×

পুরনো খবর

ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিতর্ক

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:৪৩ পিএম

ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল অনুমোদিত হলো সংসদের দুই কক্ষে। আসামে নাগরিকপঞ্জি নিবন্ধীকরণের সময় ১২ লাখ হিন্দুসহ ১৯ লাখ লোক বাদ পড়ার কারণে দ্রুততার সঙ্গে এই বিল এলো। আসাম, ত্রিপুরায় আগুন জ্বলল। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ উঠল। নয়াদিল্লির বিমানে ওঠার কয়েক ঘণ্টা আগে সফর বাতিল করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। এগুলো প্রত্যেকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলো ও বাংলাদেশ কেন ক্ষুব্ধ? প্রত্যেক গোষ্ঠীর ক্ষোভের কারণ আলাদা আলাদা। আগে দেখা যাক এই বিলটি যা আইনে পরিণত হয়েছে সেটা কী। এই বিলে বলা হয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধসহ আরো কিছু অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা, যারা নিজের দেশে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে, তারা যদি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকে, তবে তারা এই আইনের আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত। অর্থাৎ অমুসলিমরা ভারতে ৬ বছর বসবাসের পর সেখানকার নাগরিকত্ব পাবেন, যা আগে ছিল ১১ বছর। তাদের কোনো কাগজপত্র না থাকলেও চলবে। এ বিষয়ে শাসক দল বিজেপির বক্তব্য- উল্লেখ্য, তিনটি দেশ তাদের সংবিধান অনুযায়ী ঘোষিত ইসলামিক দেশ, সেসব দেশে অমুসলিম নাগরিকরা অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, কাজেই সেই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেয়া ভারতের কর্তব্য, দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করে কংগ্রেস যে ভুল করেছিল এ তার প্রায়শ্চিত্ত। পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য এই যে, সংবিধান অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, সেখানে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষজনকে বিশেষ সুবিধাদান ধর্মভিত্তিক বিভাজনকে উৎসাহ দেয় এবং সংবিধানের উদ্দেশ্য পরিপন্থী। কিন্তু সংসদের সংখ্যাধিক্যের জোরে বিজেপি এই বিলকে আইনে পরিণত করতে পারল এবং এই নাগরিক সংশোধনী বিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। তাদের নির্বাচনী ইশতোহারে যা যা ছিল যেমন কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, রামমন্দির নির্মাণ, এনআরসি ও নাগরিক সংশোধনী বিল সেগুলো তারা একে একে করে চলেছে। তাদের বক্তব্য- এই প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জনাদেশ পেয়ে ক্ষমতায় বসেছি, কাজেই প্রতিশ্রুতি পালন করে অন্যায় করছি কোথায়? অকাট্য যুক্তি। কাশ্মিরে বা অযোধ্যায় যাই হোক না কেন তা সরাসরি সীমান্ত রাজ্য বা বাংলাদেশকে আঘাত করে না। কিন্তু নাগরিক সংশোধনী বিল বিভিন্নভাবে এই অঞ্চলের বেশ কিছু স্বার্থে সরাসরি আঘাত করছে। আগে দেখা যাক সেগুলো কী কী? প্রথমে আসা যাক আসামসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে। এই বিল থেকে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে মেঘালয়ের পুরোটা, আসাম-ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশ। অর্থাৎ এই জায়গাগুলোতে পূর্ববর্তী নিয়ম জারি থাকবে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে (ক্যাব) বলা হয়েছে, সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অন্তর্ভুক্ত এলাকা এবং ১৮৭৩ সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশনের আওতায় ইন্টার লাইন নোটিফায়েড এলাকাগুলো পুরোটাই এই ক্যাবের আওতার বাইরে থাকবে। ইনারলাইন পারমিট (আইএলপি) লাগু রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে। সেই পারমিট লাগু থাকবে। লাইন পারমিট কী? ভারতের অন্য যে কোনো জায়গার নাগরিকদের এই তিনটি রাজ্যে প্রবেশ করতে গেলে এই বিশেষ পারমিট লাগে। তাহলে এই ছাড়ে লাভ কি? আইএলপিভুক্ত রাজ্যগুলোতে অন্য রাজ্য থেকে আসা বহু অভিবাসী ইতোমধ্যেই রয়েছেন। তাদের দীর্ঘমেয়াদি পারমিট রয়েছে এবং সেগুলো রিনিউও করানো হয়। এখন প্রশ্ন হলো, ক্যাবের আওতায় যারা নাগরিক হবেন, তারা কি এ রাজ্যগুলোতে অন্য নাগরিকদের মতোই আইএলপির জন্য আবেদন করতে পারবেন? না, পারবেন না। বহিরাগতদের (অন্য রাজ্য বা অঞ্চলের ভারতীয় নাগরিক) ষষ্ঠ তফসিল বা ইনারলাইনভুক্ত এলাকায় প্রচুর বিধি-নিষেধ রয়েছে। এই নিয়মগুলোর আওতাতেই ক্যাবের মাধ্যমে যারা নাগরিক হয়ে উঠবেন তাদের ওপরেও বিধি-নিষেধ কার্যকর হবে। এই ছাড়ের মানে ক্যাবের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া কোনো বাংলাদেশি মিজোরামে বা অন্য কোনো আইএলপিভুক্ত রাজ্যে বসবাস করতে পারবেন না। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে ঘোষিত আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদগুলোতে (এডিসি) এরা বসবাস করতে পারবেন না। আসামে তিনটি ও ত্রিপুরায় একটি এডিসি রয়েছে। মেঘালয়ে তিনটি এডিসি রয়েছে, যার আওতায় চলে আসবে প্রায় পুরো রাজ্যই। কিন্তু এই এডিসি এলাকার বাইরের অঞ্চলে এই নব্যনাগরিকরা বসবাস করতে পারবেন। এখানেই আপত্তি জনজাতির বিভিন্ন সংগঠনের। তারা চাইছে মণিপুরের মতো বিশেষ ব্যবস্থা। মণিপুরের বিশেষ ব্যবস্থা কী? কেন্দ্র মণিপুরকে রাজ্যের স্বীকৃতি দিলেও জনজাতিদের নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এ কথা জানত, সে কারণে তারা ৩৭১ সি অনুচ্ছেদ প্রবর্তন করে। ৩৭১ সি হলো মণিপুরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতি চাইলে মণিপুরের পার্বত্য এলাকার বিধায়কদের নিয়ে কোনো কমিটি গঠন করতে পারেন। সরকারের কাজকর্মে রদবদল ঘটাতে এবং রাজ্যের বিধানসভা কার্যবিধির জন্য আইন তৈরি করতে পারেন। এটা মণিপুরবাসীর সুরক্ষাকবচ। কাজেই কোনো নব্যনাগরিক মণিপুরেও বিশেষ অনুমতি ছাড়া স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে অন্যান্য রাজ্যে বসবাসের সুযোগ না থাকলেও আসাম ও ত্রিপুরার এডিসি অর্থাৎ জনজাতির জন্য নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যে বিস্তৃত অঞ্চল আছে সেখানে বসবাস করতে পারবেন। এর ফলে অর্থনৈতিক চাপ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সম্ভাবনা ষোলআনা। নিজভ‚মে তাদের সংখ্যালঘু হওয়ার সম্ভাবনার আশঙ্কা নিতান্ত অমূলক নয়। বাংলাদেশের কোন জায়গায় এই আইন আঘাত করছে? ১৯৪৭ সালের আদমশুমারি অনুসারে দেশভাগের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৯.৭ শতাংশ। এখন তা কমে ৯.৭ শতাংশ হয়েছে (২০০১ সালের বাংলাদেশ সরকারের প্রদত্ত পরিসংখ্যান)। বর্তমানে সেই সংখ্যা ১০ শতাংশ মতো। বাংলাদেশের পূর্বেকার চিত্র পাল্টিয়ে দিয়ে বর্তমানে এই দেশ সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক। অধ্যাপক ড. আবুল বরকতের উপস্থাপনা যে প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু, আজ আর বাস্তব নয়। কিন্তু এই আইন এই সম্প্রদায়ের প্রতি সরাসরি আমন্ত্রণ, যা বাংলাদেশের বর্তমানে অর্জিত জনবিন্যাসের চেহারা পাল্টে দেয়ার সম্ভাবনা ঘোষণা করে। তার ওপরে যে কারণেই হোক ১৯৭১-এর পরে ভারতে আগত মুসলমানদের যদি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে তুলনামূলকভাবে আয়তনে ছোট দেশের অর্থনীতির ওপরে বিরাট চাপ হয়ে উঠবে সে কথা যে কোনো মানুষই বুঝবেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর বাতিল করার ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অসন্তোষ কতটা গভীরে। এই বিল পাস হওয়ার পর এই মোমেনই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতের নিজের দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। ওরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। বন্ধু দেশ হিসেবে আমরা আশা করছি ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়।’ তার কথায়, ‘বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই রয়েছে যেখানে এত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে।’ বাংলাদেশ সূত্রের বক্তব্য, বিল পাসের সময় যেভাবে বারবার পাকিস্তানের সঙ্গে একই বন্ধনীতে বাংলাদেশকে রেখে সংখ্যালঘু নিপীড়নের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে, তা সরকারের জন্য বিড়ম্বনার। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জনমানসে। বাংলাদেশের ইসলামপন্থি অংশ ভারতবিরোধী প্রচার শুরু করলে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত ও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান বাধার মুখে পড়বে। মাঝখান থেকে চীনের প্রতি নির্ভরতা বাড়বে ঢাকার। কিন্তু সে কথা ভারতের শাসক গোষ্ঠী কবে বুঝবেন?

কলকাতা থেকে অমিত গোস্বামী : কবি ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App