×

মুক্তচিন্তা

বিএনপি কি মাঠে নামার সাহস শক্তি, সক্ষমতা অর্জন করেছে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:২৯ পিএম

মামলা-মোকদ্দমার চাপে বিএনপি এমনিতেই দিশাহারা। এই অবস্থায় নতুন চাপ নেয়ার সামর্থ্য তাদের কতটুকু আছে সে প্রশ্ন করাই যায়। সরকারের প্ররোচনায় বিএনপি যদি মাথা গরম করে তাহলে তাদের খাদে পড়তে হবে। ফাঁদ এবং খাদ এড়িয়ে চলতে পারলে এবং মানুষের সমস্যা নিয়ে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নির্দোষ ও নিরুত্তাপ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকলে বিএনপি একসময় না একসময় সুফল পাবে।

গত কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতাদের মধ্যে বাহাস চলছে। বিএনপি নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে আবার কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। আন্দোলনের মাধ্যমেই দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করার কথা বলছেন। আবার আওয়ামী লীগ তথা সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, আন্দোলন করার মুরদ বা সক্ষমতা বিএনপির নেই। বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে পুলিশ ছাড়া মাঠে নামার আহ্বান জানাচ্ছেন। বিএনপি মনে করছে, তাদের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। সরকার পুলিশ তথা প্রশাসনিক শক্তির সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে আছে। আওয়ামী লীগ নেতার বলছেন, তারা ক্ষমতায় থেকে দেশের এত উন্নয়ন করেছেন যে, আগামী মেয়াদেও দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। আগামী নির্বাচন এখনো অনেক দেরি আছে। কাজেই এখনই আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ বাণী করা সমীচীন নয়। তবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা যায় যে, বিএনপি যা বলে তা করতে পারে না। তারা লক্ষ্য নির্ধারণ করে কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তারা সক্ষম নয়। বিএনপির জনসমর্থন আছে। কিন্তু সেই সমর্থনকে একটি কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত করার ক্ষেত্রে বিএনপি অপরিপক্ব। তারা অনেক চেষ্টা করেও সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। আবার সর্বশক্তি নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করেও তারা সফল হয়নি। উল্টো আন্দোলনের নামে প্রচণ্ড সন্ত্রাস-সহিংসতা চালিয়ে বিএনপি তার শক্তিক্ষয় করেছে। ২০১৪-১৫ সালে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি চাঙ্গা ছিল। ওই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মধুর মৈত্রী থাকায় জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিতে তারা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। আবার তখন আওয়ামী লীগ এবং সরকার কঠোর মনোভাব দেখানোর কারণে বিএনপি-জামায়াতের সাঁড়াশি আক্রমণ অকার্যকর হয়েছে। তারপরের ইতিহাস হলো, সরকার প্রবল শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর বিএনপি একেবারে ঘরে ঢুকে গেছে। বিএনপি দেশের রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থেই এখন একটি কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ বুঝে গেছে যে, বিএনপির তর্জন-গর্জন সার, বর্ষণের ক্ষমতা তার নেই। বিএনপিও তার শক্তি-সামর্থ্য পরিমাপ করতে পেরেছে। তাই ২০১৫ সালের পর বিএনপি আর ‘অবাধ্য’ আচরণ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার জেদ থেকেও বিএনপি সরে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে বলে ধরে নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগকে কাবু করতে গিয়ে বিএনপি আরেকটি বড় আঘাত পেয়েছে। বিএনপিকে কৌশলের খেলায়ও হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছে আর বিএনপির হয়েছে লজ্জাজনক পরাজয়। মাত্র ৭টি সংসদীয় আসনে জয় পেয়ে বিএনপি সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতেও অটল থাকতে পারনি। নির্বাচিত এমপিদের দলত্যাগ ঠেকানোর জন্য বিএনপিকে সংসদে যাওয়ার পক্ষে মত দিতে হয়েছে। এখন বিএনপি পড়েছে মহাগ্যাঁড়াকলে। একদিকে তারা বর্তমান সংসদকে অবৈধ বলছে, অন্যদিকে নিজেরা সংসদে উপস্থিত থাকছে, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে। বিএনপির নারী সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা ঢাকায় নিজের প্লট থাকার তথ্য গোপন করে আরো প্লট বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করে নিজের নৈতিক অবস্থান দুর্বল করেছেন। নানা বিষয়েই বিএনপির রাজনীতির স্ববিরোধী অবস্থান মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়ায় তাদের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়েছে। বিএনপি নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। দলের মধ্যে অন্তর্কলহ প্রচণ্ড। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন। খালেদা জিয়াকে এতদিন জেলে থাকতে হবে, এটা বিএনপি ভাবতেও পারেনি। তাদের ধারণা ছিল সরকার আর যাই করুক, খালেদাকে জেলে নেবে না। বিএনপি ভেবেছিল, খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা এতটাই প্রবল যে তাকে জেলে নিলেই দেশে আগুন জ্বলে উঠবে। তার মুক্তির দাবিতে মানুষ বাঁধ ভাঙা পানির মতো রাজপথ সয়লাব করে দেবে। প্রবল আন্দোলনের মুখে সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। খালেদার মুক্তি আন্দোলনের জোয়ারে সরকারের পতন ঘটবে বলেও বিএনপি নেতাদের ভাবেসাবে মনে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বিএনপি নেতাদের হতাশ করেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে রাজপথে মানুষের ঢল নামেনি। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও দায়সারা কর্মসূচি পালনের বাইরে যায়নি। বিএনপির দুর্বলতা বুঝতে সরকারের সময় লাগেনি। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি মাঝেমধ্যে আলোচনায় এলেও বাস্তবে তেমন কিছু ঘটতে দেখা যায়নি। বেগম জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিনি কয়েক মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য একটি প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তির যে দাবি বিএনপি বারবার উত্থাপন করেছে, সরকার সেটাও উপেক্ষা করেছে। আবার বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিএনপির পক্ষ থেকে যতটা খারাপ বলে দাবি করা হচ্ছে, মেডিকেল বোর্ড তার সঙ্গে একমত হয়নি। তিনি কারাগারে যাওয়ার আগে যেসব সমস্যায় ভুগতেন, সেগুলো আর বাড়েনি। বিএনপি নেতারা বুঝতে পেরেছেন যে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি তারা যত সহজ ভেবেছিলেন, তত সহজ নয়। এখন বিএনপি তাই আবার আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করার কথা বলছে। আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল কী হবে তা নিয়ে দলের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। একপক্ষ গরম কর্মসূচির পক্ষে থাকলেও অন্যরা নরম পথেই হাঁটতে চায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষ, পেঁয়াজসহ জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং আরো কিছু ইস্যুতে সরকার চাপের মধ্যে আছে মনে করে বিএনপির ‘গরম’ অংশ রাজপথে নামার পরিকল্পনা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। ২৩ নভেম্বর দলীয় এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘সরকারের অনুমতি নিয়ে কখনো আন্দোলন হয় না। এখন থেকে সভা-সমাবেশ করার জন্য প্রশাসনের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। রাজপথ সরকারকে ইজারা দেয়া হয়নি। রাজপথ জনগণের।’ এর পরদিন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দলের নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেন, ‘এখন থেকে সমাবেশ করার জন্য কারো অনুমতি নেয়া হবে না। এই সরকার আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এরপর আর অনুমতি নেব না। রাজপথে নামব- এটা আমাদের শাসনতান্ত্রিক অধিকার।’ দলের দুই ধারার দুই নেতা অভিন্ন ভাষায় হুমকি দেয়ায় কারো কারো কাছে এটা মনে হয়েছে যে, বিএনপি হয়তো আন্দোলনে নামার প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছেছে এবং লন্ডন থেকে তারেক রহমানও হয়তো এই ধারায়ই পরামর্শ দিয়েছেন। তারেকের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া নেতারা এত চড়া গলায় ভাষণ দিতেন না। বিএনপি হয়তো মনে করছে, তাওয়া গরম হতে শুরু করেছে, রুটি ভাজার সময় এসে গেছে। কিন্তু আসলে কি তা-ই? মানুষ কি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত? জনজীবনের সমস্যা-দুর্ভোগ নিয়ে সোচ্চার না হয়ে বিএনপি যদি খালেদার মুক্তির ইস্যুতে মাঠ উত্তপ্ত করতে চায় তাহলে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের জবাবে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে ৫০০ কর্মী নিয়েও একটি মিছিল-মিটিং বিএনপি নেতারা করতে পারেননি। তারা কীভাবে অনুমতি না নিয়ে সভা-সমাবেশ করবে? বিষয়টি হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। অনুমতি না নিয়ে সভা-সমাবেশ না করার সাহস, শক্তি বা সক্ষমতা বিএনপির নেই।’ ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের একদিন পরই দেখা গেল, বিএনপি রাস্তায় নেমে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে গাড়ি ভাঙচুরের ‘আন্দোলন’ শুরু করেছে। ২৬ নভেম্বর দুপুরে বিএনপির কিছু নেতাকর্মী আকস্মিকভাবে হাইকোর্টের সামনের রাস্তায় বসে পড়েন। এতে যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। পুলিশ তাদের উঠিয়ে দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর চড়াও হন এবং প্রাইভেটকারসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। বিএনপির এই ‘অপারেশন’টা আকস্মিক কিন্তু অপরিকল্পিত যে ছিল না, সেটা বোঝা যায় তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যান বোঝাই গজারির লাঠির উপস্থিতি দেখে। একটা কিছু করার পরিকল্পনা করে বিএনপি তাদের সাহস, শক্তি এবং সক্ষমতার পরিচয় দিতে চেয়েছে। তারা মিডিয়ার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ঢিল মেরে পাটকেল সামলানো সহজ হবে কি? হাইকোর্টের সামনে গাড়ি ভাঙচুর এবং পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপি বেশ কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ চার নেতা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। মামলা-মোকদ্দমার চাপে বিএনপি এমনিতেই দিশাহারা। এই অবস্থায় নতুন চাপ নেয়ার সামর্থ্য তাদের কতটুকু আছে সে প্রশ্ন করাই যায়। সরকারের প্ররোচনায় বিএনপি যদি মাথা গরম করে তাহলে তাদের খাদে পড়তে হবে। ফাঁদ এবং খাদ এড়িয়ে চলতে পারলে এবং মানুষের সমস্যা নিয়ে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নির্দোষ ও নিরুত্তাপ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকলে বিএনপি একসময় না একসময় সুফল পাবে। কথায় আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। বিএনপির যে সাংগঠনিক অবস্থা তাতে তাদের সবুর করা ছাড়া বিকল্প নেই। সরকার পতনের বাস্তবতা যে দেশে নেই এটা না বুঝে মাঠে নামলে হঠকারিতা হবে। একদিকে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে, অন্যদিকে সরকার প্রধানের ওপর আস্থা বাড়ছে। বিএনপির প্রতি নেগেটিভ সমর্থন আছে। তবে সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দৃঢ় থাকলে বিএনপির সমর্থকদের মধ্যেও বিভাজন দেখা দেবে। রাজনৈতিক অঙ্কের যোগ-বিয়োগের ফলাফল এখনো অমীমাংসিত। এই অবস্থায় সহিংসতার পথে হেঁটে বিএনপির হিসাবের খাতায় কিছু যোগ হবে বলে মনে হয় না। রাজনীতিতে ঝুঁকি নিতে হয়। তবে সেটা সময় বুঝে। সময়ের আগে কিছুই হয় না, হবে না।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App