×

পুরনো খবর

ড. অজয় রায়: একজন মানবতাবাদীর প্রতিকৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:৪৬ পিএম

ড. অজয় রায়: একজন মানবতাবাদীর প্রতিকৃতি

প্রফেসর ড. অজয় রায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একাধারে তিনি শিক্ষক, লেখক, নৃতাত্ত্বিক ও মানবতাবাদী নেতা। প্রগতিশীল চেতনায় নিষ্ণাত ড. অজয় রায় আজীবন প্রগতিশীল কর্মে ও আন্দোলনে ব্যাপৃত ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। প্রসারিত ছিল তার কর্মক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্বাধীনতার পর এশিয়াটিক সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সম্পৃতি মঞ্চের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং এশিয়াটিক সোসাইটির বিজ্ঞান বিভাগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি এবং দক্ষিণ-এশীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগঠনের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য। তিনি বাংলা একাডেমির তিন খন্ডে প্রকাশিতব্য ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থের সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি প্রাথমিকভাবে কুমিল্লার সোনামোড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং নেন এবং বেশকিছু অপারেশনে অংশ নেন। তারপর আগরতলা হয়ে কলকাতা যান। তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একটি পর্যায়ে ভারতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমি যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে আমার নিরাপত্তার জন্য একটি শনাক্তপত্র দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মে ছাত্রজীবনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। তিনি তার সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ (ডাকসু) কর্তৃক আয়োজিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় কবিতা আবৃত্তিতে দুবার প্রথম স্থান অধিকার করেন। আমি যখন জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি তখন তিনি জগন্নাথ হল ছাত্র-সংসদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে প্রভ‚ত সহযোগিতা করেন। আমি যখন ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক তখনো তার কাছ থেকে উপদেশ ও সহযোগিতা পেয়েছি। একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার সক্রিয় ভ‚মিকা ছিল। পিতার এই চেতনা পুত্র অভিজিত রায়ের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল।

অধ্যাপক অজয় রায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করেছেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরই বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নিয়ে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ইন্টারনেটে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্দশার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ শিরোনামে ধারাবাহিক রচনা শুরু করেন। সেসময়ে ভোলার অন্নদা প্রসাদ গ্রামে বিভিন্ন নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং হামলায় যারা গৃহ হারিয়েছিলেন তাদের গৃহ পুনর্নির্মাণে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন। তিনি ও অধ্যাপক জিল্লুর রহমান মিলে গণতদন্ত কমিশন তৈরি করেন। এই কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে। তিনি দেশের পাহাড়ি জনগণ তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকারের বিষয়টিকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন। তিনি মনে করতেন পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা একটি পবিত্র দায়িত্ব।

মানুষ যদি বিজ্ঞানমনস্ক না হয় এবং মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন না হয় তাহলে জাতীয় অগ্রগতি ব্যাহত হয়। এই বিশ্বাসে তিনি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সভা ও সেমিনারের আয়োজনও করেছেন। তিনি মুক্তমনা নামক একটি মুক্তবুদ্ধি প্রসারমূলক সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে সংগঠনটির জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করেছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তান্বেষা নামক একটি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। যে পত্রিকাটির লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং কল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা। বরিশালে আরজ আলী মাতব্বর নামে একজন স্বশিক্ষিত দার্শনিক ছিলেন। তাকে পশ্চিমাবিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও বলিষ্ঠ ভ‚মিকা তিনি পালন করেছেন। আরজ আলী মাতব্বরকে নিয়ে তিনি বহু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ বিভিন্ন সেমিনারে পাঠ করেছেন। মুক্তচিন্তকদের লেখা নিয়ে ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ নামে একটি গ্রন্থ তার পরিচালনায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক অঙ্কুর প্রকাশনী এবং প্রকাশকাল ২০০৮। তার রচনাবলির মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান ও দর্শন, জড়ের সন্ধানে (১৯৯৩-৯৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আদি বাঙালি : নৃতাত্তি¡ক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭) [ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রাপ্ত; স্বতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা), চারদিক, ২০০৮; লীলা নাগ : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি (সম্পাদনা), সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩; পদার্থবিদ্যা (সহ-অনুবাদক, মূল : রেসনিক, ঞ্যালিডে) (অনুবাদ এবং সম্পাদনা; বাংলা একাডেমি বিজ্ঞানকোষ (প্রথম থেকে পঞ্চম খন্ড) সম্পাদনা; মুক্তান্বেষা ষান্মাসিক ম্যাগাজিন (সম্পাদনা), মুক্তমনা ও শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ইত্যাদি।

২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর মহাকাল তাকে নিয়ে গেল না ফেরার দেশে। তার মহাপ্রয়াণে আমি পিতৃহারার বেদনা অনুভব করছি। আমি হারিয়েছি আমার একজন অভিভাবক, উপদেষ্টা ও শুভাকাক্সক্ষীকে। বাংলাদেশ হারালো একজন সেবককে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। তার পবিত্র স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা। তার সুমহান আদর্শ যদি আমরা অনুসরণ করি তাহলে তার মধ্যেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন। কেননা মানবতাবাদ প্রগতি চেতনার মৃত্যু নেই।

নিরঞ্জন অধিকারী : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App