×

সাময়িকী

যে রাতে আমার স্ত্রী

Icon

nakib

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:০৪ পিএম

যে রাতে আমার স্ত্রী

[গতসংখ্যার পর]

বিয়ে করতে চাইলেও আঠারো হতে হয়, নতুবা পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। ঋতু বলল, আর একুশ দিন পর আমি আঠার হবো। আমার মা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে, আঠার বছর বয়সে তিন বাচ্চার মা হয়েছে। আমি বললাম, বেশ আমি আর আসছি না। তোমার বাবা কেন টাকা নষ্ট করবে আর আমিইবা কেন সময় নষ্ট করব। ঋতু বলল, ঠিক বলেছেন স্যার। আমি অনানুষ্ঠানিকভাবে চলে আসি। এ মাসে চার দিন এসেছি, দু’হাজার টাকা পেলে ভালো, না পেলেও তেমন ক্ষতি নেই। এক ধরনের অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। এরপর ঋতুকে আর ক্লাসে দেখিনি। মাসের শেষ দিকে ঋতুর বাবা আমাকে তার অফিসে ডাকলেন। কলেজের কাছেই অফিস। সবার আগে গুনে গুনে পাঁচশ টাকার চারটা নোট দিয়ে বললেন, মাস্টার সাহেব আগে পাওনাটা বুঝে নিন। তারপর অন্য কথা বলি। আমি টাকা পকেটে ঢুকাই। তারপর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, আপনি ঋতুকে বলেছেন যে তার মাথায় কিছু নেই, তাকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। আমি কি বলব, সব মিথ্যে কথা, আপনার মেয়ে একটা আস্ত হারামজাদি। তার বিয়ের রোগ হয়েছে, বিয়ে করতে চায় টুইন বেবি বিয়োতে চায়। আমার উচিত ছিল থাপ্পড় মেরে বত্রিশটা দাঁত...। আমি থমকে যাই। ঋতুর কি উইজডম টিম উঠেছে? যদি না উঠে থাকে তাহলে দাঁতের সংখ্যা আরো কম। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন মেয়েদের দাঁতের সংখ্যা কম হয়। এ জন্য বার্টান্ড রাসেল তাকে বলেছেন ইন্টেলেকচুয়াল রাবিশ। অ্যারিস্টটল চাইলেই তো নিজের স্ত্রী কিংবা পরিচিত কোনো নারীকে বলতে পারতেন, হাঁ করো, গুনে দেখি তোমার দাঁত ক’টা। কিন্তু তা করেননি, আজীবন তার এই বিশ্বাসই ছিল যে মেয়েদের দাঁত কম। ঋতুর বাবা বলেন, এই কথাটা আপনি সরাসরি মেয়েটাকে বলতে গেলেন কেন? আমাকে বললেও পারতেন। ঋতু মিথ্যুক, সুতরাং সে তার বাবার ক্রোধের শিকার হোক আমি এটাও চাই না। বললাম, আমাদের মধ্যে এ ধরনের কোনো আলাপই হয়নি। তিনি বললেন, তাহলে আপনি পড়াতে যাচ্ছেন না কেন? আমি শুধু এটুকুও বললাম, আপনার মেয়ে হয়তো ভিন্ন কোনো ক্যারিয়ারের কথা ভাবছে। তিনি বললেন, ভিন্ন ক্যারিয়ার আবার কি? কষে দুইটা থাপ্পড় মারলেন না কেন? নাক টিপলে মুখে দুধ বেরোয়, তার আবার ভিন্ন ক্যারিয়ার। আশ্চর্য, আমি কতোবার প্রিন্সিপ্যালকে বলেছি টিচারদের বলবেন ক্লাসে যেন বেত নিয়ে যায়। প্রিন্সিপ্যাল আমাকে আইন শেখান, কর্পোরাল পানিশমেন্ট ইজ ইললিগাল।

