ্চ বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ আয়োজনে রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) সকাল ১০ টায় এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধকালিন ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ারুল হক খানের সভাপতিত্বে ও যুবলীগ নেতা মো. সাইফুল ইসলামের পরিচালনায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, যুদ্ধকালীন জেলা কমান্ডার ইঞ্জি. তোবারক হোসেন লুডু, উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মুশফিকুর রহমান খান হান্নান, ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন আক্তার, ধল্লা ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ভূইয়া, স্থানীয় ধল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।

এদিকে, দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর আওয়ামীলীগ সরকারের বিগত শাসনামলে ধল্লা ইউনিয়ন কাউন্সিল উচ্চ বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনিছ, রমিজ ও শরিফের সমাধিস্থল পাকাকরণ করা হলেও গাজিন্দা-মেদুলিয়া কবরস্থানে সমাহিত ২২জন গ্রামবাসীর কবর আজও চিহ্নিত বা সংরক্ষণ করা হয়নি।

বিভীষিকাময় যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে আজও বেঁচে আছেন গাজিন্দা গ্রামের পঙ্গু ইউসুফ আলী (৫৯)। ওই যুদ্ধে বাবা আকাইলা, মা ফুলজান, শিশু ভাই আওয়াল ও খালা বিশার মাকে হারান তিনি। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। স্বাধীনতার পর ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার একটি পা কেটে ফেলা হয়। স্বাধীন দেশে বিধ্বস্ত একটি পরিবারের পা হারানো ১২-১৩ বছরের কিশোর ইউসুফের জীবনে নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। সাইকেল-রিক্সা মেরামত কাজ করে বেঁচে থাকার নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাঁশের লাঠিকে পা বানিয়ে জীবনের পথে ছুটে চলছেন তিনি। এভাবে ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও অভাব তার পিছু ছাড়েনি।

বর্তমান মানসিক প্রতিবন্ধি স্ত্রী তোহরা খাতুন (৪৫) ছেলে জহুরুল, আমিনুল, সাগর, মেয়ে ইসমত আরা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধি আমেনা খাতুন ও সাথী আক্তারকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ইউসুফ। তার নিজস্ব কোন জমি নেই, অন্যের দেওয়া ছোট একটি ভিটে-বাড়ীতে কোন রকমে বেঁেচ আছেন তিনি। এ দীর্ঘ সময়ে তার ভাগ্যে জুটেনি সরকারি বা বেসরকারি কোন সাহায্য-সহযোগীতা । প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ৩ মুক্তিযোদ্ধাকে কবর জিয়ারত ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করা হলেও একই যুদ্ধে পরিবারের সবাইকে হারানো পঙ্গু ইউসুফের খবর কেউ রাখেন না।

প্রায় ৭ বছর আগে ইউসুফ আর্থিক সাহায্য ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্থানীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সুপারিশ সংম্বলিত লিখিত আবেদন করলেও কোন ফল পাননি। পঙ্গু ইউসুফ বলেন, দীর্ঘ ৪৬ বছরে সরকারি ভাবে বা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে তার কোন খোঁজ খবরই নেওয়া হয়নি। গত ৫ বছর আগে ধল্লা হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণসভায় জেলা যুদ্ধকালীন কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার তোবারক হোসেন লডু তাকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও তার বাস্তবায়ন করেনি। কমান্ডার লুডুর পিছু ঘুরতে ঘুরতে পঙ্গু ইউসুফ এখন ক্লান্ত বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, প্রতিবছর নানা আয়োজনে যুদ্ধ দিবস পালিত হলেও তাকে দাওয়াতটা পর্যন্ত দেয়া হয়না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App