×

বিশেষ সংখ্যা

মহাবিজয়ের মহান বার্ষিকী- কিছু অনুভূতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:১৭ পিএম

সর্বাত্মক নয় মাসের যুদ্ধ শেষে আটচল্লিশ বছর আগে ঢাকার মাটিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা চ‚ড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল। দ্বিজাতিতত্ত¡ বা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। এই ভাগে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নার হিন্দু-মুসলমান দুই জাতিতত্ত্ব বা প্রমাণিত হয়েছিল। একে অকার্যকর বা অসার প্রমাণ করতে তেইশ বছর সময় লেগেছিল বাংলাভাষী মানুষের। ধর্ম যে ব্যক্তির বিষয়, একে যে কখনো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, করা উচিত নয়, বিশেষত কোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, তারই নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল বাঙালি জনগোষ্ঠী। আমাদের মহাবিজয়ের ৪৮তম বার্ষিকীতে যখন লেখাটি লিখছি তখন পেছনের কথা মনে পড়ে; যুক্ত পাকিস্তানের তেইশ বছরের ঘটনাপ্রবাহ একের পর এক দেখতে থাকি। আমাদের প্রজন্মের তারুণ্য পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠমোতে নিজের চোখে ধর্মের নামে অধর্ম দেখেছে; সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়ন দেখেছে, বেসুমার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য দেখে দেখে তারা বিক্ষুব্ধ হয়েছে। এবং এই সঙ্গে শ্রদ্ধাবান হয়েছে, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি, এ কারণে যে, তারা এই নিপীড়ন ও অধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন। ফলে গড়ে উঠেছে সর্বাত্মক প্রতিরোধের পালা। ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের পর, ধর্মের বাঁধন ছিঁড়ে ভাষা-সংস্কৃতির ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সভ্যতার বাঁধন বড় হয়ে উঠেছে, প্রতিরোধের আগুন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে; বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এক কাতারে নেমেছে দ্বিজাতিতত্তে¡র বাঁধন টুটে গেছে। এরপর ঘটেছে ১৯৭১ সালের ব্যাপক গণযুদ্ধ যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই সৌভাগ্য হয়েছিল সেই জাতীয় যুদ্ধের সৈনিক হওয়ার। সে স্মৃতি যদিও পুরনো, ৪৮ বছর আগের, তবু তা আমাদের প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। এখনো, কখনো দেখা হলে, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়েও সবাই সবার দিকে তাকাই, নিজেদের শ্রেষ্ঠ সময়ের কথা মনে করি। এও মনে করি আমাদের প্রজন্মের হাতে যে পতাকার জন্ম তার দায়িত্ব আজকের এবং আগামীর তারুণ্যের। আমার বিশ্বাস আমাদের নবপ্রজন্ম সে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। ভালো লাগার সাথে মন্দ লাগারও অনুভ‚তি ঘটে ইদানীং। খবরের কাগজগুলোর দিকে তাকালেই দেখি মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগী মানুষেরা মৃত্যুবরণ করে চলেছেন। মৃত্যুর এই খবর আসে প্রায় প্রতিদিন। বেশিরভাগই মৃত্যুবরণ করছেন বয়সের ভারে, কেউ বা রোগে ভুগে, কেউ আবার নানান ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে। এই মুক্তিযোদ্ধারা বেশির ভাগই গ্রামগঞ্জের মানুষ, যারা জাতীয়ভাবে মোটেও পরিচিত নন। অথচ নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানি গ্রামগঞ্জের এই মানুষেরাই ছিলেন মুক্তি বাহিনীর সিংহভাগ। দেশ স্বাধীনের পর এঁরা প্রায় সবাই জাতীয় মঞ্চ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর একাত্তরের এই বীরগণ উপেক্ষিত, অবহেলিত হয়েছেন চরমভাবে। অনেককাল পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শধারী রাজনৈতিক শক্তি পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ায় আজ তাঁরা স্বদম্ভে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারছেন। লক্ষ করেছি এই জাতীয় বীরদের সবার মৃত্যুর খবর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় না হোক, ভিতরের পৃষ্ঠায়, কোথাও না কোথাও স্থান পায়। অবশ্য সবার মৃত্যুসংবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে যে স্থান পায় না তা নিশ্চিত আমি। তারপরও বলতে হবে স্থানীয় সংবাদদাতাদের কল্যাণে অনেক মুক্তিযোদ্ধারই মৃত্যুর খবর জানা যায়। যাঁদের জানা যায় না তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য যে, বিগত ৪৮ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সম্পন্ন করা যায়নি। মনে পড়ে, ১৯৭২ সালে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষরে আমরা প্রথমবারের মতো সনদ পেয়েছিলাম। ১৯৮৬ সালে একটি তালিকা করা হয়েছিল যাতে (সম্ভবত) ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। একই বছরে ভারত থেকে পাওয়া যায় আরেকটি তালিকা, যাতে ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এঁরা ট্রেনিং সম্পন্ন করেছিলেন। তবে এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয়, কারণ এর বাইরেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাঁরা স্থানীয়ভাবে, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের তত্ত¡াবধানে, দেশে কিংবা বিভিন্ন ভারতীয় শিবিরে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এঁদের তালিকা ভারতীয় নথিপত্রে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যাতে ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তত্ত্বাবধানে একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যা ‘লাল বই’ নামে পরিচিত। ওতে সর্বমোট ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম আছে। আমার মনে পড়ে, সে সময়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরকৃত একটি সনদ আমাদের হাতে পৌঁছে। এরপর ২০০১ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় পালাক্রমিকভাবে ২ লাখ ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় গেজেটভুক্ত করে। সব মিলিয়ে বর্তমানে (সম্ভবত) ২,৩০,০০০ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা আছে। এর মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৮৪ হাজার ২৯৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে (২০১৭ সালের হিসাব মতে) সম্মানী ভাতা দেয়া হচ্ছে। বাকিদের প্রক্রিয়া চলছে। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো গতানুগাতিক যুদ্ধ বা প্রচলিত যুদ্ধবিগ্রহ ছিল না, ছিল এমন এক গণযুদ্ধ, যাতে সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানই কেবল হরণ করা হয়নি, তাঁদের চ‚ড়ান্ত অবহেলার পাত্রই করা হয়নি, সেই সাথে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে নিছক একটি সামরিক যুদ্ধ বলে চালাবার চেষ্টা হয়েছিল! অথচ ১৯৭১ ছিল সার্বিকভাবে একটি জনযুদ্ধ যেখানে পূর্বতন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, সেদিনকার ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ-আনসারসহ গ্রামগঞ্জের ব্যাপক যুবতারুণ্য, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত ছাত্র, সাধারণ চাকরিজীবী এবং ব্যাপক সংখ্যক গ্রামীণ যুবক। কিন্তু ১৯৭৫ পরবর্তী দুই দশকে সামরিক ও আধাসামরিক সরকারগুলো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে বিতর্কিত করেছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধীদের পুনর্বাসিত করেছে, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। কাজেই পঁচাত্তর পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরির সংকটও অস্বীকার করা যাবে না। অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়েও কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠিয়েছেন, যা এক গর্হিত কাজ! অবশ্যই এর বিহিত হওয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের সুষ্ঠু এবং পূর্ণাঙ্গ তালিকা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা নিয়ে অবহেলা বা ছলচাতুরির সুযোগ নেই। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, এই তালিকা চ‚ড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় একাত্তরের আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিকরা যেন নতুন করে অপমানিত বা বিড়ম্বনার শিকার না হন। সতর্ক থাকতে হবে যাতে সত্যিকারভাবেই তালিকা থেকে রাজাকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা নন এমন ব্যক্তি, কিংবা যারা যারা বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে বাদ পড়েন। তা না হলে উদ্যোগটি ব্যর্থ হবে। জোর দিয়েই বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে ১৯৯৬ সালের পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে। মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মানের ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা মৃত্যুবরণ করেন তাঁদের কফিনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ‘গান স্যালুট’ জানায়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এছাড়াও আছে পদকধারী এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার জন্য বরাদ্দ হয়েছে নির্দিষ্ট অঙ্কের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা যা তিন মাস অন্তর অন্তর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এর বাইরে সম্প্রতি যোগ হয়েছে, সামান্য হলেও উৎসব বোনাস। বলা বাহুল্য, অর্থের হিসাবে এসব সুযোগ-সুবিধা যত কমই হোক না কেন রাষ্ট্র যে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেয় এ তারই স্বাক্ষর। অতএব নানা অভিযোগের পরও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত বোধ করেন। অতি সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলো যাতে একই নকশায় সংরক্ষিত হয় তা নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে। এটা যদি হয় তাহলে কবরগুলো ভালোভাবে সংরক্ষিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী সম্প্রতি আরো ঘোষণা দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হবে পর্যায়ক্রমে। এটি এক ভালো উদ্যোগ বলে আমার বিশ্বাস। কারণ সেই সমস্ত