ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:০৪ পিএম
ছড়া, লোকসাহিত্য তথা বাংলাসাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। ছড়ার উদ্ভব কখন কীভাবে হয়েছিল তার সুনির্দিষ্টতা না থাকলেও বলা যায় লোকছড়ার উদ্ভব হয়েছিল মানুষের মুখে মুখে। কেননা তখনো লিখিত সাহিত্য সুষমামণ্ডিত হয়নি, ভাষাও ছিল আধফোটা; জ্ঞান-গরিমাও ছিল নিতান্তই হালকা ও অগভীর; তবে রস প্রাচুর্যের কোনো অভাব ছিল না। তাই ধারণা করা হয় এমনি এক পরিবেশেই বাংলা লোকছড়ার জন্ম হয়েছিল সেই প্রাক-মধ্যযুগে। এই মৌখিক সাহিত্যের ধারা চলতে থাকে দীর্ঘকাল। মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েকে ঘুম পাড়াতে থাকে এই ছড়া দিয়ে। বাড়তে থাকে ছড়ার জনপ্রিয়তা। লোক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ঘুুম পাড়ানি ছড়ার ভেতর দিয়েই স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে চলে আসে সমাজ ইতিহাসের নানান কথা ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?’ এরপর ধীরে ধীরে ছড়া বিবর্তিত হতে থাকে ছড়ার মধ্যে ধরা পড়ে সমাজের উত্থান-পতনের নানা চিত্র। ফুলের মতো ছড়া হয়ে ওঠে লাঙলের ফলার মতো তীক্ষ্ণ ধারালো। ছড়া হয়ে ওঠে আধুনিক সমাজমনস্ক।
মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে প্রথম লিখিত ছড়া কোনটি সে সম্পর্কে কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না। এ দেশে পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করার পরপরই কবি জসীমউদ্দীন ‘দগ্ধগ্রাম’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। ধারণা করা হয় এটিই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কবিতা। জসীমউদ্দীনের ‘দগ্ধগ্রাম’ মূলত একটি পদ্য। যার শরীরে ছড়ার রূপ-রস-ছন্দ আছে। এটিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছড়া হিসেবেও মর্যাদা দিতে পারি। ছড়াটির আংশিক উদ্ধৃতি দিচ্ছি
কীসে কী হইল, পশ্চিম হইতে নরঘাতকেরা আসি
সারাগাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান
পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়া করিল রক্তস্নান।
খানসেনারা এমন জুলুম আর অত্যাচার চালাতে থাকে দীর্ঘ নয় মাস। আমাদের দামাল ছেলেরাও তাদের ওপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে, লড়াই করে, প্রতিশোধ নেয়। এর মধ্যে অনেকেই যুদ্ধ করতে গিয়ে বাড়ি ফেরে না
সোনামানিক ভাইরা আমার
সেই কবে কোন সনে
দানোর সাথে করতে লড়াই
গিয়েছিলেন রণে।
রণের শেষে মায়ের কোলে
আর ফেরেননি তারা
সেই দুখে মার দুচোখ গেল
অশ্রু বাঁধন হারা।
(সোনামানিক ভাইরা আমার : আখতার হুসেন)
ভাইরা প্রাণ দিল, মায়ের বুক খালি হলো, অনেক মা-বোন সম্ভ্রম হারালো তবেই না এদেশ মুক্ত স্বাধীন হলো। কিন্তু এ প্রজন্মের অনেকেই সেই ইতিহাস জানে না
কেমন করে মুক্ত হলো সোনার বাংলাদেশ
একাত্তরের সেই কাহিনী আর হবে না শেষ।
সাগর পারের দত্যি এসে চাপলো যখন ঘাড়ে
দেশের মানুষ হঠাৎ করে বুঝলো হাড়ে হাড়ে। ...
