×

সাময়িকী

মনন ও ব্যক্তিসত্তার নির্মাতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম

মনন ও ব্যক্তিসত্তার নির্মাতা

স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। যিনি রনবী নামে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশের চিত্রশিল্প অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমধর্মী নাম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ‘রফিকুন নবী’ নামে কার্টুন এঁকে। চারুকলার কয়েকটি মাধ্যমে। যেমন- জলরং, উডকাট, রেখাচিত্র ও তেলরঙে ছবি এঁকেও বিপুলভাবে জনপ্রিয় তিনি। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর লেখালেখির একটি আকর্ষণীয় ভুবন। ছড়া, উপন্যাস, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী প্রভৃতি সৃষ্টিশীলতাও তাঁকে পাঠকপ্রিয় করেছে। বাংলাদেশে চারুশিল্পীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও মননশীলতা উভয় ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা অর্জনের দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। তিনি সেই বিরল প্রতিভাবানদেরই একজন।

বাংলাদেশে শিল্পকলা জগতে অনন্য প্রতিভার অধিকারী রফিকুন নবী। রনবী হিসেবেও তার পরিচিতি সমধিক। একজন মানুষ ও তার কর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধন ও তা বোঝার চেষ্টা একটা চলমান প্রক্রিয়া, যা কখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। শিল্পী রফিকুন নবী তার ছবির একাধিক শ্রেণি নির্মাণ করেছেন। চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর অনবদ্য কাজ ইতোমধ্যে কালের খাতায় স্থ’ান করে নিয়েছে।

রফিকুন নবীর চিত্রে বেশকিছু বৈশিষ্ট্য দেখি আমরা। এসব বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের শিল্পী রফিকুন নবীকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। তিনি তার ছবির ভাষা নির্মাণ করার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর পরিকল্পনা ও চিত্রের বিভাজন অত্যন্ত পরিকল্পিত। যে পরিকল্পনা আমরা পশ্চিমা রেনেসাঁর শিল্পশৈলীতে দেখতে পাই। রেনেসাঁর ছবি কতকগুলো আনুভূমিক রেখার সমষ্টি। যেখানে মানুষ ও মানুষের অর্জনের আখ্যান সুস্পষ্ট। স্থাপত্যের মধ্যে অঞ্চলের মানুষের জ্ঞান ও গরিমা নিহিত। এই অর্জন নির্মাণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে সুসংহত করেছে।

মানুষের অর্জনের সঙ্গে ভৌগোলিক এই সম্পর্ক নির্ণয়ের সূত্রটিকেই ভূতত্ত্ববিদরা চিহ্নিত করে থাকেন পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণবাদ হিসেবে। এই তত্ত্ব প্রাচীন গ্রিসবাসীর মধ্যে মজুদ ছিল। তারা বিশ্বাস করত, তাদের অঞ্চলের পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য মানুষের সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য যথাযথ। জাতীয়তাবাদী ধারণা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরিবেশীয় নিয়ন্ত্রণবাদের প্রভাব অন্য প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশের সাহিত্য, রাজনীতিতে দেশপ্রেম নির্মাণের ভাষায় ব্যাপকভাবে লক্ষ করি।

দেশমাতৃকার রূপনির্মাণে গানে, কবিতায় যেসব রূপকল্প চিত্রিত হয়েছে, সেখানে ভূমির গল্পই প্রধান। এই ভূমির রূপ বা ভূদৃশ্য সাহিত্যের তুলনায় দেশভাগের পরে শুরু হওয়া আধুনিক দৃশ্যশিল্পের আন্দোলনে সেই অনুপাতে জায়গা করে নিতে পারেনি। এ দেশে ভূদৃশ্য যা আঁকা হয়েছে বা হয়, তা মূলত মূলধারার শিল্পভাবনা থেকে নয়। জলরঙে আঁকা এসব ছবি যতটা না ধন ধান্য পুষ্পে ভরা বসুন্ধরার গল্প বলতে চায় তার চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত করে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক চোখে দেখা ধারণাকে।

আমরা রফিকুন নবীর ছবির দিকে তাকালে দেখব তিনি তার ছবিতে চাক্ষুষ পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণবাদকে অস্বীকার করেছেন। অন্তত সাহিত্যের মতো দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো প্রমাণ তার ছবিতে নেই। এখানে শিল্পী পশ্চিমাদের অর্জন ধারণা থেকে পৃথক হয়ে যান। তাঁর ছবিতে এমনকি সার্বভৌমত্বের ধারণায় জাতীয়তাবাদও নয়, নিজ জ্ঞাতি বা গোষ্ঠীর মানুষ আঞ্চলিক অর্থে স্থান পেয়েছে।

