×

সাময়িকী

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মঞ্চনাটক

Icon

nakib

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:২৮ পিএম

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মঞ্চনাটক

বাঙালির জীবনে শ্রেষ্ঠতম অর্জন আমাদের স্বাধীনতা, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিপ্লব কতটা সাধিত হয়েছিল তা নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও যুদ্ধোত্তর সময়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লব ঘটে যায়, এ কথা কেউ অস্বীকার করেন না। শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, নাট্যাঙ্গনের অগ্রগতিটাই ছিল সবার চেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পূর্বকালের নাট্যচর্চা আর পরবর্তীকালের নাট্যচর্চার ফারাক চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নবনাট্যান্দোলনের যে সুবাতাস বয়ে যায়, সেই বাতাস যে কেবল রাজধানী ঢাকার নাট্যাঙ্গনে লেগেছিল তা কিন্তু নয়, বরং নাটকের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল সারা বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন অংশে গ্রুপ-থিয়েটারের চেতনায় নাটক মঞ্চায়ন শুরু হয়। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের শেষদিকে যখন নাট্যকর্মীদের দাবির মুখে বঙ্গবন্ধু ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ বাতিল করে ‘সেন্সরশিপ’ প্রথা বিলোপ করেন, তখন সারাদেশে নাট্যচর্চা প্রবল হয়ে ওঠে। সারাদেশের মঞ্চে কেবল নতুন নাটকের মঞ্চায়ন নয়, বরং প্রচুর নাটক রচিতও হয়। সারাদেশের সেইসব নাটকের সমস্ত তথ্য আমরা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে পারিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মঞ্চায়িত হয় শেখ আকরাম আলী রচিত নাটক ‘সংগ্রাম চলবেই’ ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে এমএন আলম তোতার নির্দেশনায়। ময়মনসিংহ শত্রুমুক্ত হয় ১০ ডিসেম্বর, আর নাটকটি মঞ্চায়িত হয় ১৯৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭২ থেকে শুরু হয় দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন। যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচার হতো কল্যাণ মিত্র রচিত নাটক ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকটি। বিজয়ের অব্যবহিত পরই আমাদের হাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটক আসে, সেসব নাটকের মধ্যে আমি সহজেই উল্লেখ করতে পারি কিছু নাম, যা সংখ্যাবিচারে উল্লেখযোগ্য হলেও উৎকর্ষ বিচারে অধিকাংশই অহংকার করার মতো নয়, বরং বলা যায় ‘জোয়ারের জল’। মনে করছি, আহমেদ উল্লাহর ‘সংগ্রামী বাংলা’, এম এ মজিদের ‘জল্লাদের দরবার’, কল্যাণ মিত্রের ‘একটি জাতি একটি ইতিহাস’, ‘জল্লাদের ফাঁসি’; কালিপদ দাসের ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলার মাটি’, ‘বীর বাঙালি’, ‘সোনার বাংলা’, ‘রক্ত