কেউ দেখেনি কেউ ভাবেনি তেমন ভীষণ লড়াই
তাই তো এদেশ মুক্ত করে করছি জয়ের বড়াই।
(শেষ হবে না : সুকুমার বড়ুয়া)
এখন আমরা জয়ের বড়াই করছি ঠিকই কিন্তু এ জয়ের জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়েছে; দীর্ঘদিন আন্দোলন আর সংগ্রাম করতে হয়েছে, সর্বোপরি এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পেয়েছি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ একটি লাল সবুজের পতাকা। যে দেশটিকে আমরা সকলে মিলেমিশে সুন্দর করে গড়ে তুলব। ছড়াকার আবু সালেহর ‘এই পতাকা ধরার কথা’ ছড়াটিতে যেন এমন কথাই ধ্বনিত হয়েছে
আমার কথা ছড়ার কথা
সোনালি এদেশ গড়ার কথা
হাসি খুশি উত্তল হাওয়ায়
মন ও হৃদয় ভরার কথা
অনন্তকাল স্বাধীনতার
এই পতাকা ধরার কথা।
কিন্তু মানুষ যা চায় তা পায় না। সকলে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে থাকতে চাইলেও তা হয়ে ওঠে না। কেননা এদেশে এককালে যেমন ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ ছিল; ছিল মিরজাফর আর উমিচাঁদেরা তারা এখনো আছে। যদিও আমরা
দেশের জন্য ঢেলেছিলাম বুকের তাজা রক্ত
আজ সেখানে হেঁটে বেড়ায় মিরজাফরের ভক্ত।
তবু ঘসেটি বেগম, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠের আত্মা
লাটসাহেব নাতি সাজে দেয় না দশের পাত্তা।
(স্বাধীনতার ছড়া : আসাদ বিন হাফিজ)
এসব ষড়যন্ত্র আর অবহেলার কারণেই দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। একজন অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধার চিত্র ফুটে উঠেছে আমীরুল ইসলামের ‘কাকার জন্য পদ্য’ শীর্ষক ছড়াটিতে
কাকা
এই কি বেঁচে থাকা?
তুমি নাকি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ছিলে?
যুদ্ধ করতে জলে-স্থলে নদীতে খাল বিলে।
শত্রু সেনার সাথে
আঁধার ঘেরা রাতে
টগবগিয়ে এলএমজি জ্বলতো তোমার হাতে...
কিন্তু তুমি কি পেয়েছ কাকা?
এই কি বেঁচে থাকা?
এর চেয়ে আরো করুণ পরিণতি দেখা যায় আশরাফ পিন্টুর ‘মুক্তিযোদ্ধা চয়েন’ শীর্ষক ছড়াটিতে
চয়েন উদ্দিন চয়েন
থালা হাতে দ্বারে দ্বারে
করে সে বয়েন।
কখনও ধমক খায়
কখনও বা গালি
বেঁচে আছে এভাবেই
দিয়ে জোড়াতালি
চয়েন উদ্দিন চয়েন
মুক্তিযুদ্ধে সে নাকি
করেছে জয়েন!
মুক্তিযোদ্ধার এমন ক্রমপরিণতি দেখা যায় ছড়াকার ফারুক নওয়াজের এই লোকটাই
হাতি নেই তার ছাতি নেই তার গরু নেই তার গাধাও নেই
হাত নেই তার দাঁত নেই তার দিদি নেই তার দাদাও নেই
কিছু নেই তার তবু লোকটার কাছে এক গোছা দড়ি আছে
শুনেছি লোকটা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে লড়িয়াছে। ...
কিছু নেই তার শুধু বুকে তার কালযার কাশি আছে
এই লোকটার নেই কিছু আর মৃত্যু ঘনায়ে আসিয়াছে।
এমন নির্মম পরিণতির পর ছড়াকার পরিশেষে এই বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন
...তবে হৈলো কথাটা এই
এই লোকটাই বেঁচে থাকবেই দেশ স্বাধীনের ইতিহাসেই।
শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় নয়, এখনো এ দেশের সাধারণ মানুষ নিপীড়িত-নিগৃহীত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী যে চেতনা তা যেন ভ‚লুণ্ঠিত হচ্ছে। ধনী-গরিবের ব্যবধানটা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট পাওয়া যায় লুৎফর রহমান সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক ছড়াটিতে
দেশ আজ স্বাধীন হলো
মানুষ তবু বন্দি
ধুঁকে ধুঁকে আজো মরে
এ কেমন ফন্দি।
কিছু লোক বড়োলোক
গাড়ি বাড়ি হাঁকছে
ছোট-বড় ব্যবধান
দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশের ছড়া আমাদের ঐতিহ্যগত গর্বের সম্পদ। অতীতকাল থেকেই ছড়ায় উঠে এসেছে সমকালীন দেশ ও সমাজের বাস্তবচিত্র। এরই ধারাবাহিকতায় আধুনিক ছড়াকাররাও দেশ ও সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন তাদের ছড়ায়। আমাদের বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের ছড়াকাররা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং তার পরবর্তী প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করেছেন তাদের ছড়ায়।