×

সারাদেশ

৭২ বছর ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে ইমাম-পুরহিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:১৮ পিএম

৭২ বছর ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে ইমাম-পুরহিত

মন্দিরের চূড়া আর মজসিদের মিনার একই সাথে সহ অবস্থানে আছে দীর্ঘদিন। এ যেন এক অমলিন বন্ধুত্ব। মসজিদের আযানের ধ্বনি এসে লাগে চূড়ায় আর মন্দিরের কাশি- ঘন্টার বাদ্য পৌছায় মিনারে। এ যেন আপন দুই ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের প্রতিদিনের ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার শিক্ষা পেয়েছেন এই এলাকার হিন্দু-মুসলমান সকলে। এই বিরল দৃষ্টান্তের স্থাপনা দুটি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ভৈরবগঞ্জ বাজারের ভৈরব মন্দির আর মাজদিহি জামে মসজিদ। যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির এক উজ্জ্বল নির্দশন। প্রায় শত বছর ধরে দুই ধর্মের এই দুই উপাসনালয় পাশাপাশি অবস্থান করে দুই ধর্মের মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে শান্তির বারতা। যা হিন্দু মুসলমানদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে ভাতৃত্ব বন্ধনের।

ভৈরব মন্দিরের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি গৌরা দেব জানান, প্রায় দুইশত বছর পূর্বে তৎকালীন মিরাশদার পূন্য দত্ত এখানে ভৈরবতলি স্থাপন করেন। প্রথমে বড় মন্দির ছিলো না। এক সময় ছোট পরিসরে মন্দির করে মহাদেবাংশ ভৈরব দেবতার মূর্তি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে কয়েক বছর আগে এলাকার এক সমাজসেবী দিলীপ দেব এই মন্দিরটি পুননির্মান করে দেন। তিনি জানান, এই ভৈরব মন্দিরের নামেই ভৈরবগঞ্জ বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবতীতে এই ভৈরব মন্দিরের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয় মাজদিহি জামে মসজিদ ও ঈদগাহ্। প্রায় ৭২ বছর ধরে দুই প্রতিষ্ঠান একসাথে প্রায় ২০ গজের ব্যবধানে সহ আবস্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছে। প্রথমে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন দেয়াল বা স্থাপনা ছিলনা। বর্তমানে উভয় প্রতিষ্টানে সীমানা প্রাচীর ও মধ্য একটি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে দুই ধর্মের মানুষ কাছাকাছি অবস্থানে তাদের ধর্মকর্ম পালন করে গেলেও অদ্যাবদি এখানে কোন ধরণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটেনি।

কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মজুল জানান, এই ভৈরব মন্দিরটি ঠিক কবে স্থাপিত হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে প্রায় দুইশত বছর পূর্বে পূণ্যদত্তের পরিবার এটি স্থাপন করেছিলেন। এই ভৈরব মন্দিরের নামানুসারে ভৈরব বাজারের নামকরণ করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ভারত ভাগ হওয়ার সময় ১৯৪৭ সালের দিকে মাজদিহি চা বাগানের কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীর অর্থায়নে মসজিদটি স্থাপতি হয়। আর এটি স্থাপিত হওয়ার পর থেকে পাশাপাশি অবস্থানে দুই ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্মকর্ম পালন করে যাচ্ছেন।

মাজদিহি জামে মসিজিদের ইমাম ও খতিব মৌলানা জাফর আহমদ জানান, প্রায় শত বছরের ইতিহাস দুই ধর্মের মধ্যে কোন ত্যাক্ততার ঘটনা নেই। তিনি ১৫ বছর ধরে এখানে খতিবের দ্বায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়ে কোনদিনও তাদের মধ্যে মনক্ষুন্নতা সৃষ্টি হওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। তিনি জানান, নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর প্রায়ই ভৈরব মন্দিরের পুরহিত জন্মজয় ভট্টাচার্য্যরে সাথে দেখা হয় তখন তারা সেখানে কুশল বিনিময় করেন।