পতাকা’; দীলিপ সরকারের ‘বাংলার বিজয়’, ‘বাংলার বীরাঙ্গনা’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘অনেক রক্তের পর’; বাহালুল ইসলামের ‘বীর বাঙালি’; হাবিবুল্লাহর ‘রক্তের বিনিময়ে’; শহীদ আশরাফের ‘ও আমার দেশের মাটি’; শেখ নূরুল ইসলামের ‘মানুষ বাঙালি’; মোমেন খানের ‘কালরাত্রি’; মুহম্মদ আলাউদ্দিনের ‘রক্ত দিয়ে আনলাম’; এ কে এম মজিবুর রহমানের ‘মুক্ত আকাশ’; ফরিদ আহমদ দুলালের ‘অত্যাচারের চরম সীমায়’ ইত্যাদি আরো অনেক। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের খোঁজ যাঁরা জানেন, তাঁরা সবাই বলবেন, এখানে নাট্যকার হিসেবে যাঁদের নাম উচ্চারিত হলো, তাঁদের প্রায় সবাই স্বাধীনতা-উত্তর নাট্যাঙ্গনের অনুল্লেখ্য চরিত্র। কল্যাণ মিত্র নাট্যকার হিসেবে স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ, আর কালিপদ দাস চলচ্চিত্রের মানুষ, অভিনেতা এবং নির্দেশক। অন্যরা কেউ কেউ ব্যক্তিগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হলেও নাট্যাঙ্গনে নন। আগেই বলেছি স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের যে অগ্রযাত্রা, তার মূল শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশের একজন নাট্যকর্মী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে ভাবেন, এ কথা চিন্তাও করতে পারি না। শিল্পাঙ্গনের অন্য যে কোনো শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মানুষ থাকলেও নাট্যাঙ্গনে একজনও নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আজ পর্যন্ত যতো নাটক রচিত হয়েছে, অভিনীত হয়েছে, অঙ্গুলিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া তার সবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে; সে বিবেচনায় বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের প্রায় সবই মুক্তিযুদ্ধের নাটক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নাটক এবং নাট্যকারের নাম স্মরণ করে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মঞ্চনাটক’ রচনার ইতি টানতে চাই, তার আগে অবশ্যই অন্য এক তালিকা উপস্থাপন করতে চাই, যে তালিকায় সেসব নাটক এবং নাট্যকারের নাম থাকবে, যেসব নাটকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। আসুন আমরা আমাদের স্মৃতি ঘেঁটে খুঁজে নিই সেসব নাম। মমতাজউদ্দিন আহমদের সেই কণ্ঠস্বর, বর্ণচোর, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, কী চাহ শঙ্খচিল, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বকুলপুরের স্বাধীনতা; আবদুল্লাহ আল মামুনের বিবিসাব, আয়নায় বন্ধুর মুখ, এখনো ক্রীতদাস, তোমরাই; রণেশ দাশগুপ্তর ফেরি আসছে; নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই; হাসনাত আবদুল হাইয়ের ঘুম নেই; আলাউদ্দিন আল আজাদের নিঃশব্দযাত্রা, নরকে লাল গোলাপ; মামুনুর রশীদের জয়জয়ন্তী; এস এম সোলায়মানের খ্যাপাপাগলার প্যাঁচাল; মোহাম্মদ এহসানউল্লাহের কিংশুক যে মরুতে; এম এ বাকীর