দেশদ্রোহীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকা উচিত, একই সঙ্গে থাকা উচিত আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা, যারা পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক আনুক‚ল্য লাভ করেছিল, দেশের মানুষের ওপর নির্মম গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা সবাই বয়োবৃদ্ধ। তাঁরা মৃত্যুবরণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। যে রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য তাঁরা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তান হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, অতি সামান্য প্রশিক্ষণে একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছেন, সে রাষ্ট্র যদি তাঁদের স্বীকৃতি না দেয় বা সম্মানিত না করে সে অপরাধ রাষ্ট্রের। এমন কোনো জাতি বা রাষ্ট্র নেই যে জাতি বা রাষ্ট্র তার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে না। কারণ এ সম্মান রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, জাতীয় দায়বদ্ধতা। এ করা না হলে রাষ্ট্র ইতিহাস বিবর্জিত হয়, নতুন নাগরিকরা তাদের জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যায়, জাতি শিকড় শূন্য হয়। সম্প্রতি কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধার জানাজা ও দাফনে গিয়ে মনটা যথেষ্টই খারাপ হয়েছে। প্রথমত, রণাঙ্গনের স্মৃতি ভিড় করেছে। স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর হয়েছি। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক শেষ বিদায় পাওয়ার আশায় তাঁদের পরিবারের সদস্যদের যত্রতত্র ছোটাছুটি করতে দেখেছি। দেখেছি তাঁদের ছেলেমেয়েরা কী আপ্রাণ চেষ্টায় এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাচ্ছেন, যাতে প্রয়াত জাতীয় বীর রাষ্ট্রের সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হন। তৃতীয়ত, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা যেন তাঁর স্ত্রী বা সন্তানরা লাভ করতে পারেন তার প্রক্রিয়াটি মোটেও সহজ মনে হয়নি। এই প্রক্রিয়াগুলোর সবটাই সরকারি অফিস-আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বলে তা সম্পন্ন করার সংকট বহুবিধ, যা অনেক ক্ষেত্রেই বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের বিব্রত করে ও সংকটে ফেলে। আশা করব মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার এই সংকটগুলোর সমাধানের দিকে নজর দেবে। অন্যথায় ভালো বা শুভ উদ্যোগগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। বিগত কয়েক বছরে আমেরিকা-ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে একটি বড় সংকট লক্ষ করেছি। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা কেন, বহু মুক্তিযোদ্ধাই বহু দেশে অবস্থান করেন পারিবারিক বা পেশাগত প্রয়োজনে। দেশের বাইরে থাকলেও বেশির ভাগই চান তাঁদের দাফন দেশের মাটিতে হোক, যে মাটি তাঁর আপন, যে মাটির জন্যে তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সেই মাটিতে। কেউ কেউ আবার বিদেশের মাটিতে কবরস্থ হন নানান পরিস্থিতিতে। এই মুক্তিযোদ্ধাগণ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন দুটি অবধারিত সংকটে পড়ে তাঁদের পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুগণ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাষ্ট্রীয় সম্মানের আয়োজন করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই সে প্রত্যাশার পূরণ ঘটে না। ‘গান স্যালুট’ যেহেতু পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দিয়ে থাকেন, সেহেতু দূতাবাস কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় সম্মান দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অন্য সংকটটি ঘটে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দেশে পাঠানো নিয়ে। অনেকের কাছেই শুনেছি, বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে, বন্ধু-আত্মীয়স্বজনের আপ্রাণ সহযোগিতায় লাশগুলো দেশে পাঠানো হয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। প্রথমত, যেসব মুক্তিযোদ্ধা বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করবেন এবং সেখানেই সমাহিত হবেন, তাঁরা যেন প্রথাগতভাবে রাষ্ট্রীয় সম্মান লাভ করেন, তার নিশ্চয়তা থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি দূতাবাসে এ সংক্রান্ত নির্দেশনামা থাকা উচিত, যাতে সেখানকার দূতাবাসগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে পারে। অন্যদিকে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ যেন রাষ্ট্রীয় খরচে দেশে ফিরতে পারে, সে লক্ষ্যেও ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। বহুভাবেই বহু অর্থের নয়ছয় ঘটে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়, কাজেই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে কিছু অর্থ খরচের বিষয়টি সরকার ভেবে দেখবে সে আশাই রাখি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App