×

অর্থনীতি

খেলাপি ঋণের থাবায় জর্জড়িত ব্যাংকিং খাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৪:৪০ পিএম

খেলাপি ঋণের থাবায় জর্জড়িত ব্যাংকিং খাত

ছবি: সংগ্রহ

খেলাপি ঋণের থাবায় জর্জড়িত ব্যাংকিং খাত

খেলাপি ঋণের অক্টোপাসের থাবায় দেশের ব্যাংকিং খাত জর্জড়িত। নিয়ম-অনিয়মের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ নানা সুবিধা নিলেও ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এদিকে খেলাপী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) করতে পারছে না। মন্দ ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরে ঘাটতি বেড়েছে ২ কোটি টাকা। তবে কিছু ব্যাংকের উদ্বৃত্ত থাকায় গত প্রান্তিকের তুলনায় চলতি প্রান্তিকে ঘাটতি কিছুটা কমেছে।

বিশ্লেষকেদের মতে, খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বাড়ার কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের মূলধন ঘাটতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে জনগণের আমানত ফিরিয়ে আনার কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে নিট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩টি ব্যাংকের মোট ৯ হাজার ৪৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। যা সরকারি ৩টি ব্যাংকের ৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংকের ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা ও একটি বিদেশি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকে ১৫৬ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংক খাতে ৩০২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৬২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে ৫৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা প্রভিশন রেখেছে ব্যাংকগুলো। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। তবে জুন মাসের তুলনায় ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি কমেছে সেপ্টেম্বরে। চলতি বছরের জুন শেষে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার এক ২১৯ কোটি টাকা।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। কেননা এসব ব্যাংকের পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ বেশি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয় ব্যাংকের আয় থেকে। প্রভিশন সংরক্ষণ না করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া যায় না।

সূত্রমতে, আমানতকারীদের আমানত ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন রাখার বিধান রয়েছে। একই কারণে খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত মূলধন রাখারও বিধান রয়েছে। কিন্তু ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হওয়ায় এবং সে অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণ না করায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকার পরিচালিত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে এ ঝুঁকির প্রবণতা বেড়েছে বেশি।

ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো, নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ নিম্নমান হলে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর পরপর ছয় মাস ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণকে সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। আর এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। তবে ৯ মাস অতিবাহিত হলে ওইসব ঋণকে মন্দ ঋণ বলা হয়।

এ মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এটা করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের আয় খাত থেকে বেশি পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করলে ওই ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছেকৃত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা মন্দা, ব্যাংকিং খাতে ঋণ কেলেঙ্কারি ও চলমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের এবার পরিচালন মুনাফা কমেছে। বেড়েছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ।

সব মিলিয়ে এবার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমে গেছে। এর ওপর অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা না হয়ে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন। ব্যাংকগুলোর ঋণের ঝুঁকি বিবেচনা করে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের প্রভিশন রাখার প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। প্রভিশন ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।

এক সময় কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শুধু সতর্ক ও ঘাটতি মেটাতে দিকনির্দেশনা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দু'বছর ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এসব কারণে নানা উপায়ে প্রভিশন ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তিন মাস আগে (জুন শেষে) মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App