একাত্তরের ইউলিসিস; কাজী মাহবুবুর রহমানের সাত আসমানের সিঁড়ি, বধ্যভ‚মিতে শেষ দৃশ্য, স্বর্ণ তোরণ, চাঁদ পোকা ঘুণ পোকা; শামস উল হকের সূর্য উঠছে; শেখ আকরাম আলীর এখনো যুদ্ধ; ফরিদ আহমদ দুলালের দীর্ঘ দুঃসময়, নৃ-বোধ; সারোয়ার চৌধুরীর এখনো মীরজাফর, ফেরারী জবানবন্দী; মান্নান হীরার ফেরারী; হুমায়ূন আহমেদের ১৯৭১; হাসানুল বান্নার শেখ মুজিব; দীপক চৌধুরীর স্বাধীনতার ময়নাতদন্ত, একাত্তরের শকুন, আবার যুদ্ধ, ইনফর্মার ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের এতসব নাটকের মধ্যে স্বল্পসংখক নাটক রচনা করে যিনি মুক্তিযুদ্ধের নাটক রচনায় অন্যতম প্রধান নাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হলেন, তিনি কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক; সৈয়দ হক তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ এবং নূরলদীনের ‘সারাজীবন রচনা করে নাট্যকার হিসেবে এমন এক উচ্চতায় উঠে গেলেন, যে বাংলা নাটকের ইতিহাসে তিনি হয়ে উঠলেন অনিবার্য নাম। সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরো যেসব নাটক রচনা করেছেন, সেগুলো হলো, বাংলার মাটি, বাংলার জল, আমাদের জন্ম হলো, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, কৃষ্ণপক্ষ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক এবং নাট্যকারের নাম বলতে গিয়ে এখানে নিশ্চয়ই অসংখ্য নাটক এবং নাট্যকারের নাম অনুচ্চারিত রয়ে গেল; বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং জেলায় জেলায় যাঁরা নাটক রচনা করেছেন, কিন্তু প্রচার ও প্রকাশনার আলোবঞ্চিত হওয়ার কারণে তাঁরা সব সময়ই অনুচ্চারিত থেকে গেছেন; যাঁরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা যদি সততা এবং নিষ্ঠার সাথে বিভিন্ন জেলায় নাট্যচর্চার ইতিহাস সামনে এনে এ দেশে নাট্যচর্চার একটি সমন্বিত ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন, তাহলে হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সমস্ত নাটকের একটা তালিকা আমরা পেতে পারতাম। আমি এখানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য তিনটি নাটকের সামান্য কিছু সংলাপ উচ্চারণ করছি। আলাল : না-না মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা! বোমা মেরেছি আমি, আমি ক্ষুদিরাম বসু, পিতা ত্রৈলোক্য নাথ বসু, নিবাস বাংলাদেশ। শিক্ষক আমার খোকন ব্যানার্জি ঠিক যেন হেমচন্দ্র দাস, ফরাসি দেশ থেকে বোমা বানাবার কৌশল শিখে এসেছে, আমাদের কানে কানে বলল, ক্ষুদি, ক্ষুদিরে পবিত্র সোনামুখীর শরীরে কলংক লেপে দিতে আসছে শত্রু- সাবধান। আমিও বঙ্গ সন্তান হয়ে দিদি, জননী আমার অপরূপা দেবীর পা ছুঁয়ে কসম করলাম, জীবন যাবে তবু বাঁচাব স্বদেশ, বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন করব শত্রুর মস্তক! (একাত্তরের ক্ষুদিরাম \ মান্নান হীরা) মইরম : ঘর! আমারে তুই ঘরে যাইবার কস? কি আছে আমার ঘরে? সোয়ামী আছে? জুয়ান পোলারা আছে? কেউ নাই। আমার