যে সময়টায় ঋতুকে পড়িয়েছি দু’একদিন ফোনে বলেছে, স্যার, আধঘণ্টা পর আসতেন, আমি গোসলটা সেরে নিই। একবার বলেছে, স্যার আপনি কাল না এলে ভালো হয়। আমার খুব পেটব্যথা হবে। আমি বলি, কাল ব্যথা হবে, তুমি অ্যাডভান্স জানলে কেমন করে? ঋতু বলল, স্যার শরীরটা তো আমার। শরীরের সিগন্যালগুলো তো আমারই বোঝার কথা। আমি বললাম, পেটব্যথার ঔষধ খাও। ঋতু বলল, স্যার, আপনি একটা অগা, এটা সেই পেটব্যথা নয়। অগা মানে কি? হাবা। আমি ফোন রেখে দিই। ঋতু আবার রিং করে, স্যার রাগ করলেন? স্যার অগা মানে ভালো, খুব সরল। আমি বললাম, ঠিক আছে, পরশু আসব। আমি ইংরেজির লেকচারার নাজমুল আবেদিনের মতো জিজ্ঞেস করতে চাই না ব্যথা কোন জায়গাটা, নাভির উপরে না নিচে, উপরে হলে কতোটুকু উপরে, নিচে হলে কতোটুকু নিচে? আমি স্ক্যান্ডাল চাই না। আমি আমার সুনাম ও গাম্ভীর্য ধরে রাখতে চাই। ঋতুকে ছেড়ে আমার প্রায় তিন মাস পর তার ফোন পাই। আমি ধরব কি ধরব না এমন দ্বিধায় থেকে শেষ পর্যন্ত বলি, হ্যালো, কে বলছেন? স্যার, আপনি আমার নাম-নাম্বার সব ডিলিট করে ফেলেছেন? আমার কাছে এর জবাব নেই, আমি মিথ্যে বলেছি। মিথ্যেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বললাম, আমার সেট-এ সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময়ই নাম উঠছে না। সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যান, ফ্রি ঠিক করে দেবে। আচ্ছা। তুমি ভালো আছো তো। জ্বি স্যার, ভালো। আপনি আপনার বাবার বাসাতেই থাকেন? শুধু থাকি না, বাবার হোটেলে এখনও খাই। স্যার, আপনি কি রুমে একা থাকেন? আমার বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন থেকেই একা থাকি। বাসায় আর কে থাকেন? মা নেই, দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা আর আমি, আর আমাদের দেখাশোনা করেন বাবার কাজিনের মেয়ে রানু বুবু, অনেকটা আমার মার বয়সের কাছাকাছি। আর একটা কাজের ছেলে, নাম নওফেল। স্যার, বাসাটা সাতাশ নম্বরের মিনাবাজারের ঠিক পেছনে, তাই না? কেন, কি দরকার? তেমন দরকার নেই, আপনার বাসার নম্বর তো প্রথম দিনই লিখে নিয়েছি, এখন একটু কনফার্মড হতে যাচ্ছি। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, কেন? আপনি বাবাকে বলেছেন, আমি ভিন্ন একটা ক্যারিয়ারের কথা ভাবছি, সেই ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার একটু সাজেশন চাচ্ছিলাম। স্যার আপনি কি ওস্তাদ আল্লা রাখার তবলাবাদন শুনেছেন? আমি তিনদিন আগে সুরশ্রী ঢুকেছিলাম, একটা সিডি পেয়ে সাথে সাথে কিনলাম, এটা আপনাকে দিতে চাই। ওহ্ আচ্ছা। আমি অনেকদিন তবলাতে হাত দিচ্ছি না। তারপর ঋতু লাইনটা কেটে দেয় কিংবা এমনিই কেটে যায়।

