×

মুক্তচিন্তা

পরাজিত শক্তির ঔদ্ধত্য রুখতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৮:২২ পিএম

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রাজনৈতিক দলকে ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়েছে, তাকে কেন আজো নিষিদ্ধ করতে পারছে না? জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নির্বাচন কমিশনও বাতিল করে দিয়েছে, তাহলে সরকার কেন ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস দেখাতে পারছে না। আজ এই বিজয়ের দিনে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা যদি কঠোর কর্মপন্থা গ্রহণ করে পরাজিত এই অপশক্তির ঔদ্ধত্যকে রুখে দিতে না পারি, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদেরই পস্তাতে হবে।
ষোলোই ডিসেম্বর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস। মুক্তিসংগ্রামেরও অবসান ভেবেই সবাই কোমর বেঁধেছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ববঙ্গকে মুক্তিযুদ্ধোত্তর ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তুলতে। মুক্তিফৌজ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিল এ দেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবে। সবাই এ প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করে এবারে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলব। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের ৪৯ বছরে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে কি বলতে পারি, আমরা আদতেই সাম্প্রদায়িক হানাহানি, ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা অমুসলিম নিধন, তাদের ভ‚মিগ্রাস, ধনসম্পদ লুট বন্ধ করতে পেরেছি? পেরেছি কি হিন্দু রমণী ধর্ষণ বন্ধ করতে? সমাজের শ্রেণিবৈষম্য কি পেরেছি দূর করতে? তাই ভাবছি, আর মাত্র এক বছর পর আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশকে নিজেদের আকাক্সক্ষায় গড়ে তুলতে পারব? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আমাদের বিপুল প্রত্যাশা ছিল দেশে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে যারা নানা দিক থেকে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম, তারাই তো একত্রে থাকতে পারলাম না। আমরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি বলে গর্ব করলাম কিন্তু আদিবাসী জনগণের বিপুল সংখ্যার জনগোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেননি তারা তো আর হঠাৎ করে বাঙালি হয়ে যেতে পারল না। ফলে নতুন শোষণের আশঙ্কায় বৈরী মনোভাব নিয়ে তারা নব্যরাষ্ট্রীয় সত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। আজ আমাদের প্রত্যাশাকে শানিত করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাঙালি জাতীয়তাবাদী গৌরবকে, না হলে আজ যাদের কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ হতে চলেছে, দেশময় সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অনাকাক্সিক্ষত যে আস্ফালন দেখতে পাচ্ছি, তা আরো বিস্তৃত হবে। তাই বাংলার সেই অকুতোভয় মানুষের ঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করে প্রতিক্রিয়াশীল পিশাচ শক্তির বিরুদ্ধে বিপুল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে আমাদের। আজ আমরা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান ও যে বিস্তার লক্ষ করছি, তার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি যে দায়ী, তা স্বীকার করে এর বিরুদ্ধে গণঐক্য ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ওই মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরাজিত শক্তির হাতে চলে যাবে। আজ রাজনীতি সচেতন সব মানুষকেই ভেবে দেখতে হবে। সামনে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী অথচ আমরাই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে কতখানি হতমান করছি। ভেবে দেখতে হবে, কেন আজ দেশ ও জনগণ এতটা ধর্মান্ধতার পথে চোখ বুজে এগিয়ে চলেছি। তবে কি মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যকে সাধারণ মানুষের কাছে যেভাবে তুলে ধরা এবং জীবনে প্রতিফলিত করা উচিত ছিল, আমরা কি তবে সেই জাতীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি? আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কেন এতটা ছাড় দিলাম। যার কারণে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এমনভাবে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকেই মনে হচ্ছে যেন ওদের কাছে বিসর্জন দিয়েছি। জাতির মেরুদÐ শিক্ষা, তার ওপর হেফাজতের ছড়ি ঘোরানোকে কি করে গ্রহণ করলাম আর সেই মতো দেশের পাঠ্য বিষয় তারাই নির্দিষ্ট করে দিল। আমরা খানিকটা হলেও মেনে নিলাম। তবে লোক দেখানো ‘পরিবর্তন’ ঘটানোর জন্য কমিটি করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেয়া হলেও, তাদের সুপারিশ কতখানি গ্রহণ করা হয়েছে? যতটুকুই গ্রহণ করা হয়েছে তা তো দুধের পাত্রে লেবুজল ফেলার মতোই হয়েছে। কেন এমন হলো? এই যে আমাদের দুর্বলতা এর জন্যই কি ধর্মান্ধগোষ্ঠী নানা অগ্রহণযোগ্য দাবি ধর্মের দোহাই দিয়ে আজ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়নি? রাষ্ট্রের কাছে হেফাজতে ইসলাম কতটা যে প্রশ্রয় পেয়েছে তারই প্রমাণ ওদের ঔদ্ধত্য। সে সীমা ছাড়িয়ে সরকারপ্রধানকে পর্যন্ত তাদের সমাবেশে হাজির করিয়েছে। শুধু কি তাই, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে ওরা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রির সমতুল্য