দুই পোলা স্বাধীনের যুদ্ধে গেছিলো। ফিরা আসে নাই। পোলারা যুদ্ধে গেছে বইলা অগো বাপেরে ধইরা নিয়া গেল বদর বাহিনী। সেও ফিরা আসে নাই। এই দ্যাশের লাইগা আমি সোয়ামী দিছি। পোলা দিছি। আমি দুষমনেরে হারা জনম দুষমনই কমু। দোস কমু না। বিল্লালরে, আমার কইলজায় আগুন জ্বলে। যহন দেহি শান্তি কমিটির মেম্বর, বদর বাহিনীর বাপ বসিরুদ্দি মোল্লা সিনা টান কইরা বাজারের মদ্যে দিয়া হাটে, দারির মইদ্যে আংগুল চালায় আর চোটপাট করে, তখন আমার দিমাগ চইরা যায়। আমি বুইজ্যা পাই না এইডা কুন দ্যাশে আছি? বসিরুদ্দি মোল্লা মাপ পায় ক্যামনে? কে অরে মাপ দেয়? তয় তুই দেইখা লইস বিল্লাল, যার যা খুশ করুকগা, আমার হিসাব আমি পাই পাই বুইজ্যা লমু। (বিবিসাব \ আবদুল্লাহ আল মামুন) গ্রামবাসী : মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান মানুষ আসতে আছে মহররমে ধুলার সমান মানুষ আসতে আছে ছিপ ডিঙি শালতি ভেলায় মানুষ আসতে আছে লাঠি ভর দিয়া ধুলা পায় মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা বিধবা বইন মানুষ আসতে আছে আচানক বড় বেচইন আম গাছে আম নাই শিলে পড়ছে সব ফুল গাছে ফুল নাই গোটা ঝরছে সব সেই ফুল সেই ফল মানুষের মেলা সন্ধ্যার আগেই য্যান ভরা সন্ধ্যাবেলা কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই একদিক ছাড়া আর কোনোদিক নাই বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া ........ ............. ............... গ্রামবাসী : বিচার, বিচার চাই, বিলম্ব কিসের? ............ ............. ............ বেলা যায়, পায়ের আওয়াজ ঐ পাওয়া যায় টের। কও বিলম্ব কিসের? মেয়ে : আপনেরা বিচার চান, কারণ সামনে আছে দিন, আরো দিন আরো শস্য, আরো কত হালখাতা, তারাবাজি, আহলাদের দিন। আপনেদের দুঃখেরও দিন আছে, আরো কত কষ্টের অদিন, বান, খরা, সাপের ছোবল, কত ব্যারাম অচিন, সুখের দুঃখের দিন। আমার কি আছে? গ্যাছে সুখ য্যান কেউ নিয়া গ্যাছ গাভীনের বাঁটে যতটুক দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া। সুখ নাই এখন সংসারে দুঃখেরও শক্তি নাই দুঃখ দেয় আবার আমারে- যেমন বিষের লতা, তারও জন্ম নাই কোনো নুনের পাহাড়ে। মেয়ে : যখন আসল সত্য ওঠে লাফ দিয়া তখন দুনিয়া আচানক মনে হয় সোনার শিকল কাটা পাখির লাহান দেখে যায় জমিন ও আসমান। দেখেন, দেখেন, তবে, একবার ডানা ঝাপটায়া এখনি উড়াল দিবে সমস্ত ফালায়া। (মেয়ে হঠাৎ বিষপান করে এবং মাটিতে পড়ে যায়। গ্রামবাসী রমণীরা তাকে কোলে নেয়) গ্রামবাসী : আহা! ইস, ইস ধুতুরার বিষ। মাতবর : মা, মা, মা আমার শোন, কথা শোন, এভাবে নিজের হাতে দিলি তাই নিজের জীবন? যাইস না, যাইস না, অরে মানিক আমার যমুনার পার হয়া তবে আমি বাঁচাবো আবার যমুনার হাত থিকা, একদন্ড দাঁড়া। (গ্রামবাসী রমণীরা বিলাপ করতে থাকে) (পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় \ সৈয়দ শামসুল হক) মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যদি বলি, তাহলে কি আমরা নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটককে বাদ দিতে পারি? মমতাজ উদদীন আহমদ রচিত ফলাফল নিম্নচাপ, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, সাত ঘাটের কানাকড়ি; আবদুল্লাহ আল মামুনের সুবচন নির্বাসনে, এখন দুঃসময়, সেনাপতি; সেলিম আলদীন রচিত কীত্তনখোলা, সংবাদ কার্টুন, মুনতাসীর ফ্যান্টাসী ইত্যাদি নাটককে বাদ দিতে পারি? এমনি সহস্র নাটকের নাম মাথায় ভিড় করছে। প্রাগ্রসর নাট্যকর্মীদের প্রতি সম্মান জানাতে নিচে আমি উল্লেখযোগ্য কিছু নাটকের নাম উচ্চারণ করছি; যেসব নাটক স্বাধীনতা-উত্তর অর্ধশতাব্দী কালের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আব্দুল্লাহ আল মামুন : উজান পবন, চারিদিকে যুদ্ধ (প্রফুল্ল রায়ের কাহিনী অবলম্বনে), এবার ধরা দাও, জীবন বারে বারে, অরক্ষিত মতিঝিল, এপিঠ-ওপিঠ, শাহজাদীর কালো নেকাব। মামুনুর রশীদ : গন্ধর্ব নগরী, ওরা আছে বলেই, ওরা কদম আলী, ইবলিশ, শেষ যুদ্ধের শুরু, গিনিপিগ। সেলিম আল দীন : জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, চরকাকড়ার ডকুমেন্টরি, শকুন্তলা, আততায়ী, এক্সক্লুসিভ ও মূল সমস্যা, আতর আলীদের নীলাভ পাট, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই। সিরাজ হায়দার : আলো একটু আলো, পাগলা কুকুর, আদম বেপারী, শয়তানের ব্লাডপ্রেসার, বেয়াদপী মাফ করবেন। মুহম্মদ আবদুশ শাকুর : বক্তৃতার পরবর্তী ঘটনা, দি পেট্রিয়ট, পাগলী ইসাবেলা ও কাক। সাঈদ তারেক : কংক্রিট, সিনথিসিস, আক্কেল আলীর স্বাধীনতা, হায়বৎ জং বাহাদুর, সিন্দাবাদের ভূত। সৈয়দ শামসুল হক : ঈর্ষা। মমতাজ উদদীন আহমদ : হরিণ চিতা চিল, রাজা অনুস্বরের পালা, চয়ন তোমার ভালোবাসা, বিবাহ। শেখ আকরাম আলী : সংগ্রাম চলবেই, লাশ ’৭৪, বিক্ষুব্ধ অতীত এবং নজরুল, সখের সিঁড়ি, হে ঈশ্বর ঘুম দাও, মাদারীর খেল। আলাউদ্দিন আল আজাদ : জোয়ার থেকে বলছি, সংবাদ শেষাংশ, হিজল কাঠের নৌকা, ধন্যবাদ। এস এম সোলায়মান : কাক্সিক্ষত সূর্যের প্রার্থনায়, শিকল পরিয়ে দাও, তিন রুস্তমের গল্প, ইংগিত, এলেকশান ক্যারিকেচার। হাসনাত আবদুল হাই : সামনে যাই থাক ট্রেন চলবে, সিসিফাসে একদিন। রবিউল আলম : সমাপ্তি অন্যরকম, আকাক্সিক্ষত একজন, জননীর মৃত্যু চাই, এক যে ছিল দুই হুজুর, কখনো সৈকতে। হাবিব আহসান : তরুণ এবং বহমান ক্ষত, সাক্ষাৎকার, ক্রান্তিকালীন গল্প। আনোয়ার তালুকদার : উৎস থেকে সমুদ্দুর, ডেডলাইন ঢাকা। আল মনসুর : রেভুলিউশন ও খ্রিস্টাব্দ সন্ধান, হে জনতা আরেকবার, বিদায় মোনালিসা। নাজমা জেসমিন চৌধুরী : আলোটা জ্বালো, যেমন খুশি সাজো, অন্যরকম অভিযান, এপার ওপার। সৈয়দ মাহিদুল ইসলাম : সত্য অবাস্তব, আয়নার সামনে চড়ুইপাখি, ঈশ্বর এবং আমি, মহারানী আসছেন, এখন কি করি, কৃষ্ণচূড়া এখনো লাল। কাজী জাকির হাসান : প্রেক্ষিত শাহজাহান ও একাল, দিকচিহ্নহীন, জনৈকের মহাপ্রয়াণ, শরবিদ্ধ যন্ত্রণা, রণক্ষেত্র, রাজায় রাজায়। আবদুল মতিন খান : মাননীয় মন্ত্রীর একান্ত সচিব, শতাব্দীর পালা, ঊষার দুয়ারে, লালু, পিস্তল, সম্মেলন। আব্দুল্লাহেল