তাঁর সব ছবিতেই মূলত আমরা জড়জীবনের একটি শিল্পাঙ্গিক লক্ষ করি। এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে অবসর সময়ের। অবসর সময় ও জড়জীবন যে পারস্পরিক ধারণা বিনিময় করতে পারে এই কথাটিই শিল্পী রফিকুন নবী তার ছবির মধ্য দিয়ে আমাদের জানান দেন। ফলে তার ছবিতে একদল শ্রমজীবী মানুষের অবসর, অলস বা আরাম প্রিয় সময়টি জড়জীবন হিসেবে চিত্রিত হতে হতে একটি আঙ্গিকে রূপ নিয়েছে, যা এই অঞ্চলের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ও নদীমাতৃক উর্বর ভূমির পরিণাম হিসেবে দেখা হয়।

রফিকুন নবী যে সময়কালে বেড়ে উঠেছেন, মনন ও ব্যক্তিসত্তাকে নির্মাণ করেছেন, সে সময়কে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা শিল্পীর মূল শিল্পকর্ম ব্যাখ্যা করি। রফিকুন নবীর জন্ম, তার লেখক সত্তার জন্ম ইত্যাদি বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাঁর সময়ের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতেই হবে।

আরেকটি কথা বলি, শিল্পী তাঁর ছবির ভাষা তৈরিতে বিশেষ সচেতন। তাঁর ছবি দেখতে দেখতে অনেক সময়ই মনে হয় কম্পোজিশন তার ছবির মূল বিষয়বস্তু। তারপর সেখানে তিনি তার পরিচিত কিছু বস্তু বা রূপ বসিয়ে দেন। ফলে মনে হয়, তার ছবিতে রূপ যদি অস্বীকার করা হয়, তাতেও তার ছবির তেমন কিছু যায়-আসে না। তিনি সময়ের পরিবর্তনকে স্বীকার করেন ও পরিবর্তিত হন নিজেই। শিল্পভাষার সঙ্গে সময়ের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের সমীকরণও শিল্পী স্বীকার করেন। দেখা গেছে, রফিকুন নবী ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে অপরিবর্তিত সময়কে ব্যক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের অগ্রযাত্রার এটাই মূল সূত্র। ফলে রফিকুন নবীর বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্পচর্চা কোনোটাই আমাদের শেষ পর্যন্ত বিচ্যুতির গল্প বলে না। মানুষের সম্ভাব্য সব সৃষ্টিকর্মের অখণ্ড আখ্যান তৈরি করে বরং তা আমাদের বিচ্ছিন্নতা বোধকে প্রতিরোধ করতে উদ্দীপ্ত করে।

শিল্পীর চারকোল, ড্রাই প্যাস্টেল, কালি-কলম, জলরং ও মিশ্র মাধ্যমে আঁকা চিত্রকর্ম আমরা দেখেছি। তাঁর বেশিরভাগ ছবি ড্রয়িংভিত্তিক। তিনি ছবির বিষয় হিসেবে সব সময় বেছে নেন প্রকৃতি, গ্রাম-বাংলার জনজীবন, মানুষ, দৈনন্দিন সংকট, রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা, পশুপাখিসহ আশপাশের চেনাজগৎকে।

আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। গাছতলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে রাখাল। ক্লান্ত দুপুরে গরুর পাল এসে জড়ো হয়েছে সেখানে। গ্রামবাংলার চিরচেনা দৃশ্য। বাংলার নিসর্গ ও জনমানুষের জীবনযাত্রার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে প্রধানত চারকোলে অঙ্কনকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছেন শিল্পী রফিকুন নবী।

রফিকুন নবী সমাজের দিকে তাকান সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টি নিয়ে। সেই দৃষ্টির সঙ্গে তাঁর নান্দনিক ভাবনার যোগে যে শিল্পকর্ম রচিত হয়, তা অনবদ্য। আধুনিকতা দিয়ে মনের তাৎক্ষণিক তাড়নাকে প্রকাশের তাগিদ ও আকুতি রফিকুন নবীর মধ্যে নেই। তিনি দেশের মূলধারার বিষয়কে আত্মস্থ করে তাকে এসব অঙ্কনপ্রধান কাজে রূপায়িত করেছেন।

তাঁর কাজগুলো দেখে মনে হয়, সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখা হলো। দেশের প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি এই কাজগুলো। নিজেকে নিয়ে বলেন তিনি, শিল্পের যে সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে ছিলেন ডাঙার সন্ধানে, সেই অভীষ্ট ডাঙার দেখা পাননি এখনো।

দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় জীবনের প্রথম কার্টুন আঁকেন তিনি। কার্টুনটি ছিল ভিক্ষুকদের ওপরে। বিষয় দারিদ্র্য। লক্ষ্য ছিল ভিক্ষুকদের ব্যবহার করে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের অবস্থানটা তুলে ধরা। কার্টুনের প্রতি আগ্রহটা আরো বেশি জোরাল হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, বিভিন্ন যুব সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়নের কার্টুন পোস্টার আঁকার আহ্বানে। রনবীর টোকাই তার কার্টুন জীবনের এক নতুন মাইলফলক। টোকাই এমন একটি নাম যা সামগ্রিকভাবে সব পথশিশুকেই নির্দেশ করে। ’৭৬-এ বিদেশ থেকে ফিরে এসে পথশিশুদের নিয়ে কার্টুন আঁকায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন রফিকুন নবী। টোকাই নামকরণের প্রথমে মোক্কা, টোকা মিয়া, এরপর টোকন, টোকাইন্যা। কিন্তু সব নামই কেমন অসম্পূর্ণ মনে হয় রফিকুন নবীর কাছে। প্রথম ভাবনার দীর্ঘ ৮ বছর পর রফিকুন নবীর আঁকার জগতে জন্ম নিল নতুন এক অধ্যায়- টোকাই। ’৭৮-এ শুরু করা কার্টুনে রফিকুন নবী টোকাইয়ের বয়স রেখেছেন আট। শিল্পীর কল্পনায় ’৭১-এ বেঁচে যাওয়া পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন পথের শিশুই টোকাই। অবশেষে টোকাই। টোকাই নামক কার্টুন চরিত্রটির স্রষ্টা খ্যাতনামা চিত্রকর, কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী। টোকাই বাংলা অভিধানে স্থান করে নিয়েছে নতুন শব্দ হিসেবে।

টোকাই শিরোনামে প্রথম কার্টুনটি ছাপা হয় বিচিত্রার প্রারম্ভিক সংখ্যায় ১৯৭৮ সালের ১৭ মে। প্রথম কার্টুনে টোকাই একজন বড় কর্মকর্তা। বসে আছে তার বানানো অফিসে। রাস্তার ইট দিয়ে তৈরি একটি টেবিলে। প্রথম কার্টুনেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেল টোকাই। নিয়মিত বিচিত্রায় ছাপা হলো টোকাই। বিচিত্রা বন্ধ হলে ২০০০ সাল থেকে সাপ্তাহিক ২০০০-এ আবার শুরু করেন টোকাই। বছর চারেক পরে নিয়মিত টোকাই আঁকায় যতি টানেন রফিকুন নবী। রফিকুন নবীর আঁকা টোকাইয়ের মাথায় টাক, কখনো গুটিকতক চুল, খাটো চেক লুঙ্গি মোটা পেটে বাঁধা। কখনো কাঁধে বস্তা। ’৭৮-৭৯-এ ভোটের সময় বিলি করা জামা পরেছিল টোকাই, সেই জামাটি ছিল ওর থেকে অনেক বড় আকারের। টোকাই থাকে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাতে, ফেলে রাখা কংক্রিটের পাইপের ভেতর, পার্কের বেঞ্চিতে, ভাঙা দেয়ালের পাশে, কাঠের গুঁড়িতে, ঠেলা গাড়ির ওপরে, ইটের ওপর মাথা পেতে। তার পাশে থাকে কুকুর, কাক। টোকাই কথা বলে কাক, গরু, ছাগল, মশার সাথে। কথা বলে মানুষের সাথেও। তার কথা বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণতায় ভরা, আবার রসে সিক্ত। পেন অ্যান্ড ইঙ্কের পরে রফিকুন নবীর টোকাই হাজির হলো জলরঙের উচ্ছলতায়। সেখানে সে কখনো মনের আনন্দে মার্বেল গুটি দিয়ে খেলে, নৌকা চালায়, বাঁশি বাজায়, বেহালা বাজায়, কখনো রাস্তার বুকে উবু হয়ে লিখতে শুরু করে, কখনো আনন্দে দেয় ছুট। কখনো একা বসে থাকে, আবার কখনো পাঁচিলের ওপরে উঠে পাশের দেয়ালের অপরদিকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে, রাজকীয় বাড়ির দরজায় হাজির হয় কাঁধে বস্তা নিয়ে। রফিকুন নবীর টোকাই এভাবে সমাজ-সংসারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলে প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের স্রষ্টা রফিকুন নবী যিনি রফিকুন নবী নামেই সর্বাধিক পরিচিত। তিনি ১৯৭৭-৭৮ সালে কার্টুন করতে শুরু করেন। বলা যায়, রনবী তার সৃষ্ট ‘টোকাই’ চরিত্রের মাধ্যমে জনকণ্ঠের মধ্যে কার্টুনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এবং এই কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ জনগণের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। প্রযুক্তির এই সমৃদ্ধ যুগে কার্টুনেও লেগেছে এর ছোঁয়া। এখন কাগজ কলম ছেড়ে সরাসরি কম্পিউটারেই অনেক দ্রুত আঁকা ও রং করা দুটোই সম্ভব। সেই সাথে নতুন নতুন টেকনোলজির কল্যাণে কার্টুন থেকে তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের অ্যানিমেশন। তবে সবকিছুর মূলেই রয়েছে দুর্দান্ত সব সৃজনশীল আইডিয়া। আর নতুন প্রজন্মের এই আইডিয়াবাজদের মেধায় এগিয়ে যাক এই শিল্পটি এমনটাই প্রত্যাশা।