করিয়ে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষত সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছি আমরাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি আজ ক্ষমতাসীন, তাকে বেমক্কা অবস্থায় ফেলার জন্য পুরনো কৌশল আবার এঁটেছে। শুধু সরকারই নয়, দেশের সচেতন শিক্ষিত গণতন্ত্রমনা জনগণও কোনো প্রতিবাদ তেমনভাবে করেননি বলেই তারা লাই পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে। এদের এসব আবদার আজ জাতির সামনে নানা শঙ্কা ও বিপদের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এই নচ্ছাড় লোকবিরোধী ধর্মান্ধতা দেশের সর্বত্র- গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত ওরা সুসংগঠিত পদক্ষেপে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই তো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কর্তৃত্ব আজ দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে। সুপ্রিয় পাঠক, দেশের এমনি এক অভাবিত দুর্যোগের কালে ইতোমধ্যেই তারা দেশের সর্বত্র নানা ফন্দি-ফিকিরে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। কী তবে ব্যাপার, ১১ ডিসেম্বর ছিল জীবন্ত কসাই জল্লাদ কাদের মোল্লার ফাঁসির দিন। এই দিনটিকে স্মরণ করেছে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম। এই পত্রিকা জল্লাদ কাদের মোল্লার ফাঁসির দিনে তাকে ‘শহীদ’ হিসেবে অভিহিত করার দুঃসাহস নয়, ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ফাঁসির দিনকে ‘শাহাদতবার্ষিকী’ বলে প্রতিবেদন লিখেছে। এবারে কি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি বুঝতে পারছে, ওরা কতদূর আমাদের পেয়ে বসেছে? আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ওদের স্পর্ধা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার যে, আজ তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিষয়গুলোকে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে জনগণের সামনে তুলে ধরার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। আমরা সবাই তো জানি, কসাই কাদের মোল্লা নরপিশাচের হিংস্রতায় মানুষ হত্যা করেছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসীদের মেরে ফেলেছে। তার হত্যাকাণ্ডের ফিরিস্তি নতুন করে আর দিতে চাই না। আমরা সবাই জানি, এই জীবন্ত জল্লাদকে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল তখন ঢাকার অগণিত জনগণ ছুটে এসেছিলেন শাহাবাগ চত্বরে, সৃষ্টি করেছিলেন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ এবং লাখো কণ্ঠে কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবি জানিয়েছিলেন। জনগণের দাবি ট্রাইব্যুনাল ফেলতে পারেনি। তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে লটকে রায় কার্যকর করা হয়েছিল। তাকে কি করে ‘শহীদ’ লেখার সাহস এতদিন পরে দৈনিক সংগ্রাম পেল। তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বর্তমান সরকার বুঝতে পারছে কাদের প্রশ্রয় দিয়ে ধৃষ্টতা দেখানোর সাহসের জোগান দিয়েছে। আমরা তো দীর্ঘকাল থেকেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার সন্ত্রাসকে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা উচ্চকণ্ঠে বলছে বটে কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রাজনৈতিক দলকে ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়েছে, তাকে কেন আজো নিষিদ্ধ করতে পারছে না? এ প্রশ্ন সচেতন প্রতিটি নাগরিকের। আমরা তো জানি জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নির্বাচন কমিশনও বাতিল করে দিয়েছে, তাহলে সরকার কেন ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস দেখাতে পারছে না। অথচ সময়ের এই ফাঁকফোকর গলে জামায়াত কিন্তু ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে চলেছে। শহর থেকে ক্রমশ গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ধর্মান্ধতার প্রচার করে বেড়াচ্ছে। ফলে সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষের মনে নতুন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে। এদের প্রতিহত করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে যতই বলি না কেন, বাস্তবে তা শূন্যগর্ভই থেকে যাবে। আর এমনি করেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগে যুদ্ধাপরাধী নরপিশাচদের নামের সঙ্গে ‘শহীদ’ লেখার সুযোগ নেবে। দৈনিক সংগ্রাম যে অপরাধ করেছে তা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। এদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত। না হলে তারা এই সাহস দেখাতে দেখাতে কোথায় যে পৌঁছবে তা আমরা ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই জামায়াতি কর্মকাণ্ড আঁচ করতে পারছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে নাগরিকপঞ্জি ও সংবিধানের বিধি রদ করার মোদি কার্যক্রমে সারা ভারতে যে অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, আমার ধারণা, তাতে জামায়াতিরা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করবে এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিকে পাপে নিমজ্জিত করার অপচেষ্টা চালাবে। সুতরাং আজ এই বিজয়ের দিনে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা যদি কঠোর কর্মপন্থা গ্রহণ করে পরাজিত এই অপশক্তির ঔদ্ধত্যকে রুখে দিতে না পারি, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদেরই পস্তাতে হবে। কামাল লোহানী : সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App