আর মাজদিহি জামে মসিজিদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন জানান, তার বাপদাদার আমল থেকে তিনি দেখে আসছেন মসজিদের পাশেই মন্দিরে পূর্জাচনা হচ্ছে। তিনি বিগত ৪০ বছর ধরে এই মসজিদে নামাজ পড়ছেন। এই সময়ে মন্দিরের পূজাচনা তাদের নামাজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকরেনি বরং নামাজের সময় হিন্দুধর্মালম্বীরা তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ন্ত্রনে রেখে তাদের সহায়তা করে আসছেন।

মন্দির ও মসিজিদের সবচেয়ে নিকটকতম প্রতিবেশী কবি শেখ শাহ্ জামাল আহমদ জানান, এখানে কোন দিন কোন সমস্যা হয়নি। প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত ভৈরব মন্দিরে পূর্জাচনা হয়, কীর্তন হয়। কিন্তু এতে তাদের কোন সমস্যা হয়না বরং দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই প্রতিদিন এলাকার মুসল্লি ও হিন্দু ধর্মালম্বীরা আসেন এটি তাদের কাছে ভালো লাগে।

আর মন্দিরের পুরহিত জন্মজয় ভট্টাচার্য্য জানান, বাঁধা বিপত্তিতো দূরের কথা বরং পূর্জাচনায় মুসল্লিভাইয়েরা তাদের সহায়তাও করেন। নির্দিধায় তিনি বিগত ২৫/৩০ বছর ধরে এখানে পূজা পার্বন করে আসছেন। এখানে উভয় ধর্মের মধ্যে এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি বিরাজমান রয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুসলমান ধর্মালম্বীদের নিমন্ত্রন দিলে তারাও আসেন অনুষ্ঠানে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় এমন অনেক স্থাপনা রয়েছে যা এই এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির পরিচয় বহন করে । এ উপজেলায় মানুষে মানুষে কোন ধর্মীয় দ্বিধাদন্দ নেই। নেই কোন বিভেদ। তবে কখনও এরকম কোন ঘটনার অবতারণা হয়ে থাকলে এর কারণ ভিন্ন সাম্প্রদায়িক নয়।

এ ব্যাপারে কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান অরো জানান, এ দুটি প্রতিষ্ঠান তার ইউনিয়ন অফিসের পাশেই। ছোট বেলা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠান দুটির এক সাথে অবস্থান দেখে আসছেন। শান্তিপূর্ণ ভাবেই দুই ধর্মের মানুষ এখানে যারযার ধর্মকর্ম পালন করে আসছেন। আর পূজা পার্বন ধর্মীয় উৎসব আমাদের বাঙ্গালীর সংস্কৃতি। এখানে পাশাপাশি মন্দির মসজিদ থাকায় দুই ধর্মের মানুষই একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে পারছেন। যা সমাজে বিভেদহীন চলাফেরার সহায়ক।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ পিএইচডি জানান, তাঁর নির্বাচনী এলাকা শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি বিরাজমান। তাই এরকম বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ নিয়ে কখণও কোন বিবেধ সৃষ্ঠি হয়নি। তিনি জানান, তাঁর নির্বাচনী এলাকা কমলগঞ্জের পাত্রখলা চা বাগানে একই সাথে গোরস্থান, শশান ও সমাধি আরো একটি উজ্জ¦ল দৃষ্ঠান্ত। এ সময় তিনি আরো বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে আমন্ত্রন পেলে তিনি তাদের আমন্ত্রন বা দাওয়াত রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্ঠা করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি আছে বলেই তা সম্ভব। এই দুই প্রতিষ্ঠানেও তিনি একাধিকবার গিয়েছেন বলেও জানান।

আর স্থানীয় চাতালী চা বাগান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয় নুনিয়া জানান, এই দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা মৌলভীবাজার মহাসড়কের পাশে থাকায় প্রতিদিন বহু যানবাহনের যাতায়াতকারী পথচারীও এর থেকে সম্প্রতির শিক্ষা গ্রহন করছেন। শ্রীমঙ্গল ভৈরব বাজারের এই মন্দির ও মসজিদ বিশ্বের সাম্প্রদায়িক শক্তির জড়তা দূর করবে। এর চূড়া ও মিনারের মতো সহ অবস্থান করে বিশ্ব ব্যাপী ধর্মীয় বিভেদ দূরকরে মানুষে মানুষে জাগ্রত হবে ভাতৃত্ব বন্ধন এমনটাই চাওয়া এই এলাকার মানুষের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App