×

মুক্তচিন্তা

খালেদার জামিন নিয়ে বিএনপি কোন পথে?

Icon

nakib

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:১৯ পিএম

ঈদের পর তীব্র আন্দোলনের হুমকি-হুঁশিয়ারি থেকে অনেক আগেই সরে এসেছে বিএনপি। এখন ভর করেছে ডিসেম্বরে। দল থেকে বলা হচ্ছে, মানুষ সরকারের ওপর ক্ষেপে আছে। এই সুযোগে ডিসেম্বরে সরকারের পতন ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়া হবে। কীভাবে, কে বাজাবেন ঘণ্টাটি- এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কর্মী পর্যায়ে কিছুটা নড়াচড়া চলছে। তবে শেয়ান নেতারা বেশ সাবধানী। কর্মীদের ব্যস্ত রেখে নিজেরা যদ্দূর সম্ভব নিরাপদে থাকার পথ খুঁজছেন।

নির্জলা সত্য হচ্ছে- ঈদের পর আন্দোলনের ডাক দেয়ার সামর্থ্য আর অবশিষ্ট নেই বিএনপিতে। মাঝারি পর্যায় থেকে হুঙ্কার আসার লক্ষণও নেই। এরপরও ঘটনাচক্রে যে কোনো ঈদের আগে-পরে আন্দোলনের নাম নিলে সেটা কৌতুকে গিয়ে ঠেকবে। অতীতে ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচির ঘোষণা দেয়ার কাজে আলোচিত-সমালোচিত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ঈদ কারাগারেই করতে হয় প্রায় দুই বছর ধরে। তার রাজনৈতিক ভাগ্য ঝুলছে আইনি জালে। তাই ঈদ ছেড়ে ডিসেম্বর বা অন্য কোনো ডেটলাইন না খুঁজে বিকল্পও নেই দলটির।

কাল ৫ ডিসেম্বর দলের প্রধান খালেদা জিয়ার জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় জামিনের রায়ের তারিখ রয়েছে। দিনটিতে হাইকোর্ট এলাকায় শোডাউনের ভাবনাচিন্তা রয়েছে বিএনপিতে। রয়েছে কিছু প্রস্তুতিও। ঢাকার আশপাশের নেতাকর্মীদের কোর্টের দিকে আসতে বলা হয়েছে। দলীয় এবং দলঘেঁষা আইনজীবীদেরও সশরীরে হাজির থাকার কিছু বুদ্ধি বাতলানো হয়েছে। উল্টোদিকে সরকার ও প্রশাসনের প্রস্তুতি আরো বেশি।

বিএনপির শুভানুধ্যায়ী এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিশ্বাস গায়েবি দোয়া, মানববন্ধন, গোলটেবিল আলোচনার চক্করে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে না। জনসম্পৃক্ত অন্য কিছু লাগবে। কিন্তু সেই ‘কিছুটা’ এখনো অনাবিষ্কৃত। সেটার তালিম আওয়ামী লীগ থেকেই নিতে হবে। কারণ বিএনপি এ প্রশ্নে শিশু। দেশে এখন পর্যন্ত আন্দোলনের এমন কোনো গলি, কৌশল নেই যেটা আওয়ামী লীগ করে না দেখিয়েছে। এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছাড়া সাড়া মিলবে না। আর সেটা করতে হবে সংসদে বা আন্দোলনের মাঠে। দলটি রাজপথে ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে বহু আগেই। সংসদে সেই সামর্থ্যরে ধারে-কাছেও নেই। আবার আইনে নতুন কিছু করার সুযোগ কম। তারপরও আইনি প্রক্রিয়ায় যা যা করা সম্ভব আইনজীবীরা গত ২১ মাসে তার প্রায় সবই করেছেন। ফল মেলেনি। তাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে রাজপথেই। সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া শিগগিরই তার মুক্তি সম্ভব নয়। সরকারের ওপর চাপ তৈরির জায়গা হচ্ছে রাজপথ। সেটার জন্য দরকার জনবল-কর্মীবল। আর সময়টা বেছে নেয়া হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে। জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তির মাসও এটি।

