×

সাময়িকী

পুতুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ০১:০৬ পিএম

পুতুল
পুতুল
মন চাচ্ছে সব কথা তাকে বলে দিই কিন্তু গলার কাছে এসে কথা আটকে যাচ্ছে। আমি বোকার হদ্দ হয়ে বসে থাকছি। সুবহাও এত কাজে মশগুল যে পলক ফেলতেই দেখছি যে কখনো সে এঘরে কখনো সে ওঘরে কাজে ডুবে আছে। এভাবেই আমার মনের কথা মনেই রয়ে গেল। মনের কথা জাহির করার দুঃখ আগামী দিনের ওপর ছেড়ে দিলাম। শেষমেশ আর কতদিন এভাবে চুপ থাকব। মনের কথা না বলে থাকার অবস্থাও ছিল না। মাসের শেষ সপ্তাহ। হাত একদম খালি আবার সামাজিকতা রক্ষা না করলেও নয়। কিছু তো করতেই হয়। সুবহাই একমাত্র আশার আলো। আমার একমাত্র ভরসা। অভাবে পড়লে বেচারি কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগেই। আখেরতক আমাকে তো কথাটা তাকেই বলতে হবে। শুধু মনে সাহস পাচ্ছিলাম না যে কী করে মনের কথা ঠোঁটে তুলব। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল, আমি কেন নিজের সমস্ত কথা তার কাছে খুলে বলছি না? জানি না তাকে কী কী বলব আর সেই না কী ভেবে বসে? মাসের শেষ সপ্তাহে বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটা পাপ। যখন পকেটে টাকা নেই, উপহার কেনার কথা কেমনে ভাবি? মাসের প্রথম সপ্তাহে শুধু পকেটই ভারী থাকে না, মনটাও ভরা থাকে। এ সময় বড় ঠাট করে দামি উপহারও কেনা যায়, কিন্তু এখানে তো পছন্দসই উপহার কেনার প্রশ্ন বাদ দিলেও কিছু তো উপহারের জন্য কিনতে হবে। বন্ধুর নতুন বউকে খালি হাত নিয়ে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না। একটা রাস্তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। সুবহা বিয়েতে অনেক উপহার সামগ্রী পেয়েছিল। এই উপহার সামগ্রীই সমস্ত মসিবতে কাজে আসে। এইবারও দেখছি যে এটা কাজে লাগাতে হবে। প্রথম দিন তো সংকোচে কিছুই বলতে পারিনি কারণ আমি তার বিয়েতে পাওয়া উপহার একের পর এক শেষ করে ফেলছি। বলতে গেলে কি একটু খারাপও লাগছিল, কিন্তু আমার হাতে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মন বলছে যে সুবহার সঙ্গে এই নিয়ে পরামর্শ করতে হবে। পরেরদিন আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়েছিলাম চোখ বন্ধ করে। সুবহার বিয়েতে পাওয়া উপহারের সূচি দেখছিলাম। অনেককিছুই সে উপহার পেয়েছিল। আংটি, ঘরের আসবাবপত্র, মেকাপ বক্স, গলার চেইন, গ্লাসসেট, প্লেটসেট। সবকিছু আমি এক এক করে বেচে দিয়েছি। এক সপ্তাহ আগের কথা, বিয়েতে পাওয়া শেষ দুটো বই ফারাহকে বিয়ের উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। এখন তো আর কিছুই বাকি নেই। কিন্তু? হ্যাঁ, একটা জিনিস বাকি আছে। পুতুল। আমার এক বন্ধু বেশ বড়সড় একটা পুতুল উপহার দিয়েছিল। সে সুবহার কোলে পুতুল দিয়ে অনেক মজার কথাও বলেছিল। এই পুতুল দিতেও আমার মন সায় দিচ্ছিল না। পরে ভাবলাম, যখন হাতে টাকা নেই, আমার পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্ন কেন আসছে? সুবহার কোলে আমার যেমন পুতুল রেখে মজা করে কথা বলেছিল, আমিও এরকম করব। পায়ের শব্দ শুনে আমি চোখ খুললাম। সুবহা ঘরে এসেছিল, সে ছোট বড় কাজ করে বিছানায় এসে আমার পাশে বসে পড়ল। সে হাসি দিয়ে কথা শুরু করল। বলল, আজ যে এতক্ষণ পর্যন্ত জেগেই আছ? তুমি তো বিছানায় গেলেই ঘুমে টলে পড়। মনের ভেতর কথাটা ঘুরঘুর করছিল, গলা সাফ করে বললাম, তোমাকে ছাড়া স্বপ্নও অসুন্দর, তোমাকে ছাড়া ঘুম কেমনে আসবে? কী ব্যাপার বলো তো? কী বলতে চাচ্ছ? তোমার কী উদ্দেশ্য বলো, কবি হওয়ার দরকার নেই। তার কথা শুনে মনে সাহস পেলাম। তাকে কাছে টেনে নিয়ে এসে বললাম, কিছু বলব দেখেই তো জেগে আছি! বলো। সে আমার চুলে আঙুল বোলাতে লাগল। আমি উত্তর দেয়া সমীচীন মনে করলাম না। বললাম, আচ্ছা আমার এক বন্ধুর কথা তোমার মনে আছে? আমাদের বিয়েতে এসেছিল, মোটা দেখতে, লালচে গায়ের রং, খুব মজা করে কথা বলত। কাল তার বিয়ে। বিয়ে? ঘটনা সত্য? কিন্তু কোথায়? এই শহরেই? আমি ভেবেছিলাম, এর পরেই আমার উদ্দেশ্যটা বলব, কিন্তু তার শোনার পর কেমন লাগবে বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, মাসের শেষ সপ্তাহ, হাতে