উবার-পাঠাওয়ের বাইক কতটা নিরাপদ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:১৯ এএম
দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য অনেকেই এখন অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরবাইকে চলাচল করেন। সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরবাইকে অনেক নারীকেও চলাচল করতে দেখা যায়। কিন্তু উবার-পাঠাওয়ের মোটরবাইক থেকে পড়ে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে, বাড়ছে হতাহতের ঘটনা। ফলে উবার-পাঠাওয়ের মোটরবাইক যাত্রীদের জন্য কতটা নিরাপদ তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ চালকের ঢাকার রাস্তাঘাট পর্যাপ্ত জানাশোনা নেই। বাইক চালনায় চালকদের দক্ষতা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেক চালকই ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত গতি নিয়ে বেপরোয়া চলাচল করেন। যে কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। আবার অনেক চালক মানিকগঞ্জ, সাভার কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে ভাড়ায় মোটরবাইক চালান, যাদের ঢাকার রাস্তাঘাট তেমন জানাশোনাও নেই। এদের অনেকেরই গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স নেই।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-কানুন না থাকার কারণে ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকে যাতায়াত শুধু নারীদের জন্য নয়, সব যাত্রীর জন্যই অনিরাপদ। কেননা, চালকদের অনেকের প্রশিক্ষণ নেই। তা ছাড়া অনেকে আবার রাজধানীর সড়ক সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচিতও নয়। ফলে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ গত শনিবার সকালে রাজধানীর মিরপুরের বাসা থেকে কোচিং করতে ফার্মগেট যাওয়ার পথে বিজয় সরণিতে উবারের বাইক থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন ইডেনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী আকলিমা আক্তার জুঁই। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সোমবার ভোরে মারা যান তিনি। ওই উবার চালকের লাইসেন্স আছে কিনা জানা যায়নি। তবে ওই ছাত্রীর মৃত্যুর পর আবারো পাঠাও-উবারের মোটরবাইকে যাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত হয়।
এর আগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের চাপায় নিহত হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হক লাবণ্য। ওই শিক্ষার্থী ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। ফাহমিদার মৃত্যুর পর জানা যায়, ওই পাঠাও চালক এক বছর আগে রাইড শেয়ারিং নিবন্ধন করেছিলেন, যা ভুয়া। এমনকি নিবন্ধনে যে ঠিকানা দিয়েছিলেন সেটিও সঠিক ছিল না। এর আগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আরোহীসহ উবার-পাঠাও চালক হতাহতের একাধিক ঘটনা ঘটে।
নাবিলা নামের এক যাত্রী বলেন, আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো উবার ও পাঠাওয়ে শেয়ার নিয়েছি এদের সবগুলোর চালক ঢাকার বাইরের। ঢাকার রাস্তা তারা ঠিকমতো চেনে না। এদের গাড়ি চালনাও বেপরোয়া। তাদের কোনো প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে হয় না। ফাহিম আহমেদ নামের আরেক যাত্রী বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে চালকের যোগ্যতা ও মাদকাসক্ত কিনা সেটি যাচাইয়ে কোনো পদ্ধতি নেই। যার কারণে বাছ-বিচার ছাড়া যে কোনো ব্যক্তি এখানে রেজিস্ট্রেশন করে যাত্রী বহনের অনুমতি পেতে পারে। তিনি বলেন, উগ্র ও বখাটে কিছু তরুণ পার্টটাইমার হিসেবে বাইক চালাতে এসে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে অনেক চালক তেড়ে এসে যাত্রীদের মারতে যায়। হাসনা হেনা নামে এক নারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলো শুরুতে ভালো ছিল। এখন কোনো বাছ-বিচার ছাড়া যাকে-তাকে রাইড চালানোর রেজিস্ট্রেশন দেয়ায় মাদকসেবী, বখাটে ও মাস্তানরা এসব রাইড চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, খারাপ লোকের স্বভাব বদল হওয়া ততটা সহজ নয়। তারা বরং সুযোগ পেলে নিজের প্রকৃত চেহারাটি ভালোভাবে তুলে ধরে। এসব চালক নারীদের সঙ্গে সর্বদা বাজে ব্যবহার করে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে রাইড শেয়ারিং কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই শুরু হয়েছে। এটি যাত্রীদের জন্য কতটা নিরাপদ হবে, কতটা চলাচল উপযোগী হবে এই ব্যাপারটি শুরু থেকে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু উপেক্ষিত। এই ধরনের বাহনে চলাচল করার ক্ষেত্রে একজন যাত্রী বিশেষ করে নারী যাত্রীর নিরাপত্তা, সম্মানের বিষয় ভাবা দরকার ছিল; সেটি ভাবা হয়নি। এই ধরনের রাইডকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, নির্যাতন, হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের বাহনকে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে যতক্ষণ আমরা নিয়ে আসতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু অপরাধের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এই ধরনের বাহনের মাধ্যমে কোনো যাত্রী নির্যাতিত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে সেই ব্যক্তি পরিবার এই বাহনের প্রতি খুব একটা ইতিবাচক ধারণা পোষণ করবে না। এই ধরনের বাহনকে ঘিরে নানা ক্রাইম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ধরনের বাহনের চালকরা রাস্তার শৃঙ্খলা মানে না। সুতরাং এই ধরনের বাহন রাষ্ট্র যত দ্রুত নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে আসবে ততই সবার জন্য ইতিবাচক হবে।
এ বিষয়ে ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) প্রবীর কুমার ভোরের কাগজকে বলেন, মোটরযান যে ধরনের হোক সে যদি আইন অমান্য করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। যাত্রী, পথচারী, সব ধরনের যানবাহনের চালকদের সঙ্গে আমরা সচেতনতামূলক প্রোগাম করি। কারণ সবাই যদি আইন না মানি একা পুলিশের পক্ষে রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। উবার-পাঠাও চালকরা আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এ বিষয়ে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাইড শেয়ারিং সেবাগুলোর ওপরে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল কোর্ট বসিয়ে মোটরসাইকেল আটকানো হচ্ছে। এ ছাড়া চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মনিটরিং নিয়ে সরকারের তরফ থেকে নীতিমালা তৈরি করে গেজেট জারি করা হয়। এর আগে ১৫ জানুয়ারি রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ওই নীতিমালায় রাইড শেয়রিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সেবাগ্রহীতাদের জন্য অনুসরণীয় গুরুত্বপূর্ণ ৮টি অনুচ্ছেদ এবং ১২টি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।