দশম সংসদ নির্বাচনের পর একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদে ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের শুরুতে এবং এর পরের বছর ২০১৫ সালে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনে প্রচুর শক্তি শেষ করেছে বিএনপি। কিন্তু অপরিকল্পিত সেই আন্দোলন বুমেরাং হয়েছে। উপরন্তু অর্জন হিসেবে জুটেছে অগুনতি মামলা। মামলার ভারে নেতিয়ে পড়া থেকে আজতক উঠে দাঁড়ানোর ভাগ্য হয়নি। দলীয়প্রধান খালেদা জিয়া দীর্ঘমেয়াদে কারাভোগের পরও চিৎকার করার শক্তি পাচ্ছে না কর্মীরা। সরকারের অনুমতি ছাড়া আন্দোলন হতে পারে এমন বিষয়টি নেতাকর্মীরা ভুলতে বসেছে।

এ অবস্থার মধ্যেও আন্দোলনের ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে মঙ্গলবার মিছিলসহ হাইকোর্টের সামনে শোডাউন করেছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। সেখানে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক বিবেচনায় এতেও হিতে বিপরীত হয়েছে। পুলিশ মামলায় পেঁচিয়ে ফেলেছে দলটির নেতাকর্মীদের। দলকে অগোছালো রেখে এ ধরনের অ্যাকশনে ক’দিন টিকে থাকা যাবে, এ নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তায় ফেলেছে তাদের। দল পুনর্গঠনে এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়েছেন নেতারা। সাংগঠনিক কর্মকান্ড গতি না আসার এটি অন্যতম কারণ। এক হিসেবে জানা গেছে, বিএনপির ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৯টিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওইসব কমিটিকে বলা হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে। বেশিরভাগ জেলাই নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি। অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আংশিক কমিটি দিয়ে চলছে বছরের পর বছর। নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে কয়েক দফা সময় বেঁধে দেয়ার পরও কাজ হয়নি। জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল ও ওলামা দলের অবস্থা আরো করুণ।

দলের সাংগঠনিক এ হাল ছাড়াও গোটা পরিস্থিতি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কারো কারো জন্য অস্বস্তিকর। চেয়ারপারসন, দল এবং নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোনোটারই নিশ্চয়তা নেই। এই দুর্ভাবনা থেকেই শমসের মবিন চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরীদের তালিকায় ভিড়েছেন মোরশেদ খান, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। আরো কয়েকজনের এই পথে হাঁটার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তাদের ধরে রাখতে দলের হাইকমান্ড থেকে উদ্যোগ নেই। বরং যাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তারা চলে যাক- এমন একটি মতকে জোরালো করতে উঠেপড়ে লেগেছেন সিনিয়রদের কয়েকজন। আরেকটি গ্রুপ ‘আল্লাহ ভরসা’ তত্তে¡ অপেক্ষার পক্ষে। ঈদ-চাঁদ, ঈদের আগে-পরে, নভেম্বর-ডিসেম্বর ইত্যাদিতে বসে না থেকে তারা ওপরঅলার দিকে চেয়ে থাকতে চান। এ মানসিকতা তাদের আইনি ব্যাপারেও। ৫ ডিসেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার জামিন প্রশ্নে আপিল বিভাগের রায়। একই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য প্রতিবেদনও জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কালও খালেদা জিয়ার জামিন না মিললে কী হবে? কী কর্মসূচি দেয়া হতে পারে স্পষ্ট ধারণা নেই তাদের। হাইকোর্ট এলাকায় আবারো শোডাউনের সুযোগ মেলার সম্ভাবনা কম।

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদন্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। এরপর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেয়া হয়। ৬৩৮ দিন ধরে কারাগারে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ৭৪ বছর ঊর্ধ্ব খালেদা জিয়া শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাবিন ব্লকে চিকিৎসাধীন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অন্তত ৩৭টি মামলা ঝুলছে। জামিনে আছেন ৩৫টিতে। জামিনের অপেক্ষায় দুটি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। কাল চ্যারিটেবল মামলায় জামিন না হলে ডিসেম্বরজুড়ে মাঠ গরমের কাজটি তারা কোন ছুতায়, কোন কৌশলে করবেন- সেটার জন্য আপাতত অপেক্ষাই শ্রেয়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App