বাতাসে মৃত্যুর পরোয়ানা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৫৭ এএম
বাতাস দিন দিন দূষিত হয়ে ঢাকাবাসীকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে তা বোধ করি কাউকে বলে বুঝাতে হয় না। রাস্তায় বেরিয়ে একটু নিশ্বাস নিলেই তা সহজে টের পাওয়া যায়। শুধু তা কেন, ঢাকার ধুলাচ্ছন্ন আকাশ দেখলে মনে হয়, কুয়াশায় ছেয়ে আছে শহর, নয়তো আগুন লেগে শহরটা ভরে গেছে ধোঁয়ায়। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শুকনো বাতাসে থাকে শতকরা ৭৮.০৯ ভাগ নাইট্রোজেন, ২০.৯৫ ভাগ অক্সিজেন, ০.৯৩ ভাগ আরগন, ০.০৪ ভাগ কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং সামান্য পরিমাণ অন্যান্য গ্যাস। কিন্তু ঢাকার বাতাসে আজ এসে গেছে নানা রূপ অনাকাক্সিক্ষত বস্তু। গত ১৫ থেকে ২১ নভেম্বরে একাধিকবার ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল বিশ্বের সর্বাধিক।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশি্বক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ ৯৭ দশমিক ১০, যেখানে ভারতের হচ্ছে ৭২ দশমিক ৫৪। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর বাতাসের মান পর্যবেক্ষণে দেখতে পায়, সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত থাকে এবং গত চার বছর ধরে ঢাকার বাতাসের দূষণের ব্যাপ্তি ধারাবাহিকক্রমে বেড়ে চলেছে। রাজধানী ঢাকার বাতাসে সাদা চোখে যে ধুলা দেখা যায় তা কিন্তু শুধু মাটির ক্ষুদ্র কণা নয়। এর মাঝে মিশ্রিত আছে নানা ধরনের সূ² রাসায়নিক বস্তুকণাসহ কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার, অ্যামোনিয়া, ফটো-কেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। মানবদেহের জন্য দূষণের অসহনীয় উপাদান মাত্রা পিএম-২.৫ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ১৯৯০ সাল থেকে বসবাস করে আসছে।
দেশে বায়ুদূষণে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু শ্বাসজনিত জটিল সমস্যার শিকার হয় এবং একই কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। দূষিত বায়ু মানবদেহে ফুসফুসের ক্যানসার থেকে শুরু করে স্ট্রোক, হৃদযন্ত্র ও অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ব্যাধির কারণ হতে পারে। ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কমপক্ষে হাজার গুণ। ব্যাপক সিসা দূষণের ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত ও স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত, মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাতাসকে দূষণমুক্ত রেখে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য জরুরি বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধ করা। এজন্য প্রয়োজন নির্মাণাধীন অবকাঠামো থেকে উৎপন্ন ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করা। শিল্পকারখানাকে শহর থেকে দূরে স্থাপন, কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ শিল্প বর্জ্যরে নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাসহ যানবাহনে সিসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটাকে অনতিবিলম্বে বন্ধ করাসহ লোকালয়ের বাইরে নিরাপদ স্থানে ইটভাটা স্থাপন এবং ভাটায় চিমনি নিরাপদ উচ্চতায় স্থাপনের মাধ্যমে কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে যথাযথ নিয়ম মেনে চলার নিশ্চয়তা বিধান অত্যাবশ্যক। এমনকি আগুনে পোড়া ইটের বদলে বালু-সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ডাস্টবিন স্থাপন বন্ধ করতে হবে। বর্জ্যকে যথা স্থানে অপসারণ নিশ্চিতকরণসহ বর্জ্য ও নির্মাণসামগ্রী বহনকালে ট্রাককে ঢেকে নিতে হবে। দেশের বায়ুদূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। রাজধানীর বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি, বেসরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ আপামর জনগণের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি।
প্রকৌশলী, ঢাকা। [email protected]