×

মুক্তচিন্তা

আমরা তোমাদের ভুলবো না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৪০ পিএম

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা আবেগপ্রবণ হই, আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করি। আমরা তোমাদের ভুলবো নাÑ বলে বিলাপ সঙ্গীত গাই। কিন্তু আসলে কি আমরা তাদের কথা মনে রেখেছি? বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ কি শুধু একদিনের জন্যই? আত্মদানকারী শহীদদের কাছ থেকে আমরা কি সাহসী হওয়ার প্রেরণা পাই? যারা অকুতোভয়ে মরণ শঙ্কারে চরণে দলে গেছেন তাদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে তখনই, যখন আমরা প্রিয় স্বদেশকে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমতাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারব।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতির জন্য বেদনাবিধুর একটি দিন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভ‚মিতে নিয়ে হত্যা করেছিল। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে বাঙালি নিধনযজ্ঞের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হার্মাদ বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপককে হত্যা করেছিল। দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব ছিলেন তাদের প্রথম শিকার। এই ধারা অব্যাহত ছিল ৯ মাসজুড়েই। তবে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। বাঙালি জাতি ৯ মাসের অসম সাহসী এক যুদ্ধে চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। পাকিস্তানিরা পরাজয় নিশ্চিত জেনেই বাঙালির ওপর চরম প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে নিঃস্ব করার জন্যই বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে বধ করা হয়েছিল। স্বাধীন হলেও বাঙালি যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, মেধা ও মনন চর্চায় এগিয়ে যেতে না পারে, সেটাই ছিল পাকিস্তানিদের লক্ষ্য। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের শাসন-শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির ধারাবাহিক যে রাজনৈতিক আন্দোলন তার পেছনে প্রেরণাদায়ী ভ‚মিকা ছিল বুদ্ধিজীবীদের। রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরির বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরির উপাদান-উপকরণ সংগ্রহ-সরবরাহ করতেন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদসহ সমাজের চিন্তাশীল প্রাগসর মানুষরা। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, আবদুল মতিন চৌধুরী, আনিসুর রহমানের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পেছনের প্রেরণা ও পরামর্শক। গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক-সাম্প্রদায়িক-অগণতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটনে বড় ভ‚মিকা পালন করেছেন শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, পহেলা বৈশাখ পালন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক একটি জাতি-মানস গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনের সহায়ক এবং পরিপূরক হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরালো ভ‚মিকা পালন করায় পাকিস্তানি শাসকদের রাগ-ক্ষোভ ছিল বুদ্ধিজীবীদের ওপর। তাই মুক্তিযুদ্ধের আরম্ভকাল থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানিদের টার্গেট। আমরা আমাদের শত্রু-মিত্র চিনতে অনেক সময় ভুল করি। শত্রুদের প্রতি নমনীয়তা দেখাই, দরদ দেখাই, মানবিক আচরণ করি। নানা সম্পর্কসূত্র কারো বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করা থেকে আমাদের বিরত রাখে, আমাদের দুর্বল করে। এ কারণে অনেক সময় আমরা ভুল করি এবং চরম খেসারত দিয়ে তারপর অনুশোচনা করি। কিন্তু আমাদের শত্রু পক্ষ ভুল করে না। আমাদের শত্রুরা ভুল করে না, ক্ষমাও করে না। পাকিস্তানিরা ঠিকই তাদের শত্রু চিহ্নিত করেছিল এবং তাদের নিষ্ঠুরভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় করেছিল। ওরা কারো বয়স, শিক্ষা, মর্যাদা, সম্মান, খ্যাতি, দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি কিছুই বিবেচনা করেনি। নারী-পুরুষ সব কিছু তুচ্ছ বিবেচনা করে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে এবং নির্দয় যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ক্রীড়াবিদসহ বাছাই করে সব কৃতী মানুষকে নিষ্ঠুর অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে তারা পৈশাচিক উল্লাস করেছে। তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতার শিকার হয়েছেন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মানবসেবায় ব্রতী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ। বাদ যাননি অজাতশত্রু আত্মভোলা দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। ৯ মাস ধরেই একদিকে যেমন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং বেপরোয়া ধর্ষণ চলেছে, অন্যদিকে তেমনি চলেছে বেছে বেছে কৃতবিদ্য মানুষদের হত্যা। পরাজয়ের আগ মুহূর্তে তারা দলে দলে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গেছে বধ্যভ‚মিতে। কতজন বুদ্ধিজীবীকে তারা হত্যা করেছিল তার সংখ্যাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংখ্যাটা শতাধিক কিংবা সহ্রধিক যাই হোক না কেন, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো পাকিস্তানিদের মনোভঙ্গি। তারা বাংলাদেশকে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করতে চেয়েছে, বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করতে চেয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তারা যখন পরাজয় এড়ানো অসম্ভব মনে করেছে তখন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বুদ্ধিজীবীদের পাইকারিভাবে হত্যা করেছে। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের অনেকেরই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না, কেউ কেউ অত্যন্ত নিরুপদ্রব জীবনযাপন করেছেন। কেউবা পাকিস্তানি ভাবাদর্শেও বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বাঙালি হওয়ার অপরাধেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। তারা বেঁচে থাকলে তাদের মেধা ও কর্ম দিয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করতে পারেন এই আশঙ্কা থেকেই তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমরা এটা জানি যে একটি জাতির মনন গড়ে ওঠে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বেঁধে দেয়া ছাঁচে। সব লড়াকু মানুষের লড়াইয়ের পথ ও কৌশল এক হয় না। কেউ লড়াই করেন অস্ত্র হাতে, কেউ গান করে, কেউ কবিতা লিখে, কেউ ছবি এঁকে, কেউবা খেলার মাঠে নৈপুণ্য দেখিয়ে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার যোগ ফল সফলতা তথা যুদ্ধ জয়। সবার রক্তের সিঁড়ি বেয়েই আমরা উড়াতে পারছি স্বাধীনতার রক্তলাল বিজয় পতাকা। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা ও অপমানের বিষয় এটাই যে, আমরা একাত্তরের পরাজিত শক্তির কাছে হার মানছি বারবার। আসলে সেদিন আমরা যাদের পরাজিত ভেবেছিলাম, তারা পরাজিত হয়নি। সাময়িক কৌশল বদল করেছিল। সময় ও সুযোগমতো চার পা আগানোর জন্য সেদিন তারা দুপা পিছিয়েছিল। এতেই আমরা খুশি হয়েছিলাম। আবার কখন কোন দিক থেকে বিপদ আসতে পারে সেটা আমরা তখন সেভাবে ভাবিনি, ভাবার গরজ বোধ করিনি। আমরা অধিকাংশ সময় স্বতঃস্ফ‚র্ততার ওপর ভর করি। আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনে যখন বিজয়-আনন্দে মত্ত হই, আমাদের শত্রুরা তখন ঘাপটি মেরে থাকে, অপেক্ষা করে নিজেদের সুদিনের জন্য। আমাদের বিজয় আমাদের হাতছাড়া হয়। কিন্তু আমাদের শত্রু পক্ষ আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা আবার ফণা তোলে। মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী একটি দেশ আজ আর একাত্তরের চেতনার জায়গায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির আজ বেহাল দশা। একাত্তরে জয় বাংলা ছিল আমাদের প্রেরণাদায়ী রণধ্বনি। আজ সেই স্লোগান উচ্চারণের জন্য উচ্চ আদালতকে নির্দেশ দিতে হয়! জয় বাংলা স্লোগান আওয়ামী লীগের ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় জয় বাংলা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সব বাঙালির স্লোগান। তবে এখন আবার এই স্লোগানটি আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। আর জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণের নির্দেশ দিতে হয় উচ্চ আদালতকে। এতে কি প্রমাণ হয় যে আমাদের দেশ এগিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ধর্ম রাজনীতির নিয়ামক হবে না। অথচ দেশে আজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে আপস-সমঝোতা করে ক্ষমতায় থাকতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের বলে যারা নিজদের দাবি করেন, তারা এক কাতারে দাঁড়াতে পারেন না। তাদের বিভেদ-বিভক্তি শত্রুদের পথ প্রশস্ত করে দেয়। ঐক্যসূত্র না খুঁজে বিভেদের ক্ষেত্র তৈরি করা কি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? তারা জীবন দিয়েছিলেন এমন একটি মুক্ত স্বদেশের জন্য যেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ কারো পাওয়ার কথা নয়। অথচ আজ দেশের উল্টো যাত্রা আমরা মেনে নিচ্ছি নানা কুযুক্তিতে। আমরা পুনর্বাসিত করছি আমাদের শত্রুদের। ক্রমাগত পিছু হটছি নিজেরা। অনেক বিলম্বে হলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ঘাতক-দালালদের কয়েকজনকে চরম দণ্ড দিতে সক্ষম হলেও এখনো তাদের আস্ফালন বন্ধ হয়নি। তাদের কয়েকজন দেশের বাইরে পালিয়ে আছে। দেশের মধ্যেও আছে কারো কারো অবাধ বিচরণ। ক্ষমতার রাজনীতির সংকীর্ণ নানা হিসাব-নিকাশে, সমীকরণে এখনো কেউ কেউ পাচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা আবেগপ্রবণ হই, আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করি। আমরা তোমাদের ভুলবো না- বলে বিলাপ সঙ্গীত গাই। কিন্তু আসলে কি আমরা তাদের কথা মনে রেখেছি? বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ কি শুধু একদিনের জন্যই? আত্মদানকারী শহীদদের কাছ থেকে আমরা কি সাহসী হওয়ার প্রেরণা পাই? যারা অকুতোভয়ে মরণ শঙ্কারে চরণে দলে গেছেন তাদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে তখনই, যখন আমরা প্রিয় স্বদেশকে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমতাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারব। শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App