×

পুরনো খবর

জলবায়ু তহবিল নিয়ে দ্বিমত বিশেষজ্ঞদের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৫৩ এএম

জলবায়ু তহবিল নিয়ে দ্বিমত বিশেষজ্ঞদের

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। দুই মাস পর পর ঋতুর পরিবর্তন হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নানা কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ক্রমেই বাড়ছে জলবায়ুর উষ্ণতা। শুধু বাংলাদেশই না, উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবীর সব প্রান্তই। প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে জলবায়ুর প্রভাব আরো বাড়বে। এ জন্য মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতির কাজ হাতে নিতে হবে।

এ বছর স্পেনের মাদ্রিদে শুরু হওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৫ শেষ হচ্ছে আজ। নানা কারণে সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশকে ‘ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। অর্থাৎ, হাতে আছে আর মাত্র এক বছর। তাই যেসব দেশ এখনো এই কাজ শেষ করেনি, তাদের উপর চাপ তৈরির শেষ সুযোগ এবারের সম্মেলন। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের ২০০টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। যদিও এ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কতখানি লাভবান হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। এদিকে, মাদ্রিদে যখন কপ-২৫ শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীন এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্কে প্রকাশিত হয়েছে গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২০। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে সাত নম্বরে রাখা হয়েছে।

তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, বাংলাদেশ খুব সামান্যই কার্বন নিঃসরণ করে, অথচ এর দায়ভার বহন করে চলেছে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলো। সম্প্রতি আয়োজিত দুইদিনের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে বৈশ্বিক ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিযোজন ও প্রশমনে ব্যর্থতা, পানি সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে বলে তথ্য উঠে এসেছে। বৈঠকে জলবায়ু অভিযোজনের পাশাপাশি প্রশমন অর্থাৎ কার্বন নির্গমন হ্রাস করার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। অভিযোজনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে থাকলেও প্রশমনের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। তবে বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বিমত রয়েছে।

মিটিগেশনের বা প্রশমনের খরচ বন্ধ করে অভিযোজনে খরচ করা উচিত বলে মনে করেন পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, টাকার তিনটি উৎস আছে। বৈশি^ক পর্যায়, দ্বিপক্ষীয় পর্যায় (ডিফি, ডিএফআইডি ইত্যাদি), আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব টাকা। বৈশ্বিক ফান্ডের নাম হচ্ছে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড অথবা গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি। সেখানে তারা ৬০-৭০ ভাগ টাকা দিচ্ছে প্রশমনের বা মিটিগেশনের জন্য। বাংলাদেশ থেকে আমরা চিৎকার করছি, নেতৃত্ব দিচ্ছি অভিযোজনের টাকা বাড়াও, প্রশমনের টাকা কমাও। দুই খাতের জন্য সমান সমান বরাদ্দ করা হোক। এ ছাড়া যে ফান্ডগুলো আসছে তার বেশিরভাগই প্রশমনের জন্য করা হচ্ছে। এমনকি ট্রাস্ট ফান্ডের টাকাও বেশি খরচ হচ্ছে প্রশমন খাতে। কারণ আমরা দশমিক ৩ টন ফিনাইল গ্যাস উৎপাদন করি। অভিযোজন হচ্ছে আমাদের দেশে মূল সমস্যা। বাংলাদেশে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড যেটা আছে, আগে কোনো নীতিমালা ছিল না। এখন নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। নীতিমালা তৈরি হলেই প্রশমনের টাকা যতটা সম্ভব কমিয়ে দেয়া হবে বলে জানান আইনুন নিশাত।

তবে বিষয়টি নিয়ে বিপরীতমুখী কথা বলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, অভিযোজন ও প্রশমন একে অন্যের পরিপূরক। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা নয়। অভিযোজনের উপর আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে। তবে প্রশমনকেও উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য অভিযোজনটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আমরা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ুর প্রভাবে উপক‚লীয় অঞ্চলে জনগণের যে ক্ষতি হচ্ছে- এর প্রেক্ষিতে এডাপটেশন বা অভিযোজন গুরত্বপূর্ণ। এ বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই অনেক গুরুত্ব পাচ্ছে এবং গুরুত্ব পাওয়াটা যৌক্তিক বলেই মনে করি। পাশাপাশি প্রশমনটাও দরকার। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেগা প্রকল্প, ইটভাটা- এসব কারণে আমরা আমাদের পরিবেশ দূষণ করছি। আর এসব বিষয়গুলোর সঙ্গেই প্রশমনের বিষয় জড়িত। আন্তর্জাতিকভাবে যারা দায়ী, তাদের উপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। আমাদের নিজেদেরও প্রশমনের কাজটা করতে হবে। সেখানেও আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ সেখানে এডাপটেশন বা অভিযোজনের সঙ্গে সঙ্গে মিটিগেশন বা প্রশমনের জন্য নিজেদের টার্গেট সেট করেছে। অথচ, প্রশমনের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অগ্রগতি দেখতে পাই না। আমাদের দেশে প্রশমন খাতে নিজস্ব কোনো ফান্ড নেই।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালককের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ (এনসিসি’বি) এর রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি অফিসার মাহবুবুর রহমান অপু বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের পাশাপাশি প্রশমনের ব্যাপারেও পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কেননা বর্তমানে বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু তহবিল থেকে প্রশমন সংক্রান্ত প্রকল্পের অনুদানের ছাড় তুলনামূলকভাবে বেশি দেয়া হচ্ছে। তাই আমাদের একইসঙ্গে অভিযোজন প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবির সঙ্গে সঙ্গে প্রশমন ক্ষেত্রে প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রণয়নে আরো যত্নবান হতে হবে। যেন আমরা অর্থ প্রাপ্তির এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারি।

সম্প্রতি, জলবায়ু অভিযোজনে বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় দুদিনের গ্লোবাল কমিশন অন এডাপটেশনের বৈঠক করে স্বীকৃতি দেন বিশ্ব নেতারা। অভিযোজন কার্যক্রমে গত ১১ বছর ধরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নানা উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রম গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ জালবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমে বেশ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আইন থাকার পরও ইট ভাটা বন্ধ না করে ‘নীরব হত্যাকান্ড’ ঘটানো হচ্ছে। দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী ইটভাটা। ইটের বিকল্প তৈরির পরও এসব ভাটা বন্ধ করা হচ্ছে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে অনেক দুর্বলতা আছে। তাই অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজধানীতে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলমান থাকায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। দূষণ কমাতে চেষ্টা করছে মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিবেশ দূষণে ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকাÐ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়াও দূষণ হচ্ছে নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ থেকেও। এসব প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিলেও তারা কোনো সাড়া দেয় না। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় সভায় ডাকা হলেও বেশির ভাগ সংস্থা তাদের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে দায় সারছে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App