×

জাতীয়

শিক্ষার্থী আন্দোলন বৃথা গেছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৩৮ এএম

শিক্ষার্থী আন্দোলন বৃথা গেছে

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের উত্তাল আন্দোলনে নানা আশ্বাস মিললেও মেলেনি তেমন সুফল। এর মধ্যেও সড়কে ঝরেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মানুষের প্রাণ। সড়ক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় দেড় বছর আগে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু হলেও এখনো পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

ওই সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা টানা পাঁচদিন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে ৫১ জনকে আটক করে পুলিশ। দায়ের করা হয় মামলা। এর মধ্যে আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এক অভ‚তপূর্ব অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সড়কের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আন্দোলনরত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে। এ পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ নমনীয় অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে। পরে তাদের ঘরে ফেরাতে দাবি বাস্তবায়নে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে।

কিন্তু দৃশ্যত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনো সড়কে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরও জেব্রা ক্রসিংয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে বিইউপি শিক্ষার্থী আবরারকে। এখনো টাকা দিলে মিলছে লাইসেন্স। সরকারের নতুন সড়ক আইন মানতে চাইছে না পরিবহন মালিক ও চালকরা। এ নিয়ে তারা কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই ধর্মঘটও করেছে। বৃথা গেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আবেগের আন্দোলন।

বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খাতুন মীম নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলায় গতকাল রবিবার জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালক ও একজন সহকারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর পরও ওইদিন সড়কে বিশৃঙ্খলার চিত্র ছিল অন্যসব দিনের মতোই।

এদিকে দুই সহপাঠীর মৃত্যুর মামলাটিতে আদালতের রায়ে ‘মোটামুটি সন্তুষ্ট’ হলেও সড়কে এখনও ঝুঁকি রয়ে গেছে বলে মনে করেন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম রাজীবের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, তার বেশিরভাগই অপূর্ণ রয়ে গেছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রমিজ উদ্দিন কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর ইসলাম সাগর বলেন, এত আন্দোলনের পর এই রায়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট। দুজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। এটা সঠিক বিচার হয়েছে কিনা, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। ওই আন্দোলনে প্রথম দাবিই ছিল, দিয়া ও রাজীবের মৃত্যুর জন্য দায়ী চালকের মৃত্যুদণ্ড।

রায়ের পর দিয়ার মামা সেলিম হোসেন বলেন, ওই চালকের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। তিনি লাইসেন্স ছাড়া চালক। লাইসেন্স নেই গাড়ির, গাড়ির অন্য কাগজপত্রও নেই। সে কারণে তার ফাঁসি দেয়া উচিত ছিল। সরকার পক্ষের ফাঁসির আবেদন করা উচিত।

সরজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নতুন সড়ক পরিবহন আইন করা হলেও বাস্তবায়ন না করতে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের চাপের কারণে তা শিথিল করা হয়েছে। এখনো সড়কে চলছে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি। চালকের আসনে বসে স্টিয়ারিং ধরছে হেলপার ও অনভিজ্ঞারা। তবে গত কয়েকদিন ধরে বিআরটিএ অফিসগুলোতে ড্রাইভিং লাইসেন্স হালনাগাদ করতে চালকদের ভিড় দেখা গেছে। ফিটনেসের জন্যও দেখা গেছে গাড়ির দীর্ঘ লাইন।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)র সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, ২০১৮ সালে দুর্ঘটনার ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে গাড়ি চাপায়, ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে দুই বাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে, ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে গাড়ি উল্টে, চার শতাংশ ক্ষেত্রে গাড়ি খাদে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় যাদের প্রাণ গেছে, তাদের মধ্যে ৫৬৬ জনই চালক। চালকদের মধ্যে মোটরসাইকেল চালকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১৬০ জন।  তিনি বলেন, নতুন সড়ক আইন মেনে চললে কাউকে এক পয়সাও দিতে হবে না। একদিনও জেল খাটতে হবে না। এই আইন কারো বিরুদ্ধে নয়। আইন মানার জন্য নতুন সড়ক পরিবহন আইন করা হয়েছে। সবার মঙ্গলের জন্য এ আইন করা হয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, পরিবহন সেক্টরের কিছু মানুষের কারণে সবার ভোগান্তি হচ্ছে। এ ভোগান্তি সাময়িক, দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য সাময়িক ভোগান্তি পোহাতে হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল জানিয়েছে, গত ঈদুল ফিতরে ২৭৩ জন নিহত ও ৮৪৯ জন আহত হয়েছেন। ঈদ যাত্রা শুরুর দিন ৩০ মে থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ১১ জুন পর্যন্ত ১৩ দিনে ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

ওই সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, চলতি বছরের শুরু থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোট সংঘটিত ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনার ৭৬টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ। পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। এ দুটি ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলে এ দুর্ঘটনার প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৯ জুলাই জাবালে নূরের দুটি বাসের রেষারেষির মধ্যে একটি বাস বিমানবন্দর সড়কের এমইএস এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একদল শিক্ষার্থীর ওপর উঠে যায়। এতে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর টানা পাঁচদিন সড়কে বিক্ষোভ করে নিজেদের দাবি বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি আদায় করে শিক্ষার্থীরা। স্বতঃস্ফূর্ত ওই আন্দোলন থেকে নয়টি দাবি উঠে আসে শিক্ষার্থীদের স্লোগানে, ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো না থাকলেও ৯ দফা দাবিতে সমর্থন দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। বিক্ষোভ শুরুর পরদিন থেকে সরকারের একাধিক মন্ত্রী শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও কাজ হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ আরো জোরদার হয়।

এক পর্যায়ে সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেও শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে ফেরাতে পারেনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে ডেকে নেন নিহত দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীবের পরিবারকে। তাদের ২০ লাখ টাকা করে অনুদান দেয়ার পাশাপাশি সড়কে নিরাপত্তায় নানা নির্দেশনার কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে দিয়ার বাবা শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান। পরে রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের ৯টি দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে বলেন, এসব দাবি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির মধ্যে ছিল, বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ওই সময় দেয়া তৎকালীন নৈপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএসে ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।

শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করতে হবে। বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না। সরকার তাদের দাবি মেনে নিলেও শেষের তিনটি সঠিকভাবে কার্যকর না করায় দুর্ঘটনা কমছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App