×

পুরনো খবর

৪৮ বছরেও তৈরি হয়নি শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:২৬ এএম

৪৮ বছরেও তৈরি হয়নি শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা

মুক্তিযুদ্ধের পর পেরিয়ে গেছে সুদীর্ঘ ৪৮ বছর, অথচ আজও তৈরি হয়নি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও সুশীল সমাজ বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের তালিকা প্রণয়নের কথা বললেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা আসলে কত, তারা কারা- এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোথাও নেই। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। তবে বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে ৩২৫ জনের নাম ও পরিচয় রয়েছে। অবশ্য তথ্য নিয়ে বিভ্রান্ত থাকলেও আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জাতি স্মরণ করবে দেশের সূর্যসন্তানদের।

১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেও মূল হত্যাকাÐটি ঘটে আত্মসমর্পণের আগমূহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর রাতে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা পরিকল্পিতভাবে সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে

বীভৎস নির্যাতন চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভ‚মিতে ফেলে রাখে তাদের। একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কুখ্যাত রাও ফরমান আলি এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলির টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।

১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। এ ছাড়া ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্মিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬৩৭ প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক, ২৭০ সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজশিক্ষক শহীদ হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয়- শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ বিশেষ পেশাজীবীরা ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

ওই নীতিমালা অনুযায়ী- ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সংগৃহীত ২৫০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহও সম্ভব হয়নি। পরে কোষগ্রন্থের নাম-ঠিকানা ধরে খোঁজখবর নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশ কয়েকজনের নিকটাত্মীয়ের লেখা সংকলিত করে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রকাশ পাওয়ার পর ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং কোষগ্রন্থে প্রকাশিত তালিকার বাইরের অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়স্বজনও তাদের তথ্য নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করে বাংলা একাডেমি।

এদিকে ‘বাংলাপিডিয়া’র তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় রয়েছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। সব মিলিয়ে এই তালিকায় নিহত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১ হাজার একশ’ ১১ জন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ১৫২ জনের নামে স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে সরকার।

রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন গবেষকরা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী বলতে অনেক সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা চিকিৎসককেই বুঝে থাকি। কিন্তু বাস্তবে যিনি বুদ্ধির চর্চা করেন তিনিই বুদ্ধিজীবী। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও বুদ্ধিজীবী হতে পারেন। এই সংজ্ঞা নির্ধারণ আগে জরুরি। এ ছাড়া দেশকে মেধাশূন্য করতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কেউ যেন কট‚ক্তি না করতে পারে সেজন্য তালিকার পাশাপাশি আইন প্রণয়ন প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই গবেষক।

এ ব্যাপারে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, পাকিস্তানিরা ১৯৬৯ সালেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে চেয়েছিল। পারেনি। যুদ্ধের শুরুতেই রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে তারা হত্যা করে, বুদ্ধিজীবী তালিকায় এদের নাম নেই। এ ছাড়া গ্রামেগঞ্জে অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন যারা বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করতেন। এই তালিকা এখন সময়ের দাবি। আমাদের কাছে ৫০০ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম রয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কজন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন- ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী, হুমায়ূন কবীর, রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এন এম মনিরুজ্জামান, এ মুকতাদির, শরাফত আলি, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এম এ সাদেক, এম সাদত আলি, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, রাশীদুল হাসান, এম মর্তুজা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হবিবুর রহমান, ড. সুখারঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউম। চিকিৎসকদের ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, ডা. আলিম চৌধুরী, ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলি, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফী। সাংবাদিকদের মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা। গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক এবং দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা, শিক্ষাবিদ, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সমাজসেবক, আয়ূর্বেদিক ও চিকিৎসক নূতন চন্দ্র সিংহ লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, কবি মেহেরুন্নেসা, গণিতজ্ঞ ড. আবুল কালাম আজাদ, আইনজীবী নজমুল হক সরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App