এক কড়ি নেই। এখন আমি কী করব? তুমি পরামর্শ দাও। কিছু তো দিতেই হবে। খালি হাতে তো আর যাওয়া যাবে না! আমার কথা শুনে সে অস্থির হয়ে গেল, আমি কী করব? আমার কাছে তো টাকা নেই যে তোমাকে দেব। বিয়ের সময়ে যে উপহার পেয়েছিলাম তা তো তুমি শেষ করেই দিয়েছ, এখন আর কী আছে যে তোমাকে দেব? এখন আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? এখনো অনেককিছু তুমি করতে পার? সুবহা, এখনো তোমার কাছে অনেককিছু আছে। আখতার যে পুতুলটা তোমাকে দিয়েছিল, সেটা তো এখনো তোমার কাছে আছেই। এই পুতুল তো উপহার হিসেবে বিয়েতে দেয়া যেতে পারে। এখন তো বাজারে ওর দাম আগের চেয়ে চার গুণ বেশি হয়েছে। এভাবেই আমি তাকে নরম করার চেষ্টা করছিলাম, যেভাবে সাত বছর ধরে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তাকে তুলতাম আর তার উপহার নিয়ে নিতাম। এতদিন পর্যন্ত সে চুপচাপ এক এক করে সমস্ত উপহার দিয়ে দিয়েছে, কোনো টুঁ শব্দ করেনি কিন্তু আজকে তাকে অন্যরকম ঠেকছে। সে বিছানা থেকে নেমে আমার সামনে দাঁড়ালো, তার চোখে পানি ভরে গেছে এবং আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে লাগল। বলল, আমি তোমাকে এক এক করে সমস্ত উপহার দিয়েছি, তবু তোমার শান্তি হয়নি? সামান্য একটা পুতুল আছে, সেটার ওপরও তোমার চোখ গেল? আমি তার কষ্ট মাথায় না নিয়ে নিজের মতলব কষতে লাগলাম। বললাম, তুমি পুতুলটাকে অত মামুলি ভাবছ কেন? বেশ বড় তো! দেখতেও খুব সুন্দর। বাজারে মূল্যও অনেক বেশি। উপহার হিসেবে এটা ভালোভাবেই চালিয়ে দেয়া যায়। সুবহার চোখ ঠিকরে রাগ ঝরে পড়ছে, ওর মনের ভেতর যে ঝড় হয়ে যাচ্ছে তা আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম। বলল, উপহারের কাজ চলুক আর না চলুক আমি পুতুল দেব না। এই বলে রেগেমেগে লাল হয়ে শব্দ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি এর আগে অনেক দামি জিনিস তার কাছে চেয়েছি, সে খুব সহজেই আমার হাতে তুলে দিয়েছে, কিন্তু আজ সামান্য একটা পুতুলের জন্য এরকম কেন করল বুঝতে পারলাম না। এমন কোনো কথাও বলিনি যে সে নারাজ হবে। তাহলে সমস্যা কোথায় হলো? আমি অপেক্ষা করছিলাম যে সুবহা নিজেই ঘরে চলে আসবে। এই আশায় আমি জেগে ছিলাম কিন্তু কখন যে আমার চোখ লেগে গেছিল আমি বুঝতে পারিনি। বাতাসের একটা ঝাপটা এসে আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। বুঝতে পেরে দেখি বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতাসের দাপাদাপি, শন শন শব্দ হচ্ছে বাতাস ছুটে আসার। ঘরের জানালার কপাট লাগিয়ে দিল। পাশে তাকিয়ে দেখতেই আমার আত্মা যেন উড়ে গেল। দেখি সুবহা নেই, আমি অস্থির হয়ে গেলাম। আচ্ছা সুবহা কোথায় গেল? তাহলে সে এখন অবধি ঘুমানোর জন্য ঘরে আসেনি? না আসলে তাহলে সে কোথায় গেল? অন্ধকারে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এ সময়ে আবার হাসিও আসল। হয়তো সে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেননা সে রেগে গেলে এই ঘরে না শুয়ে পাশের ঘরে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘরে নিয়ে আসতে হয়। আমি আলো না জ্বালিয়েই পাশের ঘরে গেলাম। দেখি, চেয়ার টেবিল খালি খালি পড়ে আছে। সুবহা নেই। ইতিউতি নজর দিলাম, এ ঘরের সাথে একটা ছোট কামরা আছে, দেখি, সেখান থেকে নিভু নিভু আলো জ্বলছে। এ ঘরে আমি কখনো আসিনি। আমার আসার হাজতও পড়েনি। এই ঘরে বিবিরই রাজত্ব চলত, আমার মতো সাদাসিধা স্বামীর কোনো কাজ ছিল না এখানে। আস্তে আমি ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করতেই সুবহার একটা নতুন রূপ আমার কাছে ধরা পড়ল। দেখি যে সে পুতুলকে আদর করছে খুব যত্নে। তার বানানো সাজসজ্জা দিয়ে তার মন ভরছিল না। এজন্য সে নিজের মতো করে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিচ্ছিল। জুতোর ফিতে খুলে দিয়ে নতুন করে বেঁধে দিল। তারপর সে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুমু খেতে লাগল। এই পুতুল তার অসম্পূর্ণ জীবনে সুখ আর শান্তির তোহফা দিচ্ছিল। সাত বছরের সংসারে তার কোল ভরে ওঠেনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App