আমার শেষ ক্লাস সাড়ে তিনটায়। এক ঘণ্টার ক্লাস। আমি পাঁচটার দিকে টিচার্স রুমে এক কাপ চা খেয়ে টেম্পোতে উঠি। একেবারে ডেল্টা হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দেয়, ভাড়া আঠার টাকা। আমি হাসপাতালের চারতলার কেবিনে বাবার সাথে দু’তিন ঘণ্টা কাটাই। বাবার ফুসফুসে ক্যান্সার। মেটাস্ট্যাসিস হয়ে গেছে, ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। বাবা ভেঙে পড়েননি, আজরায়েলকে নিয়েও জোক করেন। ডেল্টাতে যাবার কারণ আমার বোন তুরিন এবং তার হাজব্যান্ড অনকোলোজিস্ট ডাক্তার রউফ খোন্দকার। রউফের সাথে হাসপাতালটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর বাসাও কাছে, মিরপুর দারুস সালাম। ডাক্তার আমার আর তুরিনের সামনেই বলেছেন, এ ধরনের রোগীর বেলায় মিরাকল ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। আপনার তার পিসফুল ডেথ-এর জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। বাবা নিজের বাড়ি ছেড়েছেন প্রায় ছ’মাস। দু’দিন সপ্তাহ হাসপাতালে, তারপর কিছুদিন তুরিনের বাসায়, আবার হাসপাতালে। তুরিন আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট, নওরিন পাঁচ বছরের। তুরিনের একটা বাচ্চা, শার্লিন। নওরিন বিয়ে করেনি, বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে, পিএইচডি শুরু করেছে। তার সাবজেক্ট মাইক্রোবায়োলজি। বাবা হাসপাতালে থেকে তার বন্ধুদের খোঁজখবর রাখেন। তার সহকর্মী ও বন্ধু আবদুল মালেক থ্রি মারা গেছেন, শুক্রবার বাদ জোহর কুলখানি। সকালেও শেরে বাংলা নগরে সংসদ ভবনের ওয়ানওয়েতে হাঁটাহাঁটি করেছেন। মনিপুরি পাড়ায় নিজের বাসায় ফিরে এসে নাস্তা করেছেন, তারপর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন। বড় ছেলে আর বৌমার সামনেই তিনি চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়লেন। অ্যাম্বুলেন্স আমার আগে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের ডাক্তার শামসুন নাহার এসে নাড়ি টিপলেন, চোখের ভেতর টর্চলাইটের আলো ফেললেন, হাসপাতালে নেবার দরকার নেই। মালেক ভাই মারা গেছেন। এই কাহিনীটুকু বাবার জানা। বাবা বললেন, সুপ্রিম কোর্টের মতো আজরায়েলের একটা কজ লিস্ট আছে। কোন দিন কার জান কবচ করা হবে লিস্টে সেসব নাম লেখা আছে। ডেল্টাতে আমার পথে মনিপুরি পাড়ায় একজন আবদুল মালেক দেখে আজরাইল তার তালিকার নামের পাশের ক্রস দেয় এবং মালেক থ্রির জানটা নিয়ে নেয়। কমন নামের এই হচ্ছে সুবিধা। কারো নাম যদি হয় ওসমান বরগুইবা কিংবা হাসিব রাফসানজানি আজরায়েলের ভুল করার সুযোগ নেই। আমার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেগুনবাগিচা হেড অফিসে বসতেন। সেখানে চারজন আবদুল মালেক। আবদুল মালেক ওয়ান দেখতেন ইনকাম ট্যাক্স, আমার বাবা আবদুল মালেক টু কাস্টম ইন্টেলিজেন্স, আবদুল মালেক থ্রি দেখতেন ভ্যাট, আর আবদুল মালেক ফোর ছিলেন চোয়ারম্যানের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। আবদুল মালেক ওয়ান এবং আবদুল মালেক থ্রি মৃত। রাত আটটার দিকে আমি যখন ফিরে আসছি, বাবা বললেন, রানুকে কিন্তু ঠকাবি না। তোর সাথেই রানু থাকবে। জি¦ বাবা বলে আমি বেরিয়ে আসি। বয়সে অনেক বড় হলেও রানুবুকে আমি রানুই ডাকি। সাড়ে ন’টায় যখন বাসায় ঢুকি রানু বলল, তুমি একটা মানুষকে বাসায় আসতে বলে নিজে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলে। তিন ঘণ্টা ধরে এক মহিলা বসে আছে। আমি কাউকে আসতে বলেছি বা বলিনি এমন কোনো আলোচনায় না গিয়ে এগিয়ে এসে দেখি বোরকাপরা এক মহিলা সোফার হাতলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। মুখের উপর পাতলা নেকাব, ঘরে আলো কম হওয়ায় পাতলা নেকাব ভেদ করে এই নারীর অবয়বের কোনো প্রতিচ্ছাপ দেখা যাচ্ছে না। আমি আরো কয়েকটি সুইচ অন করি। আলোর হঠাৎ উদ্ভাসনে ঘুমন্ত নারীর চোখে আলোর ধাক্কা লাগতে পারে। নারী উঠে বসে এবং নেকাব সরায়। আমি থ হয়ে দু’দন্ড নিঃশ্বাসবিহীন কাটিয়ে জিজ্ঞেস করি, ঋতুমণি তুমি? ঋতু দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে জি্ব স্যার। আমি অনেকক্ষণ আগে এসেছি। সরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব ক্লান্ত তো তাই। কী ব্যাপার? আপনার রুমে নিয়ে চলুন স্যার। বলব। আমার রুমে আগেও দু’একজন নারী এসেছে, লম্বা সময় কাটিয়েছে এটা রানুবুবু জানেন, নিজেও দেখেছেন। আমি তার সামনেই বলি, চলো। ঋতু যেখানে বসেছিল সেখান থেকে ডানদিকে পেছনদিকের রুমটা আমার। ঋতুকে আগে রুমে ঢুকিয়ে আমি নিজেও ঢুকি। ঋতু বোরকা খুলে ফেলে এবং দেখি সে পুরোপুরি বিয়ের সাজে। ঋতু উঠে এসে আমার ঘরের দরজার লক বাটন টিপে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করি কী ব্যাপার। তার চোখ থেকে তখন কান্না ঝরতে শুরু করেছে। আমি আবার বলি, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? এতো সেজেছো কেন? তুমি কোত্থেকে এসেছ? ঋতু যখন চোখ মুছতে গেল, মুখে লাগানো ক্রিম পাউডার ইত্যাদি লেপ্টে গেল। বলল, আমি বিউটি পার্লার থেকে পালিয়ে এসেছি। বিউটি পার্লারের কেন এসেছিলে? পাত্রপক্ষ সাড়ে সাতটার সময় আমাকে দেখতে আসার কথা আমার নার্গিস আন্টি আমাকে নিয়ে এসেছিল। আসার সময় আমি মক্কা শরিফ থেকে আনা আম্বুর বোরকাটা আমার ব্যাগে ভরে নিই। সাজানো যখন শেষ, আমি ওয়াশরুমে যাবার কথা বলে বেরিয়ে আসি, বাথরুমে ঢুকি, কাপড়ের উপর বোরকাটা চাপিয়ে কেউ টের পাবার আগেই দ্রুত বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠে পড়ি। কিন্তু এখানে কেন? ঋতু বলল, তাহলে আমি যাবো কোথায়? আমাকে জায়গা দেবার মতো আর কেউ নেই। কিন্তু যারা তোমাকে দেখতে আসছে, দেখবে। সেখানে সমস্যা কোথায়? আমি জানতে পেরেছি তারা দেখতে এসে আমাকে পছন্দ করলে অন দ্য স্পট বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবে। ছেলে মানে পাত্রটা কে? (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App