×

পুরনো খবর

রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ কাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:১৯ এএম

রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ কাল

অবরুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত মুক্তি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে একাত্তরের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী রোডে জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহকারী আমির মওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে ৯৬ জনকে নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মহান একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের মধ্যে ছিল গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা। মুক্তিযোদ্ধাদের চিনিয়ে দেয়া, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া, নারী ধর্ষণ, ধর্ষণে সহায়তা করা, অগ্নিসংযোগ, খুন, লুটসহ নৃশংসসহ গণহত্যার বিকৃত উল্লাসে অংশ নিয়েছে তারা। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর সারাদেশে ১১ হাজার রাজাকারের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ঘাতক বাহিনীর তালিকাও প্রণয়ন এবং প্রকাশ করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিজয় দিবসের আগেই আগামীকাল রবিবার সকাল সাড়ে ১১টায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রায় ১১ হাজার রাজাকারের নাম ও পরিচয়সহ এই তালিকা প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে পাকিস্তান সরকারের বেতনভোগী ৩৯৯ জন। ইতোমধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সাড়ে আট হাজার রাজাকারের তালিকা আপলোড হয়েছে। এখনো আপলোড অব্যাহত আছে। জনসাধারণের জন্য ১৫ ডিসেম্ব^র তালিকাটি উন্মুক্ত করা হবে। জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতার

উদ্যোগে দালাল আইনে রাজাকার-আলশামসদের গ্রেপ্তার ও বিচার শুরু হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একে একে ছাড়া পেয়ে যায় সবাই। একসময় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায় রাজাকার তালিকা প্রণয়নের কাজ। পরে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে জাতীয় সংসদ- সর্বত্র তাদের দাপটে ধ্বংস হয়ে যায় কুকর্মের অনেক আলামত। তালিকা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এদের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছিল। তখন রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তারা ভাতা পেত। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর নিজামী-মুজাহিদরা সেই তালিকা সরিয়ে ফেলে। তবে সব সরাতে পারেনি। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে তালিকা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, তালিকাটি প্রতিটি জেলায় জেলায় পাঠানো হবে। প্রতিটি জেলার একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাজাকারদের নাম, পরিচয় এবং একাত্তরে তার কুকর্ম উল্লেখ থাকবে; যেন নতুন প্রজন্ম তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে পারে।

রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, একাত্তরে রাজাকারদের চেয়েও নিষ্ঠুর ছিল আলবদর বাহিনী। পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মুহাম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর শহরে এই বাহিনী ছিল রাজাকার বাহিনীর গুপ্তঘাতক। রাজাকার বাহিনীর মতোই এদের তালিকাও প্রকাশ করা জরুরি মন্তব্য করে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১-এর চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম ভোরের কাগজকে বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে রাজাকার-আলবদর বাহিনী। এরাই পাকিস্তানি সেনাদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে গেছে। নারীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গেছে। বিজয়ের ৪৯ বছরে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ হচ্ছে- এটি অত্যন্ত আনন্দের। এদের তালিকাটি প্রতিটি জেলায় জেলায় রাখা প্রয়োজন।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় রাজাকারের তালিকায় রয়েছে ১৫৯ জনের নাম। এর মধ্যে তালিকার প্রথম নামটিই হচ্ছে মেহেরপুর-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সাহিদুজ্জামান খোকনের পিতা ও গাংনীর টেরাইল জোয়ারদার পাড়ার বাসিন্দা শান্তি কমিটির ভাতাপ্রাপ্ত সদস্য আবদুল গনি বিশ্বাস এবং দ্বিতীয় নামটি সংসদ সদস্যের চাচা ফণি বিশ্বাসের। তাদের এক পরিবারের ৭ জন শান্তি কমিটির সদস্য বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নড়াইলে ৫০ জন, শরীয়তপুরে ৪৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। প্রকৃত রাজাকার কত? : গবেষকদের মতে, দীর্ঘ ৪৮ বছরে অনেকেই মারা গেছেন। আর যারা জীবিত রয়েছেন তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কারো কারো মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। আবার কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন। ফলে নির্ভুল তালিকা তৈরি অনেকটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজির বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, তারা ৫০ হাজার লোককে রিক্রুট করেছিল। তাদের টার্গেট ছিল এক লাখ। তৎকালীন আনসার বাহিনী পুরোটাই রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তর হয়েছিল। মোটামুটি ৫০ হাজারের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা মন্তব্য করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির

ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থকরা। ফলে রাজাকার বা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিবরণ মুছে ফেলতে চেয়েছে। এ কারণে তারা কখনোই উদ্যোগী হয়নি। ১৯৮৫ সালে প্রথম ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ নামে একটা বই বের করি। মেজর শামসুল আরেফিন বইটিতে ৩৩ হাজার ঘাতক দালালদের পরিচয় তুলে ধরেন। এটিই এখন বিভিন্ন জায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের এই গবেষক বলেন, শুধু রাজাকার নয়, নিষ্ঠুর বাহিনী আলবদর, আলশামসদের তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন। এরা কোথায় আছে, এদের উত্তরসূরিরা কোথায় এটি জানা প্রয়োজন। হয়তো সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘাপটি মেরে রয়েছে, প্রয়োজনে ছোবল মারার সুযোগ খুঁজছে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা ২০০৮ সালে রাজাকারের তালিকা তৈরি করি। সরকার নতুন করে তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, এ জন্য সাধুবাদ জানাই। তবে যারা নাটের গুরু তাদের প্রত্যেকের নাম থাকতে হবে। শান্তি কমিটির প্রতিটি সদস্যের নাম থাকতে হবে। যে ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী বন্দি ছিল তাদের গেজেট কোথায় গেল? এটি খুঁজে বের করা জরুরি। সেই সঙ্গে আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের তালিকাও প্রকাশ করা উচিত। এমন আইন হওয়া উচিত যাতে তারা বা তাদের উত্তরসূরি কোনো রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে না পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App