মাহমুদ : সাত পুরুষের ঋণ, নানকার পালা। ফরিদ আহমদ দুলাল : ফুলজান সমাচার, মানিক বাউলের পালা, এবং লাঠিয়াল, সামনে দেখা হবে, মশা-৮৪, সুবিধাবাদী, দরিয়ায় শেষ রাত্রি, তিমির বিনাশী, মানুষ, কোঁচ, লড়াই, জরিনাবিবির পালা, খাঁচা, রজব আলীর নৈশ অভিযান, উন্মোচন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বেশকিছু অনূদিত নাটকও আমরা মঞ্চে অভিনীত হতে দেখেছি, উল্লেখযোগ্য কয়েকটির কথা নিচে উপস্থাপন করা হলো- আলী যাকের অনুবাদ করেছেন বের্টল্ড ব্রেখট-এর সৎ মানুষের খোঁজে, কার্ল সুখ্য মায়ারের কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, মলিয়েরের বিদগ্ধ রমণীকুল, এ্যালবীর নিষিদ্ধ পল্লীতে; মমতাজ উদ্দিন আহমদ অনুবাদ করেছেন আন্তন শেখভের যামিনীর শেষ সংলাপ, এই রোদ এই বৃষ্টি, হাইন রিবডন ক্লাইস্টের ক্ষতবিক্ষত; আসাদুজ্জামান নূর অনুবাদ করেছেন বের্টল্ট ব্রেখটের দেওয়ান গাজীর কিসসা, মোহনগরী; আতাউর রহমান ও আসাদুজ্জামান নূর যৌথভাবে মোলনারের ভেঁপুতে বেহাগ; সৈয়দ শামসুল হক অনুবাদ করেন উইলিয়াম শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার (গণনায়ক), ম্যাকবেথ; এস এম সোলায়মান অনুবাদ করেন নিকোলাই গোগলের ইন্সপেক্টর জেনারেল; তারিক আনাম খান অনুবাদ করেন মলিয়েরের ‘কঞ্জুস’ ইত্যাদি। সংস্কৃতির সংগ্রামে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম ফসল নাটক আজ কিছুটা বিপন্ন, আমরা যদি দেশের জেলায় জেলায় নাট্যচর্চার বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজ নিতে চাই, সেখানে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাবো, গোপন কান্নার শব্দ শুনতে পাবো। নাট্যকর্মীদের সেই গোপন কান্না থেকে মুক্তি দিতে; কেবল নাট্যকর্মীদের মুক্তি দিতে নয় বরং মানুষের অগ্রযাত্রার স্বার্থে জাগাতে হবে সংস্কৃতিকর্মীদের- সাধারণ মানুষকেও; যেমন মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে নূরলদীন ডাক দিয়ে যায়- নূরলদীন : আব্বাস, ছুটিয়া আয়, তুই মোর ভাই। একবার- একবার-জানুতে হামার এই ঠাঁই- হাত দিয়া দ্যাখ, অগ্নি মোর ধরিয়া না রাখা যায়, অন্তর ছাড়িয়া মোর অংগেতে জড়ায়। সর্বাঙ্গে নামিয়া সূর্য অগ্নি ঢালি যায়, ঝটাত শকুন পড়ি মাংশ খুলি খায়, কোন কালে, কত না অতীত কালে, সেই একদিন, একদিন, একদিন, দেখিল নূরলদীন, পড়ি আছে, বাপ তার নোয়ায়, মুখ দিয়া রক্ত উঠি বলদ পড়িয়া আছে মানুষ নোয়ায়। উঠিল চিৎকার করি, একবার নূরল তখন, তখন নূরলদীন, শুনিল তখন, তখন সে শুনিবার পায় নিজেরও গলার স্বর বদলিয়া গেছে তার গরুর হাম্বায়। .......... ......... ......... ঘামার জানুতে দ্যাখ বলবান পেশি আসি যায়, হামার শরীলে দ্যাখ শক্তির তরঙ্গ লাফায়, যায়, এই ছুটি যায়, ডাক ভাংগি যায়, পশু নয়, মানুষের কণ্ঠের ভাষায়- ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়।’ (নূরলদীনের সারাজীবন \ সৈয়দ শামসুল হক)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App