অধুনালুপ্ত বিচিত্রায় টোকাই একবার ম্যান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়। গম্ভীর চেহারার রফিকুন নবীর মাঝে সৃষ্টিশীলতার সাথে খেলে যায় রসবোধ। নিসর্গের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রং-তুলি হাতে তার প্রেমে নিজেকে হারাতে ভালোবাসেন শিল্পী। আবার সমাজ ও রাজনীতি সচেতন রফিকুন নবী ভাবেন সাধারণ মানুষের কথা, পথশিশুদের দুঃখ-দুর্দশাকে দেখেন বড় করে। কোনো নিপীড়ন সহ্য করবেন না- এই তাঁর প্রতিজ্ঞা। শিল্পীর পরিমণ্ডল জুড়ে তাই স্থান করে নিয়েছে বাস্তব আর কল্পনার সম্মিলন। এক সত্তা যখন সুন্দরের পূজা করতে ব্যস্ত, অন্য সত্তা তখন সমাজ-বাস্তবতার অসঙ্গতিগুলোকে বিদ্রুপপ করে কঠোরভাবে। শত ব্যস্ততার জীবনে আঁকার জগৎটিই শিল্পীর সবচেয়ে বেশি প্রিয়। নিসর্গপ্রেম আর টোকাই- এই দুই জগৎকে নিয়েই রফিকুন নবী লালন করে চলেছেন সময়ের পথে তাঁর সাহসী যাত্রা। ১৯৯৬ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত শিশুশ্রম বিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে অন্যতম বিচারক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন রফিকুন নবী।

রফিকুন নবী ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রশীদুন নবী এবং মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। রফিকুন নবীর মাতুল ও পৈতৃক দুই পরিবারই ছিল সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর পিতা রশীদুন নবী ও পিতামহ মহিউদ্দীন আহমেদ দুজনই ছিলেন পুলিশ অফিসার। পুলিশ অফিসার বাবার বদলির চাকরির সুবাদে রফিকুন নবীর বাল্য ও কৈশোরকাল কেটেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকা দেখার সুযোগটা তিনি পেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে ঢাকায় থিতু হন বাবা। পুরান ঢাকাতেই কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কাটে রফিকুন নবীর। ১৯৫০-এর মাঝামাঝিতে স্কুলে ভর্তি হন তিনি। পুরান ঢাকার পোগোজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৫৯ সালে সম্পূর্ণ পিতার ইচ্ছায় ঢাকার সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন তিনি। এখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান এবং পরে আরো কতিপয় খ্যাতিমান দিকপালের সান্নিধ্যে থেকে পড়াশোনা করেন। আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষে থাকতে নিজের আঁকা ছবি প্রথম বিক্রি করেন ১৫ টাকায়। স্থানীয় সংবাদপত্রে রেখাচিত্র এঁকে এবং বুক কভার ইলাস্ট্রেশন করে পরিচিতি লাভ করেন দ্বিতীয় বর্ষেই। ১৯৬২ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তি লাভ করেন তিনি। ’৬৪ সালে স্নাতক পাস করেন।

পড়াশোনা শেষ করে রফিকুন নবী সে সময়ে ঢাকার প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত কাজ শুরু করেন। নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। ১৯৬৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নিয়ে তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, কাপড় ও খাদ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে গ্রিক সরকারের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বৃত্তি নিয়ে তিনি ভর্তি হলেন গ্রিসের এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্ট-এ। পড়াশোনা করলেন প্রিন্ট মেকিংয়ের ওপর। ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। শিক্ষক থেকে ধীরে ধীরে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস-এর ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রফিকুন নবী পেয়েছেন একুশে পদক, চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বুক-কভার ডিজাইনের জন্য ১৩ বার ন্যাশনাল একাডেমি পুরস্কার। ২০০৮ সালে তাঁর আঁকা খরা শীর্ষক ছবির জন্য ৮০টি দেশের ৩০০ জন চিত্রশিল্পীর মধ্যে এক্সিলেন্ট আর্টিস্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড হিসেবে মনোনীত হন। পেশায় শিক্ষক, কার্টুনিস্ট, পেইন্টার, খ্যাতনামা ইলাস্ট্রেটর, প্রচ্ছদ ডিজাইনার রফিকুন নবীর প্রকাশনায় রয়েছে ৪টি উপন্যাস, ৫ খণ্ডে টোকাই, ৩টি কিশোর উপন্যাস, ১টি প্রবন্ধের বই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App